বাংলাদেশের প্রধান প্রধান রপ্তানি দ্রব্য কি কি
বাংলাদেশের প্রধান প্রধান রপ্তানি দ্রব্য
বাংলাদেশ কৃষিপ্রধান দেশ হওয়ায় এদেশ প্রধানত শিল্পের কাঁচামাল ও কৃষিদ্রব্য রপ্তানি করে থাকে। তবে সাম্প্রতিককালে বাংলাদেশের রপ্তানি বাণিজ্যের গতিপ্রকৃতিতে বেশ পরিবর্তন সাধিত হয়েছে। বাংলাদেশের প্রধান প্রধান রপ্তানি দ্রব্যকে দুভাগে ভাগ করা হয়। যথা :
(ক) প্রচলিত রপ্তানি দ্রব্যসমূহ (Traditional Export Goods) ও
(খ) অপ্রচলিত রপ্তানি দ্রব্যসমূহ (Non-Traditional Export Goods) ।
বর্তমান বিশ্ববাজারে বিভিন্নমুখী চাহিদার প্রেক্ষিতে উৎপাদন বা সরবরাহ খাতেও এর পরিমাণগত এবং মাত্রাগত পরিবর্তন ঘটেছে। এ প্রেক্ষিতে বাংলাদেশের রপ্তানি দ্রব্যসমূহকে দুভাগে ভাগ করা হয়। যথা—(i) প্রাথমিক পণ্য এবং (ii) শিল্পজাত পণ্য। প্রাথমিক পণ্যের মধ্যে—হিমায়িত খাদ্য, চা, কৃষিজাত পণ্য, কাঁচা পাট এবং অন্যান্য। শিল্পজাত পণ্যের মধ্যে—ওভেন পোশাক, নিটওয়্যার, চামড়া, পাটজাত পণ্য, সার ও রাসায়নিক দ্রব্য, জুতা, সিরামিক সামগ্রী, প্রকৌশল দ্রব্যাদি, পেট্রোলিয়াম উপজাত, হস্তশিল্পজাত দ্রব্য এবং অন্যান্য।
নিচে প্রচলিত এবং অপ্রচলিত রপ্তানি দ্রব্যের বিবরণ দেওয়া হলো :
(ক) প্রচলিত রপ্তানি দ্রব্যসমূহ
বাংলাদেশ যে সকল দ্রব্য সচরাচর বিশ্ববাজারে রপ্তানি করে আসছে, সেগুলোকে প্রচলিত রপ্তানি দ্রব্য বলে। প্রচলিত রপ্তানি দ্রব্যসমূহ নিম্নরূপ :
(i) কাঁচাপাট : বাংলাদেশের রপ্তানি দ্রব্যের মধ্যে কাঁচা পাট অন্যতম। প্রতি বছর এদেশে প্রায় ২৫ লক্ষ একর জমিতে পাট চাষ হয়, প্রায় ৭৫ লক্ষ বেল পাট উৎপন্ন হয়। দেশীয় চাহিদা মেটানোর পর প্রতি বছর প্রায় ১৫-১৮ লক্ষ বেল পাট বিদেশে রপ্তানি করা হয়। ২০১২-১৩ এবং ২০১৪-১৫ অর্থবছরে এ খাতে রপ্তানি থেকে আয় হয় যথাক্রমে ২৩০ এবং ১১২ মিলিয়ন মার্কিন ডলার।
(ii) চা : বর্তমানে ১৬৭টি চা বাগানে প্রায় ৫৩ হাজার হেক্টর জমিতে চা চাষ হয় এবং প্রতি বছর প্রায় ৫০.০০ মিলিয়ন কেজি চা উৎপাদিত হয়। এর ফলে দেশের চাহিদা পূরণের পরও বছরে প্রায় ৩০ মিলিয়ন কেজি চা বিদেশে রপ্তানি করে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা আয় করে। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, রাশিয়া, পাকিস্তান, কানাডা, জাপান, অস্ট্রেলিয়া, মিসর, জার্মানি, বুলগেরিয়া, পোল্যান্ড প্রভৃতি দেশ বাংলাদেশের চা-এর প্রধান ক্রেতা। ২০১২-১৩ এবং ২০১৪-১৫ অর্থবছরে এ খাতে রপ্তানি আয় হয় যথাক্রমে ২ এবং ৩ মিলিয়ন মার্কিন ডলার।
(iii) চামড়া : বাংলাদেশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ রপ্তানিযোগ্য পণ্য হলো চামড়া ও চামড়াজাত দ্রব্য। বাংলাদেশের গরু, মহিষ, ছাগল, ভেড়া প্রভৃতি পশুর চামড়া মানে ও গুণে উন্নত। তাই বিদেশে এর ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। ভারত, রাশিয়া, ব্রিটেন, জাপান, জার্মানি, ইতালি, পোল্যান্ড প্রভৃতি দেশে কাঁচা ও পাকা চামড়া রপ্তানি করে বাংলাদেশ বৈদেশিক মুদ্রা আয় করে। ২০১২-১৩ এবং ২০১৪-১৫ অর্থবছরে এ খাতে আয় হয় যথাক্রমে ৪০০ ও ১১৩১ মিলিয়ন মার্কিন ডলার।
(iv) কাগজ, নিউজপ্রিন্ট ও কাগজজাত দ্রব্য : বাংলাদেশের অন্যতম উল্লেখযোগ্য রপ্তানি পণ্য হলো কাগজ, নিউজপ্রিন্ট ও কাগজজাত দ্রব্য। এদেশের কাগজ মিলগুলোতে প্রচুর কাগজ ও নিউজপ্রিন্ট প্রস্তুত হয় এবং নানা ধরনের কাগজজাত দ্রব্য তৈরি হয়। এ খাত হতে বাংলাদেশ প্রতি বছর প্রায় ৩-৪ মিলিয়ন মার্কিন ডলার আয় করছে। ভারত, পাকিস্তান, হাঙ্গেরি, পোল্যান্ড, ইরান, মায়ানমার প্রভৃতি দেশে কাগজ, নিউজপ্রিন্ট ও হার্ডবোর্ড রপ্তানি করা হয়।
(v) ন্যাপথা, ফার্নেস অয়েল ও বিটুমিন : বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম ও সিঙ্গাপুরে অবস্থিত সেল ইস্টার্ন পেট্রোলিয়াম লিঃ কোম্পানির সাথে চুক্তিবদ্ধ হয়ে যৌথ প্রচেষ্টায় বাংলাদেশ চট্টগ্রামস্থ ইস্টার্ন রিফাইনারি লিমিটেড-এ অপরিশোধিত খনিজ তেল ও পেট্রোলিয়াম শোধন করে। এখানে উপজাত হিসেবে ন্যাপথা ও ফার্নেস তেল উৎপাদিত হয় যা দেশের চাহিদা পূরণের পর রপ্তানি করা হয়। এছাড়া দেশে তৈরি বিটুমিনও রপ্তানি করা হয়। ২০১২-১৩ এবং ২০১৪-১৫ অর্থবছরে এ খাতে অর্জিত আয়ের পরিমাণ যথাক্রমে ৩১৪ ও ৭৮ মিলিয়ন মার্কিন ডলার।
(খ) অপ্রচলিত রপ্তানি দ্রব্যসমূহ
কিছুদিন পূর্বেও যেসব দ্রব্য বাংলাদেশ থেকে বিদেশে রপ্তানি করা হতো না, কিন্তু সাম্প্রতিককালে রপ্তানি করা হয়, তাকে অপ্রচলিত দ্রব্য বলা হয়। এসব দ্রব্যের মধ্যে তৈরী পোশাক, হোসিয়ারি দ্রব্য, হিমায়িত খাদ্য, হস্তশিল্পজাত দ্রব্য, কৃষিজাত দ্রব্য যেমন— শাকসবজি ও ফলমূল, রাসায়নিক দ্রব্য প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। সাম্প্রতিক হিসেবে বাংলাদেশের মোট রপ্তানিতে অপ্রচলিত দ্রব্যের অবদান শতকরা প্রায় ৮০ ভাগেরও বেশি।
নিচে বাংলাদেশের কয়েকটি অপ্রচলিত রপ্তানি দ্রব্যের সংক্ষিপ্ত বিবরণ দেওয়া হলো :
১. তৈরী ও হোসিয়ারি পোশাক : বাংলাদেশের অপ্রচলিত রপ্তানি দ্রব্যের মধ্যে তৈরী পোশাক বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের ক্ষেত্রে আশাতীত সাফল্য অর্জন করেছে। বর্তমানে এ খাতকে অপ্রচলিত বললে ভুল হবে। কারণ ওভেন পোশাক এবং নিটওয়্যার মিলে এটি মোট রপ্তানি আয়ের মধ্যে একক বৃহত্তম খাত। ইউরোপ, আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া, আফ্রিকা ও মধ্যপ্রাচ্যের দেশসমূহে, বাংলাদেশের তৈরী প্যান্ট, শার্ট, জ্যাকেট প্রভৃতির যথেষ্ট চাহিদা রয়েছে। বাংলাদেশের তৈরী পোশাক এবং নিটওয়্যার-এর মান উন্নত হওয়ায় এর চাহিদা এবং রপ্তানি আয় ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে। ২০১২-১৩ ও ২০১৪-১৫ অর্থবছরে এ খাত থেকে রপ্তানি আয় অর্জিত হয় যথাক্রমে ২১,৫১৬ ও ২৫,৪৯২ মিলিয়ন মার্কিন ডলার।
২. হিমায়িত খাদ্য : বাংলাদেশের অপর একটি প্রধান রপ্তানিজাত দ্রব্য হলো হিমায়িত খাদ্যসামগ্রী। বাংলাদেশ প্রতি বছর প্রচুর পরিমাণ মৎস্য ও হিমায়িত চিংড়ি, ব্যাঙের পা, শুঁটকি প্রভৃতি রপ্তানি করে প্রায় ১০০০ কোটি টাকার অধিক বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করে। এসব দ্রব্য সাধারণত যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, চীন, ইতালি, ভারত, হল্যান্ড ও সিঙ্গাপুরে রপ্তানি করা হয়। ২০১২-১৩ ও ২০১৪-১৫ অর্থবছরে এ খাতে অর্জিত আয় যথাক্রমে ৫৪৪ ও ৫৬৮ মিলিয়ন মার্কিন ডলার ।
৩. শাকসবজি ও ফলমূল : সাম্প্রতিককালে বাংলাদেশ বিভিন্ন কৃষিজাত পণ্য যেমন—শাকসবজি, ফলমূল, পান, সুপারি, গোলআলু, মসলা প্রভৃতি রপ্তানি করে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা আয় করে থাকে। মধ্যপ্রাচ্যের দেশসমূহ, ইউরোপের বিভিন্ন দেশসমূহ ও ভারতে এসব দ্রব্য রপ্তানি করে।
৪. হস্তশিল্পজাত দ্রব্য : বিশ্বের বাজারে বাংলাদেশের হস্তশিল্পের যথেষ্ট সুখ্যাতি আছে। তাই এ খাতে আমাদের রপ্তানি আয় ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। হাতে তৈরী কার্পেট, অলঙ্কার ও অন্যান্য হস্তশিল্প দ্রব্য রপ্তানি করে ২০১২-১৩ ও ২০১৪-১৫ অর্থবছরে বাংলাদেশ যথাক্রমে ৬ এবং ৯ মিলিয়ন মার্কিন ডলার করে উপার্জন করে ।
৫. সার ও রাসায়নিক দ্রব্য : বাংলাদেশ থেকে প্রতি বছর কিছু পরিমাণ অশোধিত ও পরিশোধিত সার এবং রাসায়নিক দ্রব্য রপ্তানি করা হয়। ভারতসহ প্রতিবেশী কয়েকটি দেশে সাধারণত এসব দ্রব্য রপ্তানি করা হয়। এ খাত হতে বাংলাদেশ ২০১২-১৩ ও ২০১৪-১৫ অর্থবছরে যথাক্রমে ৯৩ এবং ১১২ মিলিয়ন মার্কিন ডলার করে উপার্জন করে।
৬. টেরিটাওয়েল ও স্পেশালাইজড্ টেক্সটাইল : বাংলাদেশের রপ্তানি বাণিজ্যে টেরিটাওয়েল ও স্পেশালাইজ্ড টেক্সটাইল নতুন সংযোজন। এ খাতে রপ্তানির পরিমাণ ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পাচ্ছে। ২০১৪-১৫ অর্থবছরে এখাতে ১০৭ মিলিয়ন মার্কিন ডলার আয় করে।
৭. জুতা : বাংলাদেশের রপ্তানি বাণিজ্যে সাম্প্রতিক সংযোজন হলো জুতা রপ্তানি। ভবিষ্যতে এ খাতের সম্ভাবনা আরও উজ্জ্বল । ২০১২-১৩ ও ২০১৪-১৫ অর্থবছরে এ খাত থেকে অর্জিত আয় যথাক্রমে ৪১৯ ও ১৯০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার ।
৮. সিরামিক সামগ্রী : প্রতি বছর সিরামিক সামগ্রী রপ্তানি করে বাংলাদেশ প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা আয় করে। ২০০৯-১০ ও ২০১৪-১৫ অর্থবছরে এখাত হতে আয় হয় যথাক্রমে ৩০.৭৮ ও ৪৩ মিলিয়ন মার্কিন ডলার।
৯. অন্যান্য দ্রব্য : উপরিউক্ত দ্রব্যসমূহ ছাড়াও আরও কিছু অপ্রচলিত পণ্যসামগ্রী বাংলাদেশ থেকে রপ্তানি হয়ে থাকে। এ ধরনের দ্রব্যের মধ্যে পেট্রোলিয়াম উপজাত, দিয়াশলাই, গুড়, পার্টেক্স, রেয়ন, ইঞ্জিনিয়ারিং দ্রব্যাদি, বই পুস্তক, সাময়িকী, ফিচার ফিল্ম, রেশম ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। ২০০১২-১৩ এবং ২০১৪-১৫ অর্থবছরে এ খাতে অর্জিত আয়ের পরিমাণ যথাক্রমে ১৮০০ ও ৫৪৪ মিলিয়ন মার্কিন ডলার।
বিশ্বমন্দা পরিস্থিতি হতে উত্তরণের প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের রপ্তানি খাত তার অবস্থান সুদৃঢ় করেছে। ২০১২-১৩ অর্থবছরে রপ্তানির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে 27,02৭ মিলিয়ন মার্কিন ডলার যা পূর্ববর্তী অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ১১.২ শতাংশ বেশি।
উপরের আলোচনা থেকে বোঝা যায় যে, বাংলাদেশের এ সকল দ্রব্য অধিক পরিমাণে রপ্তানি করে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করতে হলে উৎপাদন বহুমুখীকরণ এবং উৎপাদন খরচ তুলনামূলকভাবে কমাতে হবে। মোট উৎপাদন বৃদ্ধি ও দ্রব্যের গুণগতমান উন্নত করতে হবে।
0 মন্তব্য(গুলি):
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
Comment below if you have any questions