আত্মকর্মসংস্থান কি
নিজেই নিজের কর্মসংস্থান করাকে আত্মকর্মসংস্থান বলে। আরও একটু স্পষ্ট করে বলা যায় যে, নিজস্ব অথবা ঋণ করা স্বল্প সম্পদ, নিজস্ব চিন্তা, জ্ঞান, বুদ্ধিমত্তা ও দক্ষতাকে কাজে লাগিয়ে ন্যূনতম ঝুঁকি নিয়ে আত্মপ্রচেষ্টায় জীবিকা অর্জনের ব্যবস্থাকে আত্মকর্মসংস্থান বলা হয়। যখন কোনো ব্যক্তি সেবাদানের বিনিময়ে বা ব্যবসার মাধ্যমে অর্থ উপার্জন এবং জীবিকা নির্বাহ করে তাকে আত্মকর্মসংস্থান বলে । আত্মকর্মসংস্থানকারী ব্যক্তি নিজেকে কোনো না কোনো ব্যবসায়ের কাজে নিয়োজিত করে। একজন গৃহিনী ঘরে বসে হাঁস-মুরগি, জাল বুনন, পোশাক তৈরি প্রভৃতি কাজ করে অতিরিক্ত আয়ের ব্যবস্থা করতে পারে। ভূমিহীন, বিত্তহীন, শিক্ষিত, অর্ধশিক্ষিত বেকার যুব সমাজ স্বল্প প্রশিক্ষণ নিয়ে আত্মকর্মসংস্থানে নিয়োজিত থাকতে পারে । তারা নিজ উদ্যোগে ছোটখাটো মাছের খামার, গরু-ছাগলের খামার, ফলের চাষ, মৌমাছি চাষ, ফুল চাষ, সবজি খামার ও নানা প্রকার বৃত্তিমূলক কাজের মাধ্যমে নিজের কর্মসংস্থান নিজেরাই করতে পারে। এ কাজে তেমন কোনো মূলধন প্রয়োজন হয় না। এর জন্য প্রয়োজন উদ্যোগ, দুটি কর্মঠ হাত, স্বল্প প্রশিক্ষণ ও প্রবল আত্মবিশ্বাস।
আত্মকর্মসংস্থানের প্রয়োজনীয়তা
বাংলাদেশ প্রায় ১৬ কোটি মানুষের দেশ। শতকরা প্রায় ৭৫ ভাগ লোক গ্রামে বসবাস করে। তাদের যেমন-নেই লেখাপড়া, তেমন নেই কর্মসংস্থানের সুযোগ। তাই কর্মসংস্থানের সন্ধানে মানুষ প্রতিনিয়ত শহরে ভিড় জমাচ্ছে। শহরে বাড়ছে জনসংখ্যার চাপ। দেশের মোট জনসংখ্যার এক-তৃতীয়াংশই হচ্ছে যুবক-যুবতী। এর মধ্যে প্রায় দুই কোটি যুবক- যুবতী বেকার । অথচ যুবক-যুবতীরাই হচ্ছে দেশ ও জাতির প্রাণশক্তি এবং সকল কর্মকাণ্ডের মূল চালিকাশক্তি ও ভবিষ্যতের কর্ণধার। আজকের বাংলাদেশের বেকার যুব সমাজের চিত্র শুধু উদ্বেগজনক নয়, ভয়ঙ্করও বটে। এ ভয়ঙ্কর পরিস্থিতিতে সমাজে শুধু যে হতাশা বাড়ছে তা নয়, বরং নানাবিধ পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া দ্বারাও মানুষ আক্রান্ত হচ্ছে। বিঘ্নিত হচ্ছে শান্তি- শৃঙ্খলা, নৈতিকতা ও নিরাপত্তা, বাড়ছে অস্থিরতা ও সামাজিক অপরাধ। তাই শিক্ষিত, অর্ধশিক্ষিত ও অশিক্ষিত যুব শক্তিকে আত্মকর্মসংস্থানের মাধ্যমে উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের সঙ্গে সম্পৃক্ত করতে হবে। এজন্য প্রয়োজন সুসংগঠিত উদ্যোগ। বৃত্তিমূলক ও পেশাগত প্রশিক্ষণ প্রদানের মাধ্যমে যুবকদের বিভিন্ন বৃত্তিতে দক্ষ করে আত্মকর্মসংস্থানের উদ্বুদ্ধ করে তুলতে হবে। বর্তমান আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটে আত্মকর্মসংস্থান ছাড়া আমাদের ব্যাপক বেকারত্ব মোকাবিলায় আর অন্য কোনো গত্যন্তর নেই । রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে আত্মকর্মসংস্থানের প্রতি সর্বোচ্চ গুরুত্ব প্রদান করতে হবে। যুব সমাজের আগ্রহ সৃষ্টি এবং তাদের জন্য সাহায্য ও সহযোগিতার ব্যবস্থা গড়ে তুলতে পারলে দেশের বেকার সমস্যাই শুধু নিরসনই হবে না বরং সামাজিক অপরাধ, বিশৃঙ্খলা ও নিরাপত্তাহীনতা থেকে দেশকে বাঁচানো যাবে।
উপরের আলোচনা থেকে প্রাপ্ত আত্মকর্মসংস্থানের প্রয়োজনীয়তা ও গুরুত্ব নিচে সংক্ষেপে তুলে ধরা হলো:
(ক) বেকারত্ব দূরীকরণ।
(খ) প্রশিক্ষণের মাধ্যমে মানব সম্পদ উন্নয়ন, কর্মসংস্থান বৃদ্ধি ও দারিদ্র্য দূরীকরণ।
(গ) আত্মকর্মসংস্থানের মাধ্যমে শহরমূখী জনস্রোত নিয়ন্ত্রণ এবং গ্রামীণ অর্থনীতি ও সমাজের ভারসাম্য রক্ষা। (ঘ) জনশক্তি সদ্ব্যবহারের মাধ্যমে দেশের উন্নয়ন।
(ঙ) দেশ প্রেমে যুব সমাজকে উদ্বুদ্ধ করা এবং স্বেচ্ছামূলক কাজে উৎসাহিত করে ।
আত্মকর্মসংস্থানের ক্ষেত্র
বাংলাদেশ একটি দরিদ্রপীড়িত জনবহুল দেশ। দেশে যে হারে বেকারের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে, তার চেয়ে অনেক কম হাওে চাকরির সুযোগ বাড়ছে। দেশের বৃহত্তম যুব সমাজ চাকরির পিছনে ধাওয়া না করে আত্মকর্মসংস্থানের মাধ্যমে অর্থনৈতিক ভাবে স্বাবলম্বী হতে পারে। এজন্য যুব সমাজকে উদ্বুদ্ধ করতে হবে। আত্মকর্মসংস্থানের গুরুদায়িত্ব অর্পিত হয়েছে যুব ও ক্রীড়ামন্ত্রনালয়ের অধীন যুব উন্নয়ন অধিদপ্তর, বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প সংস্থা প্রভৃতির ওপর। এ অধিদপ্তর ও সংস্থা আত্মকর্মসংস্থানের কতগুলো ট্রেড চিহ্নিত করেছে এবং প্রশিক্ষণ ও ঋণ কর্মসূচী চালু করেছে।
নিচে আত্মকর্মসংস্থানের ক্ষেত্রগুলো উল্লেখকরা হলো:
১. হাঁসমুরগি পালন, ২. গবাদিপশু পালন ও ছাগল পালন ৩. মৎস্য চাষ, ৪. সবজি ও ফল বাগান তৈরি, ৫. ফুলের চাষ, ৬. নার্সারি/বনায়ন, ৭. মৌমাছি চাষ, ৯. বাঁশ ও বেতের কাজ, ১০. হস্তশিল্প, কুটির শিল্প, মৃৎশিল্প, ১১. সেলাই / পোশাক তৈরি, ১২. আচার/জ্যাম/জেলি প্রস্তুতকরণ, ১৩. ব্লক ও বুটিক প্রিন্ট, ১৪. শাড়ি ও পোশাক নকশা, ১৫. কাপড়/চামড়ার ব্যাগ তৈরি ১৬. পশুখাদ্য প্রস্তুতকরণ, ১৭. পাটি বুনন, ১৮. নকশিকাঁথা, ১৯. ওয়েলডিং, ২০. উন্নতমানের মাটির চুলা তৈরি, ২১. ইলেক্ট্রিক ওয়্যারিং, ২২. রিকশা, সাইলে, মোটর সাইকেল ও গাড়ি মেরামত, ২৩. উল বোনা, ২৪ রেফ্রিজারেটর অ্যান্ড এয়ারকন্ডিশন মেরামত, ২৫. রেডিও, টিভি, ভিসিআর, মোবাইল সেট ভিসিডি মেরামত, ২৬. কম্পিউটার অপারেশন ও মেরামত, ২৭. গ্রামীণ স্যানিটারি ল্যাট্রিন তৈরি, ২৮. রবার চাষ, ২৯. পাম্প চালনা, ৩০. গাড়ি চালনা, ৩১. সাম্রতিক মাসে বহুল আলোচিত চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার শিবগঞ্জ উপজেলায় বরই গাছে লাক্ষা পোকার চাষ। এ পোকার ত্বকের নিচে জমানো গ্রন্থি থেকে আঠালো রস ক্রমান্বয়ে শক্ত হয়ে লাক্ষা তৈরি হয়। যা কাঠের আসবাবপত্র বার্ণিশ, বিভিন্ন রকমের পেইন্ট, চামাড়ার রং ইত্যাদি কাজে ব্যবহৃত হয়। লাক্ষা চাষের বিষয়টি আত্মকর্মসংস্থানের জন্য একটি নতুন ক্ষেত্র হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। সরকারি এবং এন.জি.ও পর্যায়ে আরও নতুন নতুন ট্রেড অন্তর্ভূক্ত করা এবং সে সম্বন্ধে প্রশিক্ষণ কর্মসূচি গ্রহণের চিন্তাভাবনা করা হচ্ছে।
আত্মকর্মসংস্থানের জন্য করণীয়
বাংলাদেশের মতো ছোট অথচ অত্যন্ত জনবহুল দেশে কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি সহজ নয়। দেশে চাকরির সূযোগ সীমিত সরকারি খাতে ইচ্ছা করলেই কর্মসংস্থান বৃদ্ধি করা যায় না। দেশে শিল্পায়নের হার সন্তোষজনক নয়। সরকার কর্তৃক গৃহীত উন্নয়ন কর্মসূচীগুলো এ বিপুল সংখ্যক বেকার যুবকদের কর্মসংস্থানের জন্য যথেষ্ট নয়। ফলে বেকারদের সংখ্যা দিন দিন বেড়েই চলেছে ।
১. বেকারদের শিক্ষা দিতে হবে যেকোন কাজই ছোট বা অপমানজনক নয়।
২. আত্মকর্মসংস্থানের উপযোগী ক্ষেত্রগুলোকে চিহ্নিত করে তাদেরকে সকল ট্রেডে অপ্রাতিষ্ঠানিক ও বাস্তবমুখী প্রশিক্ষণ প্রদান করতে হবে।
৩. স্কুল, কলেজ থেকে ছিটকে পড়া ছাত্রছাত্রীদের জন্য বিভিন্ন ট্রেডে প্রশিক্ষণ প্রদান এবং আত্মকর্মসংস্থানে উদ্বুদ্ধ করতে হবে।
৪. বৃত্তিমূলক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্রছাত্রীরা যাতে দ্রুত ও যথাযথভাবে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ে উদ্যোগ নিতে পারে সেজন্য উপদেশ বা পথনির্দেশ দিতে হবে এবং প্রয়োজনীয় ঋণদানের ব্যবস্থা করতে হবে।
৫. সর্বস্তরের শিক্ষাকে কর্মমূখী করার ওপর জোর দিতে হবে। পাঠ্যসূচীতেও বৃত্তিমূলক ও কারিগরি শিক্ষার ওপর বিশেষ গুরুত্বারোপ করতে হবে।
৬. পল্লী অঞ্চলে স্থানীয় সম্পদ ও প্রয়োজনের ওপর ভিত্তি করে কৃষি ও শিল্পের ওপর বৃত্তিমূলক শিক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে।
৭. আত্মকর্মসংস্থানের জন্য যুব ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করে ব্যাংক থেকে সহজ শর্তে ঋনের ব্যবস্থা করতে হবে।
0 মন্তব্য(গুলি):
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
Comment below if you have any questions