বাংলাদেশের অর্থনীতির গতি-প্রকৃতি
বাংলাদেশ একটি উন্নয়নশীল মিশ্র অর্থনীতির দেশ। স্বাধীনতা-উত্তর প্রথম সরকার যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ পুনর্গঠন, আয় বৈষম্য দূরীকরণ, দারিদ্র্যের অভিশাপ হতে মুক্ত করার লক্ষ্যে সমাজতান্ত্রিক ভাবধারায় দেশ গঠনে মনোনিবেশ করলেও বার বার রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের মাধ্যমে বর্তমানে নিয়ন্ত্রিত ধনতান্ত্রিক অর্থব্যবস্থা প্রচলিত রয়েছে। সরকারি ও বেসরকারি খাতে যৌথ অংশীদারিত্বের মাধ্যমে পরিচালিত উন্নয়ন কর্মকান্ডের ফলে প্রবৃদ্ধির হার গত এক দশক যাবৎ ৬ শতাংশের ঘরে ওঠানামা করছে। মাথাপিছু আয়, জীবনযাত্রায় মান, গড় আয়ু বৃদ্ধি পাচ্ছে।
নিম্নে বাংলাদেশের অর্থনীতির গতি-প্রকৃতি তুলে ধরা হলো :
১. অর্থের সরবরাহ : স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশের সূচনালগ্নে ১৯৭১ সালের ১৭ ডিসেম্বর দেশে অর্থের সরবরাহ ছিল ৫৪৬.০২ কোটি টাকা। ১৯৭৫ সালের জুন মাসে অর্থের যোগানের পরিমাণ (ব্যাপক মুদ্রা M2) দাঁড়ায় ১,৩০২.৪০ কোটি টাকা এবং মার্চ ২০১৬*১ সালে ৮,৫৩,১৮৫ কোটি টাকা ।
২. জনসংখ্যা : জনসংখ্যাও সময়ের সাথে দ্রুত বৃদ্ধি পেতে থাকে।
৩. শ্রমশক্তি ও কর্মসংস্থান : ১৯৯৫/৯৬ সালে কৃষি, শিল্প ও সেবাখাতে নিয়োজিত শ্রমিকের হার ছিলো যথাক্রমে ৬৩.২, ৭.৫ এবং ১২.০ শতাংশ যা ২০১৩ সালের লেবার ফোর্স সার্ভে অনুযায়ী কৃষিখাতে নিয়োজিত শ্রমিকের হার ৪৫.১ শতাংশ এবং অকৃষিখাতে নিয়োজিত শ্রমিকের হার ৫৪.৯ শতাংশ। তথ্য হতে লক্ষ করা যায়, কৃষিতে নিয়োজিত শ্রমিকের হার হ্রাস পেলেও শিল্প ও সেবাখাতে নিয়োজিত শ্রমিকের হার বৃদ্ধি পেয়েছে।
৪. কৃষি উৎপাদন : কৃষি উৎপাদনের গতিধারা খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। বাংলাদেশ কৃষিখাতে অভাবিত সাফল্য অর্জন করেছে। জনসংখ্যা বৃদ্ধির সাথে সাথে আবাদযোগ্য জমির পরিমাণ হ্রাস পেলেও কৃষি উৎপাদন অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে।
৫. শিল্প উৎপাদন : বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে শিল্প খাতের অবদান এবং উন্নয়নের গতিধারা অত্যন্ত আশাব্যঞ্জক। অর্থনীতির আধুনিকায়ন ও কাঠামোগত রূপান্তর, অর্থনৈতিক ভিত্তির বৈচিত্রায়ন, ক্রমবর্ধমান উৎপাদনশীলতা অর্জন, প্রযুক্তিগত অগ্রগতি, বাহ্যিক ব্যয় সংকোচন, ত্বরিৎ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জন, কর্মসংস্থান সৃষ্টি এবং জনগণের আয় ও জীবনযাত্রার মান উন্নয়ন। এসব ক্ষেত্রে শিল্প উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করছে।
৬. সঞ্চয়-বিনিয়োগ (জিডিপি'র শতকরা হার) : সঞ্চয় ও বিনিয়োগ খাতেও পরিবর্তনের ধারা সচল ছিলো। গত দেড় দশকে অভ্যন্তরীণ ও জাতীয় সঞ্চয় এবং বিনিয়োগ বৃদ্ধি পেয়েছে। এক্ষেত্রে সরকারি খাত অপেক্ষা বেসরকারি খাতের অবদান ছিলো বেশি।
৭. অর্থনৈতিক খাত : দেশজ উৎপাদনে বাংলাদেশের সার্বিক খাতসমূহের অবদানের কাঠামোগত পরিবর্তন ও প্রবৃদ্ধির ধারা : গত চার দশকে বাংলাদেশে জিডিপিতে কৃষি খাতের অবদান ক্রমান্বয়ে হ্রাস পেয়েছে এবং শিল্প খাতের অবদান ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পেয়েছে। তবে সেবা খাতের অবদান প্রায় একই রয়েছে।
৮. প্রকৃত GDP ও প্রবৃদ্ধির হার : বিপুল জনসংখ্যার ভারে আক্রান্ত অর্থনৈতিকভাবে দরিদ্র বাংলাদেশ এর অভ্যুদয় হতে মোট দেশজ উৎপাদন (GDP) এর আয়তন, মাথাপিছু GDP, প্রবৃদ্ধির হার সবই ছিল স্বল্প (Small), সন্তোষজনক নয়। অবশ্য এর পিছনে অনেক কারণ দায়ী, যেমন : প্রয়োজনের তুলনায় অভ্যন্তরীণ খাদ্যের সরবরাহ বা উৎপাদন স্বল্প, রপ্তানি যথেষ্ট স্বল্প কিন্তু আমদানি ক্রমাগত ক্রমবর্ধমান, প্রত্যক্ষ বৈদেশিক বিনিয়োগ (Foreign Direct Investment - FDI) আকর্ষণে ব্যর্থ, ত্রুটিযুক্ত ব্যাংকিং ব্যবস্থায় উচ্চ ও চক্রবৃদ্ধি সুদের হার, রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানসমূহ ক্রমাগত লোকসানের ভারে আক্রান্ত, দুর্বল অবকাঠামো, অদক্ষ কর ব্যবস্থা-কর প্রশাসন, উচ্চ মুদ্রাস্ফীতির হার, রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা, আইন-শৃঙ্খলার চরম অবনতি, শিক্ষার অভাব এবং বেকারত্ব। উপযুক্ত শিক্ষার প্রসার এবং বিনিয়োগের অনুকূল পরিবেশ প্রতিষ্ঠা ও মোট দেশজ উৎপাদন (GDP) বৃদ্ধির মাধ্যমে উল্লেখিত সমস্যাসমূহের তীব্রতা হ্রাস বা সমাধান করা সম্ভব।
সূচি থেকে বোঝা যায়, GDP এর পরিমাণ ক্রমাগত বাড়লেও প্রবৃদ্ধির হার মাঝে মধ্যে স্বল্প ছিল। তবে ২০০০ সালের পরবর্তী বছরগুলোতে এই প্রবৃদ্ধির হার ৬ শতাংশের অধিক ছিল। ২০০৮-১০ সময়ে বিশ্ব অর্থনীতি মন্দার কবলে পড়লেও বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি ৬% এর অধিক ছিল । কিন্তু তখন অনেক উন্নত দেশের অর্থনীতি মন্দায় আক্রান্ত হয়েছিল ।
৯. বিদ্যুৎ উৎপাদন : ১৯৯৭ সালে দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা ছিলো ২৯০৮ মেগাওয়াট, উৎপাদন হতো ১৬০০- ১৮০০ মেগাওয়াট। ২০১৫-১৬ (ফেব্রুয়ারি '২০১৬ পর্যন্ত) এ ক্ষমতা বৃদ্ধি পেয়ে সরকারি খাতে ৬,৪৪০ মেগাওয়াট, বেসরকারি খাতে ৫,১৮৬ মেগাওয়াট এবং ৫০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানিসহ মোট স্থাপিত উৎপাদনক্ষমতা ১২,১২৬ মেগাওয়াটে দাঁড়িয়েছে। এ পর্যন্ত সর্বোচ্চ ৮,১৭৭ মেগাওয়াট (১৩ আগস্ট ২০১৫) বিদ্যুৎ উৎপাদন করা সম্ভবপর হয়েছে।
১০. গ্যাস ও জ্বালানি : প্রাকৃতিক গ্যাস বাংলাদেশের একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ জ্বালানি সম্পদ। দেশে মোট প্রাক্কলিত গ্যাস মজুদের পরিমাণ ছিলো ৩৮.০২ ট্রিলিয়ন ঘনফুট (২০১৬)। এর মধ্যে উত্তোলনযোগ্য প্রমাণিত ২৭.১২ ট্রিলিয়ন ঘনফুট; ব্যবহারের পর জানুয়ারি ২০১৬ সময়ে নিট মজুদের পরিমাণ দাঁড়ায় ১৩.৬৪ ট্রিলিয়ন ঘনফুট। এছাড়া বর্তমানে নবায়নযোগ্য জ্বালানি নীতিমালায় ২০১৫ সালের মধ্যে মোট বিদ্যুৎ উৎপাদনের ৫ শতাংশ এবং ২০২০ সালের মধ্যে তা ১০ শতাংশ অর্জনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে যা সোলার, বায়ু, বায়োমাস ও বায়োগ্যাসভিত্তিক উৎপাদিত হবে।
১১. মূল্যস্ফীতি : মূল্যস্ফীতির গতিধারা সর্বদাই ছিলো অনিশ্চিত। এটি অভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক বহুবিধ কারণে সৃষ্ট ।
মূলত আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেল ও খাদ্যপণ্যের মূল্যের পরিবর্তন, খাদ্য ও নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের যোগান, অনুৎপাদনশীল খাতে অতিরিক্ত ঋণের প্রবাহ, আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে যুদ্ধ পরিস্থিতি, মন্দা আক্রমণ, আরব বসন্ত, অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা প্রভৃতি কারণে মূল্যস্ফীতির গতিধারা পরিবর্তিত হয়।
১২. বৈদেশিক নির্ভরশীলতা হ্রাস : বাংলাদেশ সরকারের অব্যাহত প্রচেষ্টায় বিগত এক দশকে খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধি, অভ্যন্তরীণ সম্পদ সংগ্রহ জোরদার, রপ্তানিমুখী শিল্প প্রতিষ্ঠা, আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক উন্নয়নের মাধ্যমে দেশীয় স্বার্থকে অগ্রাধিকার দেয়ায় পরনির্ভরশীলতা পূর্বাপেক্ষা হ্রাস পেয়েছে। রপ্তানি আয় পূর্বাপেক্ষা বৃদ্ধি পেয়েছে ও বাণিজ্য ব্যবধান হ্রাস পাচ্ছে। বার্ষিক উন্নয়ন প্রকল্পে বিদেশিদের হস্তক্ষেপ পূর্বাপেক্ষা অনেক হ্রাস পেয়েছে।
১৩. দারিদ্র্যের মাত্রা : স্বাধীনতা অর্জনের পর থেকে এ পর্যন্ত এদেশের দারিদ্র্যক্লিষ্ট মানুষের জীবনযাত্রার মান উন্নয়নের জন্য সরকারের নিরন্তর প্রচেষ্টার ফলে বাংলাদেশের দারিদ্র্যের মাত্রা উল্লেখযোগ্য হারে কমেছে। ষষ্ঠ পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার মধ্যমেয়াদি মূল্যায়ন প্রতিবেদন অনুযায়ী উচ্চ দারিদ্র্য রেখা ব্যবহার করে ২০১১ সালে দারিদ্র্যের হার ২৯.৬৯ শতাংশ থেকে হ্রাস পেয়ে ২০১৫ সালে ২৪.৮ শতাংশে হ্রাস পেয়েছে। বিশ্বব্যাংকের গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত এক দশকে (২০০১-২০১০) বাংলাদেশে দরিদ্র মানুষের সংখ্যা কমেছে প্রায় দেড় কোটি। কিন্তু এর ঠিক আগের দশকে (১৯৯০-২০০০) দরিদ্র মানুষের সংখ্যা কমেছিল মাত্র ২৩ লক্ষ।
গত এক দশকে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি খাতের বিকাশ, আমদানি ও রপ্তানি খাতে কাঠামোগত পরিবর্তন, জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ঝুঁকি মোকাবেলায় সক্ষমতা অর্জনের উদ্যোগ গ্রহণ, বাজেট প্রণয়নে পরনির্ভরশীলতা হ্রাসসহ নানামুখী পরিবর্তন সূচিত হয়েছে।
0 মন্তব্য(গুলি):
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
Comment below if you have any questions