আইনের শাসন
গণপ্রজাতান্ত্রী বাংলাদেশ সংবিধানের মাধ্যমে জনগণের সার্বভৌমত্বকে স্বীকার করে নেওয়া হয়েছে। ফলে বাংলাদেশে প্রতিটি নাগরিকের সম্পত্তি, মর্যাদা, স্বাধীনতা ও জীবন রক্ষার সকল দায়িত্ব রাষ্ট্র গ্রহণ করেছে। রাষ্ট্রের এ দায়-দায়িত্ব পালনের জন্য প্রথমেই যেটি প্রয়োজন সেটি হল সকলের জন্য সমান আইন প্রণয়ন এবং তার সঠিক প্রয়োগ। এই ধারণা থেকেই মূলত: আইনের শাসনের বিষয়টি রাষ্ট্র চিন্তায় গুরুত্বপূর্ণ। আইনের শাসন হল রাষ্ট্র পরিচালনার নীতিবিশেষ, যেখানে সরকারের সকল ক্রিয়া-কর্ম আইনের অধীনে পরিচালিত হয় এবং সেখানে আইনের স্থান সবকিছুর ঊর্ধ্বে। ব্যবহারিক ভাষায় আইনের শাসনের অর্থ এই যে, ক্ষমতাসীন সরকার সর্বদা আইন অনুযায়ী কাজ করবে, যার ফলে রাষ্ট্রের যেকোন নাগরিকের কোনো অধিকার লঙ্ঘিত হলে সে তার প্রতিকার পাবে। মোট কথা, আইনের শাসন তখনই বিদ্যমান থাকে, যখন সরকারি ক্ষমতা ও কর্তৃত্বের অনুশীলন আদালতের পর্যালোচনাধীন থাকে, যে আদালতের শরণাপন্ন হওয়ার অধিকার সকল নাগরিকের সমান। আইন প্রয়োগের চূড়ান্ত দায়িত্বটি অর্পিত হয়েছে বিচার বিভাগের উপর। বিচার বিভাগ রাষ্ট্রের মধ্যে যদি আইনের লংঘন হয় তাহলে বিদ্যমান আইনের প্রয়োগের মাধ্যমে ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান, কোম্পানি, সংঘ ইত্যাদির অধিকার প্রতিষ্ঠিত করে থাকে। বিচার বিভাগ যাতে বিনা বাধায় সকল নাগরিকের জন্য ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত করতে পারে সে লক্ষ্যে বিচার বিভাগকে স্বাধীনতা প্রদান করা হয়েছে।
আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় বিচার বিভাগের ভূমিকা :
বিচার বিভাগ আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় নিম্নোক্ত কার্যাবলি সম্পাদন করে থাকে ।
• আইন তৈরীর সময় বাংলাদেশ সংবিধানের কোন মূলনীতির লংঘন করেছে কিনা, আইন বিভাগের এ কাজটিকে বলা হয় বিচার বিভাগীয় পর্যালোচনা।
• কোন ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান ইত্যাদির অধিকার লংঘিত হলে তার বিচারিক দায়িত্ব সম্পাদন করা।
• রাষ্ট্রের সাথে ব্যক্তির কোন অধিকার সংক্রান্ত অভিযোগ আদালতে উত্থাপিত হলে তার মীমাংসাপূর্বক রায় প্রদান করা। রাষ্ট্রের যেকোন অংশে অগণতান্ত্রিক হস্তক্ষেপ হলে তার বিচারিক রায় প্রদান করা। এছাড়াও বিচার বিভাগ আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করার জন্য নিজস্ব কাঠামোর মধ্যে যেকোন ধরনের অভিযোগ উত্থাপিত হলে তার বিচারিক কার্য সম্পাদন করে থাকে।
যেহেতু সংবিধানের মূলনীতি অনুযায়ী নাগরিকের মৌলিক অধিকার সমুন্নত রাখার দায়িত্ব বিচার বিভাগের, সেহেতু কোনো ব্যক্তির এই অধিকার ক্ষুণ্ন হলে তিনি আইনের আশ্রয় নিতে পারবেন। এভাবে বিচার বিভাগ আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে সংবিধান প্রদত্ত নাগরিকের মৌলিক অধিকারসমূহ, যেমন--জীবন ও ব্যক্তি স্বাধীনতার অধিকার, চলাফেরার অধিকার, সমাবেশের স্বাধীনতা, চিন্তা, বিবেক ও বাক স্বাধীনতার অধিকার, সম্পত্তির অধিকার, ধর্ম সংক্রান্ত স্বাধীনতার অধিকার ইত্যাদি রক্ষা করে থাকে।
বাংলাদেশের আইন অনুযায়ী কোন ব্যক্তিকে বিনা বিচারে প্রহরায় আটকে রাখা যাবে না। গ্রেফতার হওয়ার ২৪ ঘন্টার মধ্যেই নিকটতম ম্যাজিস্ট্রেটের নিকট হাজির করতে হবে। সংশ্লিষ্ট ম্যাজিস্ট্রেটের আদেশ ব্যতিরেকে এর অতিরিক্ত সময় কোন ব্যক্তিকে আটকে রাখা যাবে না। বিচার বিভাগ কর্তৃক আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার এটি অন্যতম একটি পর্যায়। দেশের সকল নাগরিককে সমান চোখে দেখা আইনের শাসনের আরও একটি মৌলিক দিক। এক্ষেত্রে কোন রকম বর্ণ, শ্রেণি, ধর্ম বা লিঙ্গের ভিত্তিতে বঞ্চিত করা যাবে না। কেউ যদি এই উপায়ে বঞ্চিত হয়, সেক্ষেত্রে তিনি আইনের আশ্রয় নিতে পারবেন।
বিচার বিভাগ কর্তৃক জনগণের মৌলিক অধিকার পূরণের ক্ষেত্রে প্রথমেই যে শর্তটি মেনে চলতে হবে, তা হলো বিচার বিভাগ স্বাধীন ও নিরপেক্ষ হতে হবে। এক্ষেত্রে প্রয়োজন বিচার বিভাগকে সরকারের নির্বাহী বিভাগ থেকে নিয়ন্ত্রণমুক্ত রাখা। শাসন বিভাগ যেন বিনা বিচারে কোন বিচারককে অপসারণ করতে না পারে, তা নিশ্চিত করতে হবে। এছাড়া বিচারকদের পর্যাপ্ত বেতন-ভাতাদি প্রদান, দক্ষতা ও নিরপেক্ষতার মাপকাঠিতে বিচারক নিয়োগ নিশ্চিত করতে হবে। বিচারকদের কাজের স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার জন্য জরুরি।
0 মন্তব্য(গুলি):
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
Comment below if you have any questions