Home » » বাংলাদেশের অর্থনীতির বৈশিষ্ট্য

বাংলাদেশের অর্থনীতির বৈশিষ্ট্য

বাংলাদেশের অর্থনীতির বৈশিষ্ট্য

গ্রামভিত্তিক কৃষিপ্রধান দেশ বাংলাদেশ। স্বাধীনতা-উত্তর তিন দশক পর নতুন সহস্রাব্দে এসেও বাংলাদেশের অর্থনীতিতে তেজিভাব অনুপস্থিত। এখনো উন্নয়নের শ্লোগান শোনা যায়, কিন্তু এর প্রভাবে পুষ্টিহীনতা, দারিদ্র্য, অশিক্ষা, অজ্ঞানতা, বিদেশের উপর নির্ভরশীলতার কাঙ্ক্ষিত উন্নয়ন হয়নি। স্বাধীনতার চার দশক পর বর্তমান বাংলাদেশ একটি সমৃদ্ধ, উন্নত জনপদ হবে এটিই ছিলো প্রত্যাশিত। কিন্তু সে প্রত্যাশা পূরণ হয়নি, তবে বর্তমানে প্রচেষ্টা চলছে। 

নিম্নে বাংলাদেশের অর্থনীতির বৈশিষ্ট্য উপস্থাপন করা হলো :

১. কৃষির অবদান : কৃষি বাংলাদেশের অর্থনীতিতে একক বৃহত্তম খাত। ২০১৪-১৫* সালের হিসাব অনুযায়ী মোট দেশজ উৎপাদনে সার্বিকভাবে কৃষিখাতের (ফসল, প্রাণিসম্পদ, মৎস্য সম্পদ ও বনজ সম্পদ) সমন্বিত অবদান শতকরা প্রায় ১৬.০১ ভাগ। শস্য ও শাকসব্জি, প্রাণিসম্পদ এবং বনজ সম্পদ উপখাতসমূহের সমন্বয়ে কৃষি ও বনজ খাতের অবদান জিডিপিতে ১২.৩২ শতাংশ, মৎস্য খাতের অবদান GDP এর ৩.৬৯ শতাংশ। ২০১৬ সালের [Labour Forch Survey- 2013] সমীক্ষায় দেখা যায়, এখনো দেশের ৪৫.১% জনশক্তি কৃষি ক্ষেত্রে নিয়োজিত ।


২. কৃষির ক্রমোন্নতি : বর্তমানে কৃষি উৎপাদন ব্যবস্থায় আধুনিকায়নের বাতাস বইছে। উৎপাদকগণ পূর্বাপেক্ষা অধিক সচেতন ও দায়িত্ববান। তাই গুরুত্ব অনুভব করে তারা উন্নত বীজ, সার, কীটনাশক, সেচ সুবিধার বন্দোবস্ত করে অধিক উৎপাদনে মনোনিবেশ করছে।


৩. শিল্পের উন্নয়নে কর্মসূচি গ্রহণ : বর্তমানে সরকার শিল্প স্থাপনে অধিক উৎসাহপূর্ণ কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। নতুন উদ্যোক্তা সৃষ্টিতে সরকার সুপরামর্শ, বিনিয়োগ নীতি সহজীকরণ, ট্যাক্স হলিডে ঘোষণা, শিল্প নিরাপত্তা বৃদ্ধি, মূলধনের অবাধ প্রবাহ নিশ্চিতকরণ, বৈদেশিক বিনিয়োগকারীদেরকে আকর্ষণের জন্য নানা প্যাকেজ সুবিধা প্রদান, বিদেশে বাজার সৃষ্টিতে নানা দেশের সাথে বন্ধুত্ব স্থাপন ও চুক্তি সম্পাদন করছে। এর সুফল পাওয়া যাচ্ছে।

আগামী এক দশকের মধ্যে বাংলাদেশে যে শিল্পখাত গড়ে উঠবে তাতে আশা করা যায়, মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপিতে) শিল্প খাতের অবদান ৩০ থেকে ৪০ শতাংশে এবং মোট কর্মরত জনশক্তির হার ৩৫ শতাংশে উন্নীত হবে।


৪. জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার হ্রাস : ১৯৯১ সালের হিসাব অনুযায়ী জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ২.১৭% এবং World Development Report-2014 অনুযায়ী জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার হ্রাস পেয়ে ১.৩% এ উপনীত হয়।

২০১৬ সালের বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সমীক্ষা অনুযায়ী মোট জনসংখ্যা (প্রক্ষেপিত) ১৫৯.৯ মিলিয়ন এবং জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ১.৩৭% উল্লেখ করা হয়।


৫. বেকার সমস্যা : বাংলাদেশে তীব্র বেকার সমস্যা বিরাজমান। জনসংখ্যা বৃদ্ধির তুলনায় বাংলাদেশে সঞ্চয় ও মূলধন গঠনের হার কম। যার ফলে বিনিয়োগ আশানুরূপ নয়। তাই বেকার সমস্যার তেমন উন্নতি হয়নি। তবে বৈদেশিক বিনিয়োগকারিগণ যেহেতু এদেশে বিনিয়োগ করতে আগ্রহ প্রকাশ করছে, সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে EPZ এবং ‘অর্থনৈতিক অঞ্চল' চালু হচ্ছে, ন্যাশনাল সার্ভিস প্রবর্তনের ফলে আশা করা যায় অদূর ভবিষ্যতে এ সমস্যা হ্রাস পাবে। *


৬. মাথাপিছু আয় : World Development Report 2014-এর হিসাব অনুযায়ী বাংলাদেশে মাথাপিছু আয় (GNI) ৮৪০ মার্কিন ডলার। বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সমীক্ষা-২০১৬ অনুযায়ী বাংলাদেশের জনগণের মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি পেয়ে বর্তমানে ১৪৬৬ মার্কিন ডলারে দাঁড়িয়েছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী মাথাপিছু আয় বর্তমানে ১৬০২ মার্কিন ডলার।


৭. জীবনযাত্রার মান : জীবনযাত্রার মান পূর্বাপেক্ষা উন্নত হয়েছে। বা. অর্থ. সমীক্ষা–২০১৬ এর হিসাব অনুযায়ী জীবনযাত্রার মান পূর্বের চেয়ে উন্নত হওয়ায় প্রত্যাশিত গড় আয়ুষ্কাল বৃদ্ধি পেয়ে পুরুষ ৬৯.৯, মহিলা ৭১.৫ ও উভয় ৭০.৭ বছর হয়েছে । নিরাপদ সুপেয় (টিউবওয়েলের) পানি গ্রহণকারী ৯৭.৮%। সাক্ষরতার হার ৬২.৩% ।


৮. প্রাকৃতিক ও মানব সম্পদের ব্যবহার বৃদ্ধি : বর্তমানে প্রাকৃতিক সম্পদ আবিষ্কার ও ব্যবহার পূর্বাপেক্ষা বৃদ্ধি পেয়েছে। তৈল, গ্যাস ও খনিজ সম্পদে সমৃদ্ধ ‘বাংলাদেশ” নামটি পৃথিবীতে যথেষ্ট সুনাম ও পরিচিতি লাভ করেছে। বর্তমানে প্রাকৃতিক গ্যাস বাংলাদেশের মোট বাণিজ্যিক জ্বালানি ব্যবহারের শতকরা প্রায় ৭২ ভাগ পূরণ করে । এছাড়া মানব সম্পদ উন্নয়নের লক্ষ্যে শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ, নারী ও শিশু উন্নয়ন, যুব ও ক্রীড়া উন্নয়নসহ বিভিন্ন কর্মকান্ডে সরকারি ও বেসরকারিভাবে বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করা হয় ।


৯. বিনিয়োগযোগ্য পুঁজি প্রবাহ বৃদ্ধি : বাংলাদেশে বিনিয়োগের পরিমাণও উন্নত দেশের তুলনায় অনেক কম। বর্তমানে দেশে বিনিয়োগ বৃদ্ধির লক্ষ্যে সরকার অনেক উদ্দীপনামূলক, সহযোগিতামূলক নীতি ঘোষণা করেছে। এর ফলে দেশি ও বিদেশি বিনিয়োগকারিগণ আকর্ষিত হয়ে বিনিয়োগের পরিমাণ বৃদ্ধি করছে। ১৯৯৫-৯৬ অর্থবছরে মোট বিনিয়োগের হার ছিল জিডিপির ১৯.৯৯ শতাংশ। পক্ষান্তরে ২০১৫-১৬ অর্থবছরে জাতীয় বিনিয়োগ হার বৃদ্ধি পেয়ে ২৯.৩৮ শতাংশে উন্নীত হয় ।


১০. খাদ্য সমস্যা ও পুষ্টিহীনতা : সবার জন্য খাদ্য নিশ্চিত করার মাধ্যমে বাংলাদেশকে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ করতে কৃষিখাতকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার প্রাপ্ত খাত হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। অধিক জনসংখ্যা কিন্তু সে তুলনায় কৃষি উৎপাদন কম হওয়ায় বাংলাদেশে খাদ্য ও পুষ্টির ঘাটতি বিদ্যমান। বর্তমানে উন্নত সার, বীজ এবং প্রযুক্তি ব্যবহারের ফলে দিন দিন শস্য উৎপাদনের পরিমাণ বৃদ্ধি পাচ্ছে। ২০০৫/২০০৬ অর্থবছরে খাদ্য-শস্য উৎপাদন হয় ২৭২.৬৮ লক্ষ মে. টন পক্ষান্তরে ২০১৪-১৫ সালে খাদ্যশস্যের উৎপাদন ৩৮৪.১৯ লক্ষ মে. টনে উন্নীত হয়। আমাদের দৈনন্দিন খাদ্যে প্রাণিজ আমিষের প্রায় ৬০% আসে মাছ থেকে। সরকারের গৃহীত বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (ADP) মাধ্যমে ধীরে ধীরে খাদ্য সমস্যা ও পুষ্টিহীনতা হ্রাসের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।


১১. অর্থনৈতিক ও সামাজিক অবকাঠামো : বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক অবকাঠামোর উন্নয়ন ধীরে ধীরে প্রসার লাভ করছে।


১২. বৈদেশিক বাণিজ্য : বৈদেশিক বাণিজ্যে পূর্বে প্রচুর ঘাটতি ছিল। বর্তমানে বিভিন্ন বন্ধুদেশে আমাদের দেশের পণ্যদ্রব্যের রপ্তানি বৃদ্ধি পাবার কারণে বাণিজ্য ঘাটতি হ্রাস পাচ্ছে। তবে এখনো বৈদেশিক বাণিজ্য অনুকূলে আসেনি।


১৩. বৈদেশিক সাহায্যের উপর নির্ভরশীলতা : বর্তমানে বৈদেশিক সাহায্যের উপর নির্ভরশীলতার হার হ্রাস পাচ্ছে। প্রথম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় (১৯৭৩-৭৮) অভ্যন্তরীণ সম্পদের যোগান ছিল ২৩ ভাগ এবং চতুর্থ পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় (১৯৯০-৯৫) অভ্যন্তরীণ সম্পদের সমাবেশ করা হয় ৪৮ ভাগ। পঞ্চম-পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় (১৯৯৭-২০০২) অভ্যন্তরীণ সম্পদের সমাবেশ ধরা হয় ৬১.৪৫%। অর্থাৎ বৈদেশিক সাহায্যের উপর নির্ভরশীলতা ক্রমান্বয়ে হ্রাস পাচ্ছে। এটিকে নিজস্ব উৎসের উপর অধিক নির্ভরতার ইতিবাচক অগ্রগতি হিসেবে চিহ্নিত করা যায়।

বিগত একদশকে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে (ADP) গড়ে প্রায় ৫০ শতাংশের মত সম্পদ যোগান দেয়া হয়েছে অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে।


১৪. শিক্ষার হার : দেশে বর্তমানে শিক্ষার হার বৃদ্ধি পেয়েছে। সাক্ষরতার হারও বৃদ্ধি পেয়েছে। ইতোমধ্যে অনেক জেলাকে সরকার ‘নিরক্ষরতা মুক্ত' ঘোষণা করেছে। ২০১৫ সালের হিসাব অনুযায়ী বাংলাদেশে সাক্ষরতার হার ৬৩.৬% এ উন্নীত হয় (বা. অর্থ. সমীক্ষা-২০১৭)।


১৫. সামাজিক কুসংস্কার : বর্তমানে শিক্ষার হার বৃদ্ধির সাথে মানুষের জীবনযাত্রার মানের উন্নতির ফলে সামাজিক নানা কুসংস্কার নিয়ন্ত্রণ হয়েছে। বর্ণবৈষম্য, পর্দা প্রথা, বাল্য ও বহু বিবাহ অনেক হ্রাস পেয়েছে।


১৬. কারিগরি জ্ঞানের প্রসার : দেশে বর্তমানে যুবকদের মধ্যে বৈজ্ঞানিক ও কারিগরি জ্ঞানের যথেষ্ট প্রসার ঘটছে। কম্পিউটার শিক্ষা গ্রহণ করে এর নানামুখী ব্যবহারের প্রতি যুবকদের আগ্রহ বৃদ্ধি পাচ্ছে।


১৭. মুদ্রাস্ফীতি : মুদ্রাস্ফীতির সাথে দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক কর্মকান্ডের একটা ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বিদ্যমান। গত ২০১৩-১৪ অর্থবছরে বার্ষিক গড় মূল্যস্ফীতি ছিল ৭.৩৫ শতাংশ এবং ২০১৪-১৫ (জুলাই-এপ্রিল, ২০১৫) সময়ে এ হার ছিল ৬.৪৫ শতাংশ। এ সময়ে খাদ্য মূল্যস্ফীতির গতি কিছুটা উর্ধ্বমুখী হলেও খাদ্য-বহির্ভূত মূল্যস্ফীতির প্রবণতা নিম্নমুখী ছিল। আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের মূল্যসহ অন্যান্য পণ্যমূল্য হ্রাস পাওয়া এবং অভ্যন্তরীণ উৎপাদন পরিস্থিতি সন্তোষজনক হওয়ায় সার্বিক মূল্যস্ফীতি হ্রাস পেয়েছে। মার্চ, ২০১৬ সময়ে এ হার পয়েন্ট টু পয়েন্ট ভিত্তিতে দাঁড়িয়েছে ৫.৬৫ শতাংশ।


১৮. পরিকল্পনা : সরকার দেশের উন্নয়নের জন্য দেশপ্রেমিক ও দক্ষ পরিকল্পনা প্রণয়নকারীদের সাহায্যে সঠিক বাস্তবানুযায়ী পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়নে সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে সুষ্ঠু সমন্বয় সাধন করছে।


১৯. প্রাকৃতিক দুর্যোগ : ১৯৯৮, ২০০৪-এর বন্যা এবং ২০০৭ সালে দু'বার উপর্যুপরি বন্যা ও ঘূর্ণিঝড় “সিডর”, ২০০৯ সালে দক্ষিণাঞ্চলে ঘূর্ণিঝড়সহ প্রভৃতি প্রাকৃতিক দুর্যোগ দেশের জনগণ সাহসিকতার সাথে মোকাবিলা করেছে। দুর্যোগ মোকাবিলায় নিজস্ব সম্পদের উপর নির্ভরশীলতা বৃদ্ধি পেয়েছে।


২০. দক্ষ উদ্যোক্তা সৃষ্টি : বর্তমানে আমাদের উৎপাদিত অনেক পণ্যদ্রব্য বিশ্ব বাজারে প্রবেশ করেছে। দেশীয় দক্ষ উদ্যোক্তার সংখ্যা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে।


২১. দারিদ্র্য বিমোচন : দারিদ্র্য বিমোচন তথা অর্থনৈতিক উন্নয়ন বহুমাত্রিক জটিল ও বিরাট চ্যালেঞ্জ। এ লক্ষ্যে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি উচ্চহারে বৃদ্ধিসহ সামগ্রিক অর্থনৈতিক কর্মকান্ডে দরিদ্রদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করে সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে বিভিন্ন কর্মসূচি নেয়া হয়েছে ও হচ্ছে। ফলে তাদের মাথাপিছু আয় ও ভোগ বৃদ্ধি পাচ্ছে।


২২. বেসরকারিকরণ : দেশের সার্বিক অর্থনৈতিক উন্নয়নের স্বার্থে বেসরকারি খাতের তৎপরতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে বেসরকারি খাত উন্নয়নকে বিশেষ গুরুত্ব প্রদান করা হয়েছে। এ উদ্দেশ্যে বিভিন্ন নীতি ও সংস্কার কর্মসূচি হাতে নেয়া হয়েছে। দেশের বর্তমান শিল্পনীতি, বাণিজ্যনীতি এবং ষষ্ঠ পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় এ খাত উন্নয়নের বিষয়টি প্রতিফলিত হয়েছে। মুক্ত বাজার অর্থনীতিতে বেসরকারি খাতকে উন্নয়নের মূল চালিকাশক্তি হিসেবে গণ্য করা হয়। এ লক্ষ্যে বেসরকারিকরণ কমিশন গঠন করা হয়েছে। ১৯৯৩ সাল থেকে ফেব্রুয়ারি ২০১৬ পর্যন্ত মোট ৮১টি প্রতিষ্ঠান বেসরকারিকরণ করা হয়েছে। এর মধ্যে ৫৮টি প্রতিষ্ঠান সরাসরি বিক্রির মাধ্যমে এবং ২৩টি প্রতিষ্ঠান/কোম্পানির শেয়ার বিক্রির মাধ্যমে বেসরকারিকরণ করা হয়েছে। বর্তমানে প্রাইভেটাইজেশন কমিশন কর্তৃক ১৫টি প্রতিষ্ঠান বেসরকারিকরণের কাজ চলছে।


২৩. আর্থিক খাত সংস্কার : দেশের অর্থনৈতিক কর্মকান্ডে আর্থিক খাতের অধিকতর কার্যকর ভূমিকা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে ১৯৯৬ সালের ডিসেম্বরে সমাপ্ত আর্থিক খাত সংস্কার কর্মসূচির আওতায় গৃহীত পদক্ষেপসমূহের বাস্তবায়ন ২০০১/২০০২ অর্থবছরেও অব্যাহত ছিল। বর্তমানে এ সংস্কার কর্মসূচিকে আরও সময়োপযোগী করা হয়েছে। প্রত্যাশিত আর্থ-সামাজিক প্রবৃদ্ধি অর্জনে আর্থিক খাতের ভূমিকা বৃদ্ধির লক্ষ্যে বহুবিধ উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। যেমন—

(i) টাকার বাজারভিত্তিক ভাসমান বিনিময় হার চালু করা হয়েছে।

(ii) ঋণ বাজারে উচ্চ ‘সুদ হারের জড়তা' (interest rate rigidity) নিরসন করে সুদ হার নিম্নমুখী করার বিশেষ উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। উৎপাদনশীল খাতে ঋণ প্রবাহ বৃদ্ধি এবং আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে আরো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালনের লক্ষ্যে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানসমূহকে সুদের হার যুক্তিসঙ্গত পর্যায়ে নির্ধারণের জন্য উৎসাহিত করা হচ্ছে।

(iii) ব্যাংকিং খাতকে আরও শক্তিশালী করে একে আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতামূলক স্তরে উন্নীত করা এবং মূলধন সংরক্ষণ আরও ঝুঁকি-সহনশীল ও সুদৃঢ় করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে ।

(iv) বাংলাদেশ ব্যাংক আধুনিকীকরণ, সার্বভৌম ঋণমান নির্ধারণ, মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ আইন, ২০১২; মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ বিধিমালা, ২০১৩; অর্থ ঋণ আদালত আইন; সন্ত্রাস বিরোধী (সংশোধন) আইন, ২০১৩; আর্থিক গোয়েন্দা ইউনিট (FIU) চালু করা হয়েছে। এছাড়া বাণিজ্যিক ব্যাংকসমূহের ন্যূনতম মূলধন এর পাশাপাশি আপৎকালীন মূলধন সংরক্ষণ নীতিমালাও চালু করা হয়েছে।

(গ) আন্তর্জাতিক মানদন্ডের আলোকে FIU কে শক্তিশালীকরণের লক্ষ্যে ব্যাংকসমূহের নগদ লেনদেন প্রতিবেদন এবং সন্দেহজনক লেনদেন প্রতিবেদনের অনলাইন রিপোর্টিং ও বিভিন্ন রিপোর্টিং সংস্থা হতে প্রাপ্ত সন্দেহজনক লেনদেন প্রতিবেদন কার্যকর বিশ্লেষণের লক্ষ্যে United Nations Office on Drugs and Crime (UNODC) হতে ক্রয়কৃত ‘go AML' Softwareটির কার্যক্রম শুরু হয়েছে।

(vi) এছাড়াও বিমা আইন, ২০১০; বিমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ আইন, ২০১০ এবং পুঁজিবাজারকে গতিশীল ও সমৃদ্ধ করার লক্ষ্যে পুঁজিবাজার পুনর্গঠনে নানাবিধ পদক্ষেপ উল্লেখযোগ্য। যেমন সকল শেয়ারের অভিহিত মূল্য ১০ টাকা করা হয়েছে, পরিচালকদের ক্ষেত্রে সম্মিলিতভাবে পরিশোধিত মূলধনের ৩০ শতাংশ এবং এককভাবে ২ শতাংশ শেয়ার ধারণ বাধ্যতামূলক এবং ঋণ-সীমা পুনঃনির্ধারণ প্রভৃতি।

সরকার সংস্কার কর্মসূচিতে আইনগত সংস্কার, আর্থিক বুনিয়াদ আরও শক্তিশালী করার লক্ষ্যে তহবিল ও তারল্য ব্যবস্থাপনা উন্নয়ন, ব্যাংকসমূহের পরিচালন দক্ষতা বৃদ্ধিসহ পুঁজি বাজার উন্নয়নে বহুমুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। এর ফলে আর্থিক খাতে ঋণ ঝুঁকি (Credit risk), বাজার ঝুঁকি (market risk) ও পরিচালনা ঝুঁকি (Operational risk) মোকাবিলা করা সম্ভব হবে।


২৪. রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা : বাংলাদেশে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার যথেষ্ট অভাব রয়েছে। এ কারণে সঠিক উন্নয়ন পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন সম্ভব হচ্ছে না। রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বিদ্যমান থাকলে উন্নয়নের গতি দ্রুত হওয়ার মাধ্যমে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছানো সহজ হতো।


২৫. সামাজিক নিরাপত্তামূলক খাত : সরকার জনকল্যাণে, দরিদ্রতা লাঘবে বিভিন্ন কর্মসূচি বাস্তবায়ন করছে; যেমন : (i) দরিদ্র বয়োজ্যেষ্ঠদের জন্য বয়স্ক ভাতা।

(ii) গৃহহীন দরিদ্রদের ঋণ ও অনুদান প্রদানের জন্য গৃহায়ণ তহবিল গঠন ।

(iii) সামাজিক সুরক্ষার আওতায় গর্ভধারিণী হতদরিদ্র মা'কে প্রতি মাসে ভাতা প্রদান ।

(iv) দেশে বেকার যুবকদের ‘কর্মসংস্থানের লক্ষ্যে কর্মসংস্থান ব্যাংক' স্থাপন এবং ন্যাশনাল সার্ভিস প্রবর্তনসহ নানা আত্মকর্মসংস্থানমূলক প্রকল্প গ্রহণ ।

এছাড়াও, বিধবা ও স্বামী পরিত্যক্তা মহিলাদের জন্য দুস্থ মহিলা ভাতা, দরিদ্র জনগণের জন্য গৃহায়ণ কর্মসূচি, আশ্রয়ন আবাসন প্রকল্প, এসিডদগ্ধ ও শারীরিক প্রতিবন্ধীদের জন্য বিশেষ কার্যক্রম ক্ষুদ্রঋণ কর্মসূচি, অসচ্ছল মুক্তিযোদ্ধা ও তাঁদের পোষ্যদের জন্য প্রশিক্ষণ কর্মসূচি, পথশিশু, এতিম শিশুদের উন্নয়নে তহবিল বরাদ্দ; ভিক্ষুক পুনর্বাসন ও কর্মসংস্থানমূলক প্রকল্প গ্রহণ, ঘরেফেরা কর্মসূচি, খাদ্য নিরাপত্তা কর্মসূচি, প্রাকৃতিক দুর্যোগজনিত ঝুঁকি মোকাবিলা এবং দরিদ্র ও নিম্ন আয়ের জনগণের মাঝে রেশনিং প্রথা চালু প্রভৃতি সরাসরি দারিদ্র্য বিমোচনে সামাজিক নিরাপত্তামূলক উদ্যোগ হিসেবে বিবেচিত।


উপরিউক্ত আলোচনার প্রেক্ষিতে সিদ্ধান্ত নেয়া যায় যে, গত চার দশকে বাংলাদেশের কৃষি জমির পরিমাণ হ্রাস পেলেও ফলন অনেক বেড়েছে, জনসংখ্যা অনেক বাড়লেও মাথাপিছু আয়ু, গড় আয়ু, জীবনযাত্রার মান, শিল্পায়ন অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে, বেকারত্ব হ্রাস পেয়েছে। দেশজ উৎপাদনে শিল্প ও সেবাখাতের অবদান কৃষি অপেক্ষা বৃদ্ধি পেয়েছে। অর্থাৎ বাংলাদেশের অর্থনীতি স্থবির নয় আবার উন্নতও নয়। গতিশীল কর্মসূচি গ্রহণ ও বাস্তবায়ন হচ্ছে। তাই বলা যায়, বাংলাদেশের অর্থনীতিতে কাঠামোগত পরিবর্তন (পরিমাণগত ও গুণগত কাঙ্ক্ষিত অর্থনৈতিক পরিবর্তন) সাধিত হচ্ছে। এ কারণে বাংলাদেশকে উন্নয়নশীল দেশ বলাই অধিক যুক্তিযুক্ত।


জাতিসংঘে বাংলাদেশের অন্তর্ভুক্তির ২৫তম বার্ষিকী উপলক্ষে দেওয়া এক বাণীতে তৎকালীন জাতিসংঘ মহাসচিব কফি আনান বলেন, “বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশগুলোর কাছে এ উদাহরণ তুলে ধরতে পেরেছে যে, শুধুমাত্র মাথাপিছু মোট জাতীয় উৎপাদন (GNP) বৃদ্ধিই উন্নয়ন নয়, বরং শিক্ষা, গণতন্ত্র, মানবাধিকার এবং দরিদ্র জনগোষ্ঠীর আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকারও উন্নয়নের অন্তর্ভুক্ত।”


তিনি আনন্দের সাথে আরও বলেন, “বাংলাদেশের মতো একটি দেশকে যেকোনো আন্তর্জাতিক সংস্থাই সদস্য হিসেবে পেতে আগ্রহী হবে।”

0 মন্তব্য(গুলি):

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Comment below if you have any questions

Contact form

নাম

ইমেল *

বার্তা *