বলশেভিক বিপ্লবের ফলাফল
আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে অনেকগুলো কারণ সামনে রেখেই সংঘটিত হয়েছিল বলশেভিক বিপ্লব। বিশেষ করে ২০ শতকের শুরুতে রাশিয়ায় শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণির বিকাশ ঘটে। তারা পশ্চিম ইউরোপের আদলে আধুনিক প্রতিনিধিত্বমূলক শাসনতন্ত্র তথা প্রতিনিধিত্বমূলক জাতীয় পরিষদ, দায়িত্বশীল মন্ত্রিসভা, নাগরিক স্বাধীনতা, সমাজে সমাধিকার, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা প্রভৃতি দাবি করে বসে। এদিকে গণমানুষের ধর্মের স্বাধীনতা, শিক্ষার সুযোগ, দায়িত্বশীল প্রশাসনিক কাঠামোর বিকাশ প্রভৃতি নিয়ে আন্দোলন তুঙ্গে ওঠে। যারা সমাজ সংস্কার ও গণমানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে একটি আধুনিক রাশিয়া নির্মাণ করতে চেয়েছিল খড়গহস্তে তাদের উপর উন্মত্ত হয় রুশ সম্রাট দ্বিতীয় নিকোলাস এবং তাঁর অত্যাচারী মন্ত্রী প্লিভি। তারা প্রগতিশীলদের দাবির বিরুদ্ধে কঠোর নীতি গ্রহণ করে আন্দোলনের উত্তাপ আরো কয়েকগুণ বাড়িয়ে তোলে ।
১৯০৫ সালে রুশ-জাপান যুদ্ধে জাপানের কাছে শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয় রাশিয়া। এ পরাজয় জার শাসনের বিরুদ্ধে দেশকে উত্তাল করে তোলে। বলশেভিক পার্টির নেতৃত্বে রাশিয়ার শ্রমিক ও কৃষক সমাজের এ সময় তুমুল আলোড়ন তুলতে সক্ষম হয় দেশব্যাপী। তাদের ব্যাপক আন্দোলনের মুখে পরিস্থিতি অনেকটা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। তখন জার দ্বিতীয় নিকোলাস রাশিয়ার জাতীয় পরিষদ ডুমার অধিবেশন আহ্বান করেন। এখানে পরিস্থিতির দায় বুঝে জারের পক্ষ থেকে মধ্যবিত্ত শ্রেণির বেশ কয়েকটি দাবি মেনে নিতে দেখা যায়। এক্ষেত্রে মধ্যবিত্ত শ্রেণি কিছুটা সামাজিক সুবিধা অর্জন করলেও শ্রমিক, কৃষক ও মেহনতী মানুষ তাদের ভাগ্যবদল করতে পারেনি। বাস্তবে তাদের মূল রাজনৈতিক লক্ষ্য অপূরণীয় থেকে যায়।
পোল্যান্ড থেকে রাশিয়ার সেনা বিতাড়ন জার্মানির কাছে কচুকাটা হয়ে লেজ গুটিয়ে পালানো রাশিয়ার জনমনে ধিক্কার ও ঘৃণার প্রহর আরো প্রলম্বিত করে। সাধারণ মানুষ প্রথম বিশ্বযুদ্ধে রাশিয়ার এ সামরিক বিপর্যয়ের জন্য পুরোপুরি জারকে দায়ি করে তাঁর প্রতি বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। এদিকে রাশিয়াজুড়ে তীব্র অর্থনৈতিক সংকট ও খাদ্যের অভাব মানুষকে এনে দাঁড় করায় জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে। তারা জীবন বাঁচানোর দায় এবং গণমুক্তির আশায় দেশজুড়ে গণঅভ্যুত্থান ঘটাতে ব্রতী হয়। এসময় নানাস্থানে শ্রমিক ধর্মঘট শুরু হয় এবং কৃষক বিদ্রোহ চারদিকে ছড়িয়ে যায় ।
যুদ্ধক্ষেত্রে খাবারের কষ্ট ও মানবেতর জীবনযাপনকারী সৈনিকরাও এবার বেঁকে বসে। তারা সংকটের মুখে কমান্ডারদের আদেশ অমান্য করে। অভাবি নির্যাতিত যেসব কৃষককে জোরপূর্বক দলে দলে সেনাসদস্যে পরিণত করা হয়েছে তারা রণাঙ্গন ছেড়ে এসে এবার শ্রমিক, কৃষকের সাথে যোগ দেয়। এতদিনে জারতন্ত্র ও অভিজাতদের অত্যাচার-নিপীড়নের সব শোধ তোলার জন্য অস্ত্র হাতে উন্মুখ হয় তারা। তাদের উপস্থিতিতে সাহসে বলীয়ান হয়ে আমজনতা পুরো রাশিয়ায় ঘটিয়ে দেয় এক ব্যাপক অভ্যুত্থান। ১৯১৭ সালের ৮ মার্চে শ্রমিক, আমজনতা আর কৃষকেরা রাস্তায় নেমে এসে দখল নেয় পেত্রোগ্রাদ। জার দ্বিতীয় নিকোলাসের সেনাপতি ইভানভ অনেক কষ্টে পেত্রোগ্রাদ দখল করতে সক্ষম হন। তবে জনগণের দাবির মুখে জার সিংহাসন ত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছিলেন। এভাবেই প্রাচীন রোমানভ রাজবংশের অবসানে রুশ বিপ্লবের প্রথম অধ্যায়ের সমাপ্তি ঘটে ।
১৯১৭ সালের মার্চে ব্যাপক গণঅভ্যুত্থানের মুখে জারের সিংহাসন ত্যাগ ক্ষমতার রদবদল ঘটায়। তখন একটি বুর্জোয়া বা মধ্যবিত্ত শ্রেণির সরকার গঠিত হয়। দেশের মধ্যবিত্ত শ্রেণির প্রতিনিধিত্বকারী বিভিন্ন প্রগতিশীল মানুষ ও নরমপন্থীদের প্রতিনিধিরাই ছিলেন মন্ত্রিসভার সদস্য। এ মন্ত্রিসভা ক্ষমতা গ্রহণের পরপরই তাদের কর্মসূচি ঘোষণা করে। তারা নির্বাচিত গণপরিষদ, রাশিয়ার জন্য সাংবিধানিক সংস্কার প্রবর্তন, গণপরিষদে দেশের ভূমি সমস্যার সমাধান সংক্রান্ত পদক্ষেপ গ্রহণ, দেশে গণতান্ত্রিক সংসদীয় সরকার প্রতিষ্ঠা, ব্যক্তিগত সম্পত্তির অধিকার রক্ষা, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা প্রদান, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সরকারি হস্তক্ষেপ বন্ধ, ধর্ম ও বাকস্বাধীনতা প্রদান প্রভৃতি বিষয়কে গুরুত্বের সাথে তুলে ধরে। মার্চ বিপ্লব পরবর্তী এ কর্মসূচি অনেকটাই পশ্চিম ইউরোপীয় দেশগুলোর অনুকরণে গৃহীত একটি সংস্কারমূলক পদক্ষেপ। তবে রাশিয়ায় বিদ্যমান আর্থসামাজিক পরিস্থিতিতে এ জাতীয় সংস্কার সময়োপযোগী ছিল না। বিশেষ করে এর সাথে রাশিয়ার শ্রমিক ও কৃষকদের ভাগ্য পরিবর্তনে এর সাথে কোনো সম্পর্ক ছিল না। এর জন্য আরো দীর্ঘ সংগ্রাম প্রয়োজন তা অন্তত একটু দেরিতে হলেও বুঝতে সক্ষম হয় রাশিয়ার কৃষক ও শ্রমিক শ্রেণি।
মার্চ বিপ্লবে কৃষক ও শ্রমিক এ দুই শক্তি মুখ্য ভূমিকা পালন করলেও শেষ পর্যন্ত তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠা পায়নি। তবে মার্চ বিপ্লবের এই সাফল্যে বলীয়ান হয়ে নতুন করে জোরালো আন্দোলন গড়ে তোলার পথ পায় তারা। বিশেষ করে কৃষকরা জমি বিতরণের দাবি আরো জোরালো করে। শ্রমিকরা পুঁজিবাদ ধ্বংসের জন্য আপ্রাণ চেষ্টা চালাতে শুরু করে। অধিকার আদায়ে প্রায় মরিয়া শ্রমিক ও কৃষকদের দাবি পূরণে বুর্জোয়া সরকার পুরোপুরি ব্যর্থ হয়। এক্ষেত্রে বিপ্লবের কৌশলগত কারণে বলশেভিক পার্টি বুর্জোয়া শ্রেণিকে সমর্থন দিয়ে বিরাট ভুল করেছিল। তারা ক্ষমতা দখলের জন্যই যে এটা করেছিল এতদিনে প্রমাণ হয়ে যায়।
লেনিন দেখলেন বলশেভিক পার্টির লক্ষ্য যেখানে প্রলেতারিয়েত সরকার প্রতিষ্ঠা তারা কিভাবে মধ্যবিত্ত আকুতিতে নিজেকে জড়াতে গেলেন? বিষয়টি যখন খুব উদ্বিগ্ন করছে সবাইকে তখন বলশেভিক নেতা লেনিন অবস্থান করছিলেন সুইজারল্যান্ডে। তিনি ১৯১৭ সালের এপ্রিলে দেশে ফিরে বিপ্লবের নেতৃত্ব গ্রহণ করে এই মর্মে ঘোষণা দিয়েছিলেন যে রাশিয়ায় বুর্জোয়া গণতন্ত্রের কোনো প্রয়োজন নেই। তিনি স্পষ্ট করে দেন রাশিয়ার সরকার পরিচালিত হবে শ্রমিক ও কৃষকের দ্বারা। এক্ষেত্রে মার্চ মাসের বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লবকে বলশেভিক বিপ্লবের প্রথম পর্যায় হিসেবে চিহ্নিত করতেও ভুল হয়নি তাঁর। তিনি স্পষ্টভাবে ঘোষণা করেন বিপ্লবের চূড়ান্ত স্তর হলো জমিদার ও পুঁজিপতিদের উচ্ছেদ করে আমজনতার অধিকার প্রতিষ্ঠা করা। শুধু এর মাধ্যমেই প্রলেতারিয়েত সরকার প্রতিষ্ঠা এবং কৃষক-শ্রমিকের অধিকার পূরণ সম্ভব হবে বলে মনে করতেন তিনি। রাশিয়ান সমাজে দীর্ঘকাল ধরে ভারি শিল্পের উপর রাষ্ট্রীয় মালিকানা প্রতিষ্ঠা নিয়ে সরকার ও অভিজাতদের মধ্যে টানাপড়েন চলে। পাশাপাশি চাষযোগ্য জমি কৃষকদের কাছে হস্তান্তরের বিষয়টিও ছিল অমীমাংসিত। অন্যদিকে লেনিন চলমান এককেন্দ্রিক ক্ষমতা বিকেন্দ্রীকরণের চেষ্টা করেন। এক্ষেত্রে স্থানীয় ক্ষমতা আঞ্চলিক সোভিয়েতের হাতে দেয়ার কথা ঘোষণা করা হয়। তবে ১৯১৭ সালের এপ্রিল-মে মাসে রাশিয়ায় ব্যাপক অরাজকতা দেখা দিলে সব পরিকল্পনা ভেস্তে যায়। তখনকার বুর্জোয়া সরকার প্রায় যুদ্ধকালীন এহেন পরিস্থিতি মোকাবিলায় সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়। দেশের অভ্যন্তরে সব পণ্যের অভাবের পাশাপাশি খাদ্য সংকট তীব্র রূপ নেয় ।
পণ্য ও খাদ্যসংকটের মধ্যে মড়ার উপর খাঁড়ার ঘার মত হাজির হয় জার্মান বাহিনী। তারা রাশিয়ার অভ্যন্তরে বিভিন্ন অঞ্চল একের পর দখল করতে থাকে। তাদের আক্রমণে পেত্রোগ্রাদের নিরাপত্তা পর্যন্ত বিপন্ন হয়। এমন সামরিক সংকটের মুখে দেখা দেয় ভয়াবহ সেনাবিদ্রোহ। ফলে একদিকে জার্মান আক্রমণ অন্যদিকে দেশের সেনাবাহিনীর উচ্ছৃঙ্খল আচরণ এর সবই মোকাবিলা করতে হয়েছিল তখনকার বলশেভিক সরকারকে। তবে উপযুক্ত পদ্ধতি অনুসরণ করে এমন পরিস্থিতিতেও বলশেভিকরা বিভিন্ন অঞ্চলের উপর নিজেদের নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখতে সক্ষম হয়েছিল। এ সময়ে লেনিনের নেতৃত্বে বলশেভিক পার্টির দুই নেতা ট্রটস্কি ও স্টালিন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। তাদের যোগ্য নেতৃত্বে বলশেভিক পার্টির হাজার হাজার সদস্য পুরো রাশিয়ায় নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে। তারপর একটি কনভয় পেত্রোগ্রাদের দিকে অগ্রসর হয়। জনগণের সমর্থন লাভ করায়
১৯১৭ সালের ৭ নভেম্বর বলশেভিকরা গুরুত্বপূর্ণ সরকারি স্থাপনাগুলোতে হানা দেয়। তারা বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় ভবন, ব্যাংক, টেলিফোন এক্সচেঞ্জসহ প্রায় সব ধরনের স্থাপনা দখল করে নেয়। তারা পুরো রাষ্ট্রযন্ত্রের উপর নিজেদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে। এরপর লেনিনের নেতৃত্বে বলশেভিক পার্টি সরকার প্রতিষ্ঠার কথা ঘোষণা দেয় ।
0 মন্তব্য(গুলি):
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
Comment below if you have any questions