মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের উপায় কি
মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রনের উপায়:
মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করতে যেসব ব্যবস্থা অবলম্বন করা হয় তাকে মোটামুটি তিন শ্রেণিতে ভাগ করা যেতে পারে; যথা- (ক) আর্থিক ব্যবস্থা, (খ) রাজস্ব সংক্রান্ত ব্যবস্থা এবং (গ) প্রত্যক্ষ নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি ।
(ক) আর্থিক ব্যবস্থা
মুদ্রাস্ফীতির প্রধান কারণই হল অর্থের পরিমাণ বৃদ্ধি । সুতরাং মুদ্রাস্ফীতি দূর করতে হলে অর্থের পরিমাণ কমাতে হবে। এ অর্থের পরিমাণ কমাতে হলে ব্যাংক সৃষ্ট ঋণের পরিমাণও কমাতে হবে। কারণ, বর্তমান অর্থ ব্যবস্থায় ব্যাংক সৃষ্ট ঋণের সাহায্যে বহু লেনদেন হয়ে থাকে। এ ঋণের পরিমাণ কমাতে পারলে মোট প্রচলিত অর্থের পরিমাণ কমে যায় এবং মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করা যায়। এ উদ্দেশ্যে প্রত্যেক দেশে কেন্দ্রীয় ব্যাংক যে সমস্ত ব্যবস্থা অবলম্বন করে থাকে তার মধ্যে নিম্নলিখিতগুলো প্রধান:
১। ব্যাংক হার বৃদ্ধি: কেন্দ্রীয় ব্যাংক যে হারে বানিজ্যিক ব্যাংককে টাকা ধার দেয় তাকে ব্যাংক হার বলা হয়। কেন্দ্রীয় ব্যাংক, ব্যাংক হার বাড়ালে বানিজ্যিক ব্যাংকগুলোও তাদের সুদের হার সাধারণত বাড়িয়ে দেয়। ফলে ব্যাংক হতে ঋণ গ্রহণ ব্যয়সাধ্য হয়ে পড়ে এবং ঋনের পরিমাণ স্বাভাবিকভাবেই কমে যায়। এভাবে মুদ্রাস্ফীতির সময় কেন্দ্রীয় ব্যাংক, ব্যাংক হার বাড়িয়ে দিয়ে মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করে ।
২। খোলাবাজারি কারবার: কেন্দ্রীয় ব্যাংক অনেক সময় খোলাবাজারে সরকারি ঋণপত্র বিক্রয় করে ব্যাংক সৃষ্ট অর্থের পরিমাণ কমাতে চেষ্টা করে। এরূপভাবে ঋণপত্র বিক্রয় করলে ক্রেতাগণ তাদের নিজ নিজ বাণিজ্যিক ব্যাংকের উপর চেক কেটে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পাওনা মিটিয়ে তাকে। এর ফলে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর ঋণদান ক্ষমতা কমে যায়। এভাবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক খোলা বাজারে ঋণপত্র বিক্রয় করে মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করে।
এছাড়া কেন্দ্রীয় ব্যাংক অনেক সময় বাণিজ্যিক ব্যাংকের রিজার্ভের হার পরিবর্তন, নৈতিক চাপ প্রয়োগ, প্রত্যক্ষ ঋণ নিয়ন্ত্ৰণ প্রভৃতির সাহায্যে ব্যাংক সৃষ্ট ঋণের পরিমাণ নিয়ন্ত্রণ করে মুদ্রাস্ফীতি দূর করার চেষ্টা করে।
(খ) রাজস্ব সংক্রান্ত ব্যবস্থা
বর্তমানে অর্থনৈতিক ব্যবস্থা অনুযায়ী মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের জন্য আর্থিক ব্যবস্থা অপেক্ষা ফিসক্যাল ব্যবস্থা বা সরকারি আয়-ব্যয় সংক্রান্ত নীতি অনেক বেশি কার্যকরী। লর্ড কেইনস্ সর্বপ্রথম এ নীতি অবলম্বন করার জন্য পরামর্শ দেন। মুদ্রাস্ফীতির মূল কারণ হল অতিরিক্ত ব্যয়। কাজেই ব্যয়ের পরিমাণ কমাতে পারলে মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করা যায়। সরকার যদি আয়-ব্যয় নীতি এমন ভাবে প্রচলন করেন যাতে মোট ব্যয়ের পরিমাণ কমে যায় তাহলে মুদ্রাস্ফীতির চাপও কমে যাবে । ফিসক্যাল ব্যবস্থার মধ্যে নিম্নলিখিতগুলো প্রধানঃ
১। সরকারি ব্যয় হ্রাস: সরকারি ব্যয় দেশের মোট ব্যয়ের পরিমাণের একটা মোটা অংশ। কাজেই মুদ্রাস্ফীতির সময় সরকারি ব্যয় কমানো উচিত। সরকারি খাতে যথাসম্ভব অনাবশ্যক বয় বন্ধ করা উচিত। উন্নয়ন পরিকল্পনা বিশেষ করে যেসব পরিকল্পনায় দ্রব্যাদি বিলম্বে উৎপন্ন হয় সেগুলোকে সাময়িকবাবে স্থগিত রাখতে হবে ।
২। অতিরিক্ত কর ধার্য: মুদ্রাস্ফীতি নিরোধের আর একটা প্রকৃত উপায় হল করের পরিমাণ বৃদ্ধি করা। বেশি করে কর দিতে হলে জনসাধারণের হাতে ব্যয়যোগ্য আয় কমে যায়। কাজেই মোট ব্যয়ের পরিমাণ কমে যায়। নতুন নতুন কর ধার্য করে এবং পুরাতন করের হার বাড়িয়ে লোকের ক্রয় ক্ষমতা কমানো যেতে পারে। অবশ্য করের হার বৃদ্ধি করার সময় প্রত্যক্ষ করের হার বাড়ানো উচিত এবং আমদানি শুল্ক না বাড়িয়ে রপ্তানি শুল্ক বাড়ানো উচিত।
৩। সরকার কর্তৃক ঋণ গ্রহণ: মুদ্রাস্ফীতি নিরোধনের জন্য সরকার জনগনের নিকট হতে অধিক পরিমাণ ঋণ গ্রহণ করে থাকে। এতে জনসাধারনের উদ্বৃত্ত আয় সরকারের হস্তগত হওয়ায় তাদের ক্রয়ক্ষমতা হ্রাস পায় ।
৪। সঞ্চয়ের উৎস প্রদান: সরকার জনসাধারনকে সঞ্চয়ে উৎসাহিত করেও মোট ব্যয়ের পরিমাণ হ্রাস করতে পারে। সুদের হার বাড়িয়ে দিলে জনসাধারণ অধিক পরিমাণে সঞ্চয়ে আগ্রহী হবে। এর ফলে ব্যয়ের পরিমাণ কমে যাবে এবং দামস্তর হ্রাস পাবে।
(গ) প্রত্যক্ষ ব্যবস্থা
মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রনের জন্য আর্থিক নীতি ও রাজস্বনীতির প্রয়োগ ছাড়াও সরকার কিছু প্রত্যক্ষ ব্যবস্থা গ্রহণ করে থাকে । এগুলোকে প্রত্যক্ষ নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি বলা হয়। প্রত্যক্ষ নিয়ন্ত্রন পদ্ধতির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলঃ
১। সর্বোচ্চ দাম নির্ধারণ: মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের জন্য সরকার পণ্যসামগ্রীর দামের সর্বোচ্চ সীমা নির্ধারণ করে দিতে পারে । এভাবে পণ্যসামগ্রীর সর্বোচ্চ বিক্রয়মূল্য বেধে দেওয়া হলে দামস্তর একটি নির্দিষ্ট পর্যায়ে সীমাবদ্ধ রাখা সম্ভব হয়।
২। ন্যায্য মূল্যের বিক্রয়কেন্দ্র স্থাপন: মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের জন্য ন্যায্যমূল্যে ভোগ্যপণ্য সরবরাহের জন্য সরকার ‘ন্যায্য মূল্যের বিক্রয় কেন্দ্র' স্থাপন করতে পারে। এছাড়া সরকার রেশনিং ব্যবস্থা চালু করতে পারে। এর ফলে দামস্তর হ্রাস পায় এবং মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব হয় ।
৩। মজুরি নিয়ন্ত্রণ: মুদ্রাস্ফীতির সময় শ্রমিকগণ মজুরির হার বাড়ানোর জন্য চাপ প্রয়োগ করে। তাদের অধিক মজুরি দেয়ার ফলে উৎপাদন ব্যয় এবং মূল্যস্তর বেড়ে যায়; তখন শ্রমিকেরা পুনরায় মজুরি বৃদ্ধির দাবি করে। এরূপে ক্রমাগতভাবে মূল্যস্তর ও মজুরি বৃদ্ধি পেতে থাকে। সে জন্য অনেক সময় আইন করে বা আপসের মাধ্যমে মজুরি বৃদ্ধি বন্ধ রাখা যায়।
৪। মূল্য নিয়ন্ত্রণ ও রেশনিং ব্যবস্থা: অত্যাবশ্যক দ্রব্যাদির মূল্য নিয়ন্ত্রণ ও রেশনিং ব্যবস্থা চালু করে মুদ্রাস্ফীতির চাপ কিছুটা কমানো যেতে পারে।
৫। মুদ্রা অবৈধকরণ: মুদ্রাস্ফীতি চরম আকার ধারণ করলে অনেক সময় পুরাতন মুদ্রা পরিত্যাগ করে নতুন মুদ্রার প্রচলন করা হয়। কোন কোন সময় বেশি মূল্যের নোটকে অচল করে দেওয়া হয় ।
৬। গচ্ছিত অর্থ আটক: মুদ্রাস্ফীতির সময় জনসাধারণ বিশেষ করে ধনী ব্যাক্তিরা যাতে বেশি অর্থ ব্যয় করতে না পারে সে জন্য অনেক সময় সরকার তাদের ব্যাংকে গচ্ছিত অর্থের সম্পূর্ণ বা কিছু অংশ সাময়িকভাবে আটক করে রাখে। এর ফলে এ অংশ ব্যয় করা সম্ভবপর হয় না। ফলে মুদ্রাস্ফীতির চাপ কমে ।
মুদ্রাস্ফীতি নিঃসন্দেহে একটি জটিল ও গুরুতর সমস্যা। কোন একটা বিশেষ পদ্ধতির সাহায্যে তা দূর করা সম্ভব নয়। এ জন্য মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রনের লক্ষ্যে আর্থিক নীতির পাশাপাশি রাজস্বনীতির প্রয়োগ সহ বিভিন্ন প্রত্যক্ষ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হয় ।
0 মন্তব্য(গুলি):
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
Comment below if you have any questions