রাখাইন উপজাতি
সমতলে বসবাসকারী ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীসমূহের মধ্যে রাখাইন অন্যতম। তবে পাহাড়ের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী মারমাদের সাথে ভাষা নৃতাত্ত্বি সাদৃশ্য রয়েছে । মারমারা যেমন ‘মগ' নামে পরিচিত, তেমনি রাখাইনরাও। প্রাচীনকালে এরা ‘মগধ’ রাজ্যে বসবাস করত বলে ইতিহাসে এরা 'মগ' নামে পরিচিতি লাভ করে। রাখাইন শব্দের উৎপত্তি পালি ভাষা থেকে। এ ভাষায় ‘রাখাইন’ শব্দের অর্থ হল রক্ষণশীল অর্থাৎ যারা নিজেদের ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, পরিচয় ইত্যাদিকে সংরক্ষণ করতে সচেষ্ট থাকে। সম্প্রদায়গত দিক থেকে থেকে রাখাইনরা অনেকটা রক্ষণশীল । রাখাইনরা নিজেদেরকে ‘রাক্ষাইন' এবং তাদের বাসভূমিকে ‘রাক্ষাইন পি’ (রাখাইন ভূমি) নামে অভিহিত করে। এর ভাবার্থ হচ্ছে, তারা তাদের সংস্কৃতি, ঐতিহ্য এবং ভূমি সংরক্ষণের জন্য প্রতিজ্ঞাবদ্ধ ।
নৃতাত্ত্বিক পরিচয়, ভাষা ও আবাস:
রাখাইনদের ইতিহাস ও ঐতিহ্য অনেক প্রাচীন এবং সমৃদ্ধ । তারা ‘মগধ’ রাজ্য থেকে মায়ানমারের আরাকান রাজ্যে বসবাস শুরু করে। ১৭৮৪ সালে বার্মিজ রাজা ‘বোদোপ্রা' আরাকান রাজ্য জয় করলে বিপুলসংখ্যক রাখাইন সেখান থেকে পালিয়ে বাংলাদেশের উপকূলীয় জেলা পটুয়াখালী এবং কক্সবাজারে আশ্রয় নেয়। রাখাইনরা মঙ্গোলীয়দের ভোটবার্মি (Bhotbormi) সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত। রাখাইনদের মুখমণ্ডল গোলাকার, নাক বোঁচা, চুলকালো এবং দেহের রং হালকা বাদামি ও উচ্চতায় খাটো।
রাখাইনদের ভাষা ভোটবার্মি দলের ভাষার অন্তর্ভুক্ত। উত্তর ভারতের আদি ব্রাহ্মীলিপি থেকে রাখাইন বর্ণমালার উৎপত্তি। রাখাইনরা কয়েক হাজার বছর আগে মগধে মৌখিকভাবে এই ভাষার উৎপত্তি ঘটায় বলে ধারণা করা হয়। প্রায় ছয় হাজার বছর আগে পাথরে খোদাই করা শিলালিপিতে রাখাইন বর্ণমালা পাওয়া যায়। এটি প্রথম রাখাইন বর্ণমালার উদ্ভবের দলিল বাংলাদেশের রাখাইনরা বাংলা ভাষায়ও পারদর্শী।
বাংলাদেশের কক্সবাজার, পটুয়াখালী ও বরগুনা জেলায় তাদের বসবাস। পটুয়াখালির কুয়াকাটা ও খেপুপাড়ায় রাখাইনদের বসতি রয়েছে।। কক্সবাজারের রামু, পার্বত্য চট্টগ্রামের বান্দরবান, মানিকছড়ি, টেকনাফ ও চট্টগ্রামের সাতকানিয়া উপজেলাতেও রাখাইনদের বসতি লক্ষ করা যায়।
অর্থনীতি, ধর্ম ও সংস্কৃতি:
রাখাইনদের প্রধান পেশা কৃষি ও মৎস্য শিকার। এছাড়া তারা ব্যবসা-বাণিজ্য, তাঁত বুনন, নৌকা নির্মাণ ও অন্যান্য কারিগরি পেশার মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করে। হস্তচালিত তাঁত থেকে কাপড় বোনার কাজে রাখাইনরা দক্ষ। রাখাইনরা লবণ এবং গুড় তৈরি করে। কৃষিকাজে রাখাইন নারী-পুরুষ উভয়েই অংশ গ্রহণ করে । রাখাইন নারীরা পোল্ট্রি ও গৃহপালিত পশু পালনও করে থাকে ।
রাখাইনরা বৌদ্ধ ধর্মালম্বী। ধর্মীয় এবং ভাষাগত জ্ঞানের জন্য বৌদ্ধ মন্দিরে যায়। বৌদ্ধ পাঠশালা বা খ্যাং (khyang/ Monastery) এ রাখাইন শিশুদের শিক্ষা জীবন শুরু হয়। বৌদ্ধ ধর্মের পাশাপাশি রাখাইনরা যাদুবিদ্যা, অতিপ্রাকৃতিক শক্তি এবং নানাবিধ কুসংস্কারে বিশ্বাসী। তারা ধর্মীয় বিভিন্ন আচার-অনুষ্ঠান ও উৎসব উদযাপন করে থাকে। গৌতম বুদ্ধের জন্মবার্ষিকী ও প্রবারণা পূর্ণিমা উদযাপন রাখাইন অনুষ্ঠানসমূহের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ।
রাখাইন সমাজের রীতি অনুযায়ী বিশেষ কোনো অনুষ্ঠান বা দিবসের শুরুতে তারা পিতা-মাতা, বয়স্ক ব্যক্তি এবং বুদ্ধের প্রতি সম্মান ও শ্রদ্ধা নিবেদন করে থাকে। বিভিন্ন উৎসব অনুষ্ঠানে তারা বিভিন্ন নকশা করা পিঠা ও মিষ্টি জাউ-ভাত (Prorridge) পরিবেশন করে থাকে। ধর্মীয় অনুষ্ঠানের বাইরে রাখাইনদের নিজস্ব আচার-অনুষ্ঠান ও উৎসব রয়েছে। রাখাইনদের সবচেয়ে বড় উৎসবকে হচ্ছে জলকেলি উৎসব। এপ্রিল মাসে নববর্ষের প্রাক্কালে চৈত্র সংক্রান্তি উপলক্ষে তিন দিন ধরে এ উৎসব উদযাপন করা হয়। তারা বসন্ত উৎসবও পালন করে থাকে।
শিল্পকলা ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রে রাখাইনদের সুপ্রাচীন ঐতিহ্য রয়েছে। স্থাপত্যকলা, চারু ও কারুকলা, চিত্রকলা, ভাস্কর্য, নাটক, সংগীত, নৃত্যকলা ইত্যাদিতে রাখাইন জনগোষ্ঠীর ঐতিহ্য সমৃদ্ধ। নদীর তীরবর্তী অঞ্চল ও সমুদ্র উপকূলের সমতল ভূমিতে রাখাইনরা বসবাস করে। নিচে খালি রেখে উঁচু ভিত বা মাচার উপর ঘর নির্মাণ করে তারা বসবাস করে। ঘর তৈরির উপকরণ হিসেবে তারা গোলপাতা, টিন প্রভৃতি ব্যবহার করে ।
খাদ্য, পোশাক, পরিবার ও বিবাহ:
রাখাইনরা সাধারণত ভাত, মাছ, ডাল এবং শাক সবজি খেয়ে থাকে। শূকর এবং শুটকি মাছ তাদের প্রিয় খাবার। রাখাইন পুরুষেরা সাধারণত লুঙ্গি ও ফতুয়া পরে থাকে। রাখাইনরা বিভিন্ন ধর্মীয় এবং সামাজিক অনুষ্ঠানে মাথায় পাগড়ি পরে। রাখাইন নারীরা নকশাকৃত লুঙ্গি এবং ব্লাউজ পরিধান করে। রাখাইন নারীরা তাদের শরীরে বিভিন্ন ধরনের অলংকার এবং চুলে ফুল পরে থাকে ।
বিবাহ রাখাইন সমাজের গুরুত্বপূর্ণ ধর্মীয় ও সামাজিক প্রতিষ্ঠান। সাধারণত অভিভাবকেরাই বিবাহ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে থাকেন। তবে বর্তমানে প্রেমের বিয়েও এ সমাজে দেখা যায়। যৌতুক প্রথা রাখাইন সমাজে নিষিদ্ধ। রাখাইন পরিবার ব্যবস্থা পিতৃতান্ত্রিক । পিতাই পরিবারের প্রধান। পরিবারে নারী-পুরুষ প্রত্যেকেরই সমান অধিকার রয়েছে। পুত্র এবং কন্যা উভয়েরই পৈতৃক সম্পত্তিতে সমান অধিকার দেওয়া হয়েছে।
0 মন্তব্য(গুলি):
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
Comment below if you have any questions