Home » » বাংলাদেশের শিল্প খাত

বাংলাদেশের শিল্প খাত

বাংলাদেশের শিল্প খাত

বাংলাদেশ একটি কৃষি নির্ভর উন্নয়নশীল দেশ। তবে কৃষি প্রধান হলেও শিল্পে গুরুত্ব অপরিসীম। কারণ এ দেশের কৃষিকাজ প্রাচীন ও অনুন্নত। একমাত্র কৃষির উপর নির্ভর করে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বস্ত্র, বাসস্থান ও বেকারত্ব সহ সকল সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়। তাই এ ক্ষেত্রে শিল্পের গুরুত্ব অপরিসীম। তাছাড়া পৃথিবীর উন্নত দেশসমূহ যেমন ইংল্যান্ড, কানাডা, জাপান, আমেরিকা ইত্যাদি দেশের উন্নয়নের মূলে রয়েছে দ্রুত শিল্পয়ান। বাংলাদেশের শিল্পের আকার ও গঠন কাঠামো নিচে ব্যাখ্যা করা হল:


(ক) আকার অনুযায়ী শিল্পের শ্রেণীবিভাগ (Classification of industry according to size): 

বাংলাদেশের শিল্পসমূহ আকার অনুযায়ী বা আকারের ভিত্তিতে মূলত তিন প্রকার। নিচে এগুলো ব্যাখ্যা করা হল:


১। বৃহৎ শিল্প (Large scale industries): বৃহৎ শিল্প বলতে বড় শিল্প বোঝায় অর্থাৎ যে শিল্পে অধিক মূলধন, অনেক শ্রমিক ও প্রচুর পরিমান কাঁচামাল ব্যবহার করে আধুনিক তথা উন্নত প্রযুক্তির সাহায্যে বিপুল পরিমাণ দ্রব্য সামগ্রী উৎপাদন করা হয় তাকে বৃহৎ অথবা বৃহদায়তন শিল্প বলা হয়। এখানে উল্লেখ্য বাংলাদেশ শিল্প আইন অনুযায়ী যে শিল্প কারখানায় ২৩০ জনের অধিক শ্রমিক কাজ করে তাকে বৃহৎ শিল্প বলে। পাট, বস্ত্র, সিমেন্ট, কাগজ, সার ইত্যাদি বাংলাদেশের শিল্পের উদাহরণ।


২। মাঝারি শিল্প (Medium scale industries): বাংলাদেশে শিল্প আইন বা কারখানা আইন অনুযায়ী যে কারখানায় ২০ জনের বেশি কিন্তু ২৩০ জনের কম শ্রমিক নিয়োজিত আছে তাকে মাঝারি শিল্প বলে। মাঝারি শিল্প মূলতঃ বৃহৎ ও ক্ষুদ্রশিল্পের মাঝামাঝি অবস্থান করে। মাঝারি শিল্প, বৃহৎ শিল্পের ন্যায় উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করে। তবে মূলধন তুলনামূলক ভাবে বৃহৎ শিল্প অপেক্ষা কম ব্যবহার করে। বাংলাদেশে বহু সংখ্যক মাঝারি শিল্প গড়ে উঠেছে এবং উঠছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো চামড়া শিল্প, সিগারেট শিল্প, সাবনশিল্প, দিয়াশলাই শিল্প ইত্যাদি।


৩। ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প (Small and cottage industries): সাধারণ অর্থে ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প একই অর্থে ব্যবহৃত হয় তবে সুক্ষ্ম অর্থে এ দুয়ের পার্থক্য আছে। বাংলাদেশে কারখানা ও শিল্প আইন অনুযায়ী যে কারখানায় সর্বোচ্চ ২০ জন শ্রমিক কাজ করে তাকে ক্ষুদ্র বা কুটির শিল্প বলে। তবে এখানে উল্লেখ্য ক্ষুদ্র শিল্পে ভাড়া করা শ্রমিক ও বিদ্যুৎ ব্যবহৃত হয়। তাছাড়া ক্ষেত্রবিশেষে উন্নত প্রযুক্তিও ব্যবহার হয়।


কুটির শিল্প মূলত পারিবারিক শ্রমিক দ্বারা পরিচালিত হয় এবং বিদ্যুৎ ব্যবহৃত হয় না। মোট কথা স্থানীয় কাঁচামাল কম মূলধন ও পারিবারের সদস্য দ্বারা কুটির শিল্প বিভিন্ন দ্রব্য উৎপাদন করে থাকে। বাংলাদেশে তাত শিল্প, বাঁশ ও বেত শিল্প, বিড়ি শিল্প, লবন শিল্প ইত্যাদি হল কুটির শিল্প ।


(খ) কাঠামো অনুযায়ী শিল্পের শ্রেণী বিভাগ (Classification of industry according to structure): 

কাঠামো অনুযায়ী বাংলাদেশের শিল্পসমূহকে তিন ভাগে ভাগ করা যায় । 

নিচে এগুলো ব্যাখ্যা করা হল:

১। ভোগ্য দ্রব্য শিল্প: সে সব শিল্পকারখানা সরাসরি মানুষের ভোগ উপযোগী দ্রব্য তৈরি করে তাকে ভোগ্য দ্রব্য শিল্প বলে। যেমন- সাবান শিল্প, চিনি শিল্প, সিগারেট শিল্প ইত্যাদি। বাংলাদেশ একটি অতিরিক্ত জনসংখ্যার দেশ। তাই এখানে ভোগ্য শিল্পের গুরুত্ব অত্যাধিক।


২। মাধ্যমিক দ্রব্য শিল্প: যে সকল উৎপাদিত পণ্য পুনরায় অন্য দ্রব্য উৎপাদনে ব্যবহৃত হয় তাকে মাধ্যমিক দ্রব্য বলে। আর এই মাধ্যমিক দ্রব্য যে সকল কারখানায় তৈরি হয় তাকে মাধ্যমিক দ্রব্য শিল্প বলে । যেমন- সুতা একটি উৎপাদিত দ্রব্য যা বস্ত্র শিল্পে উপকরণ হিসেবে ব্যবহৃত হয়। তাই সুতা শিল্পকে মাধ্যমিক শিল্প বলে ।


৩। মূলধনী দ্রব্যের শিল্প: বাংলাদেশে মূলধনী বা ভারী শিল্প নেই বললেই চলে। তবে একটি দেশের অর্থনীতির ভিত্তি মজবুত করতে হলে অবশ্যই প্রয়োজন মূলধনী শিল্প। মূলধনী দ্রব্য যে কারখানায় তৈরি হয় তাকে মূলধনী শিল্প বলে। যেমন- জয়দেবপুর মেশিন ও টুলস ফ্যাক্টারী, চিটাগাং স্টিল মিল ইত্যাদি।


বাংলাদেশে শিল্পের কাঠামোগত বৈশিষ্ট্য

বাংলাদেশে শিল্পসমূহের কাঠামোগত বৈশিষ্টগুলো নিচে ব্যাখ্যা করা হল :

১। বস্ত্র শিল্পের প্রাধান্য: বাংলাদেশের শিল্পখাতে প্রধান শিল্প হল বস্ত্র শিল্প। বস্ত্র শিল্প আমাদের বস্ত্রের অভ্যন্তরীন চাহিদার প্রায় দুই তৃতীয়াংশ মিটাতে সক্ষম। মূল্য সংযোজনের বিচারে বৃহত্তম দশটি শিল্পের মধ্যে পাঁচটি বস্ত্র শিল্প । এ বস্ত্ৰ শিল্প দ্বারা মোট শিল্পখাতে মূল্য সংযোজনের ৪৪% এবং কর্মসংস্থানের ৪৫% সৃষ্টি হয়। আমাদের পাঁচটি গুরুত্বপূর্ণ বস্ত্ৰ শিল্প হল হ্যান্ডলুম পাট বস্ত্র, তৈরি পোশাক এবং বুনন ও হোসিয়ারি বস্ত্র শিল্প।


২। হস্তচালিত তাঁত শিল্পের প্রাধান্য: বাংলাদেশে কর্মসংস্থান সৃষ্টি এবং মূল্য সংযোজনে হস্তচালিত তাঁত শিল্পের সর্বাধিক গুরুত্ব রয়েছে। শিল্পখাতে মোট কর্মসংস্থানের এক চতুর্থাংশ থেকে বেশি কর্মসংস্থান হস্তচালিত তাঁত শিল্পের মাধ্যমে সৃষ্টি হয় ।


৩। পাট বস্ত্র শিল্পের গুরুত্ব: বাংলাদেশে বৃহদায়তন শিল্পের মধ্যে অন্যতম প্রধান শিল্প হল পাট ও বস্ত্র শিল্প। পাট সরকারি রাজস্বের একটি অন্যতম উৎস। বৃহদায়তন শিল্প উপখাতে মূল্য সংযোজনের এক চতুর্থাংশ এবং মোট কর্মসংস্থানের এক-তৃতীয়াংশ থেকে বেশি পাট বস্ত্র শিল্পে হয়ে থাকে। ২০০০-২০০১ সালের প্রথম নয় মাসে পাটজাত দ্রব্য রপ্তানি থেকে বৈদেশিক মুদ্রায় বাংলাদেশের আয়ের পরিমাণ ছিল ১৬ কোটি ৭০ লক্ষ মার্কিন ডলার।


৪। দ্বৈততা: বাংলাদেশের শিল্পকাঠামোতে এক ধরনের দ্বৈততা বিরাজ করছে। বৃহদায়তন শিল্প অধিক মূল্য সংযোজন করলেও কর্মসংস্থান যোগাচ্ছে কম। আবার, ক্ষুদ্রায়তন শিল্পগুলো কর্মসংস্থান বেশি সৃষ্টি করলেও মূল্য সংযোজন করছে কম।


৫। পোশাক শিল্পের দ্রুত প্রসার: পোশাক শিল্প বর্তমানে বাংলাদেশের শিল্পক্ষেত্রে এক নতুন সম্ভবনার দিগন্ত উম্মোচন করেছে। স্বাধীনতার পর এ শিল্পটির ব্যাপারে প্রথমে চিন্তাভাবনা শুরু হয়। বর্তমানে বাংলাদেশে প্রায় পাঁচ হাজার তৈরি পোশাক কারখানা রয়েছে। এ সব কারখানায় প্রায় ১৫ লক্ষ শ্রমিক কর্মরত রয়েছে। বর্তমানে এটি বৃহত্তম রপ্তানী মূখী শিল্প ।


৬। শ্রমঘন শিল্পের প্রধান্য: বাংলাদেশের সার ও পেট্রোলিয়াম শোধন শিল্প ছাড়া অন্যান্য সকল গুরুত্বপূর্ণ শিল্প শ্রমঘন প্রযুক্তি ব্যবহার করে। আমাদের শিল্পখাত মূলত ভোগ্যপণ্য উৎপাদনে নিয়োজিত রয়েছে। ভারি শিল্পের অভাবে বাংলাদেশে মূলধন নিবিড় প্রযুক্তির ব্যবহার খুবই কম।


৭। কর্মসংস্থান সৃষ্টি: বাংলাদেশে বৃহদায়তন শিল্পে দেশের মোট শিল্পোৎপাদনের সিংহভাগ উৎপাদিত হলেও এখানে কর্মসংস্থানের পরিমান কম। পক্ষান্তরে, বাংলাদেশের ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পের উৎপাদনের পরিমান কম হলেও কর্মসংস্থানের পরিমান বেশি। দেশের শ্রম শক্তির প্রায় ৮৭ শতাংশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পে নিয়োজিত রয়েছে। যদিও এখানে মোট উৎপাদন ক্ষমতা বাংলাদেশের মোট শিল্পোৎপাদনের ১৮ শতাংশ মাত্র।


পরিশেষে বলা যায় যে বাংলাদেশের মোট শিল্পকাঠামো খুবই দূর্বল। আমরা এখানে শ্রম নিবিড় প্রযুক্তির সাহায্যে ভোগ্য পণ্য উৎপাদনে নিয়োজিত রয়েছি। তাই শিল্প উন্নয়নের গতিকে তরান্বিত করার জন্য আমাদের শ্রম নিবিড় পন্য উৎপাদনের পাশাপাশি মূলধন নিবিড় পন্য উৎপাদনে এগিয়ে আসছে। কেননা স্বনির্ভর শিল্পোন্নয়নের জন্য ভারী শিল্পের উন্নয়ন একটি অপরিহার্য শর্ত।

0 মন্তব্য(গুলি):

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Comment below if you have any questions

Contact form

নাম

ইমেল *

বার্তা *