বাক্যতত্ত্ব কি
ইংরেজী Syntax শব্দের প্রতিশব্দ হিসাবে বাংলায় আমরা ‘বাক্যতত্ত্ব' কথাটি ব্যবহার করে থাকি। ইংরেজীতে এই Syntax শব্দটি এসেছে গ্রীক Syntaxis থেকে। গ্রীক ভাষায় এই শব্দটি প্রথম প্রয়োগ করেন গ্রীক বৈয়াকরণিক দিওনুসিওস্ থ্রাক্স (Dionusious Thrax)। গ্রীক ভাষায় শব্দটির অর্থ ‘একত্র বিন্যাস’। এই থেকে বাক্য মধ্যে শব্দ সমূহের একত্র বিন্যাসের তত্ত্ব অর্থক্রমে Syntax কথাটি প্রচলিত হয়।
Syntax যেহেতু বাক্যের তত্ত্ব সেহেতু বাক্যতত্ত্বের আলোচনার প্রথমেই আমাদের জেনে নেওয়া দরকার বাক্য বলতে কি বোঝায়? সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় এভাবে বাক্যের সংজ্ঞা দিয়েছেন, “যে পদ বা শব্দ সমষ্টির দ্বারা কোনও বিষয়ে সম্পূর্ণ রূপে বক্তার ভাব প্রকাশিত হয়, সেই পদ বা শব্দ সমষ্টিকে বাক্য (Sentence) বলে”। তিনি আরও স্পষ্ট করে বলেছেন, “কোনও ভাষায় যে উক্তির সার্থকতা আছে, এবং গঠনের দিক থেকে যা স্বয়ংসম্পূর্ণ, সে রকম একক উক্তিকে ব্যাকরণে বাক্য বলে” ।
ভাষাকে বিশ্লেষণ করলে প্রথমে যে বৃহত্তম একক আমরা পাই তা হল বাক্য এবং বাক্যের মধ্যে কোন্ শব্দ কোথায় বসবে ও তাদের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক কি রকম হবে তা ভাষাবিজ্ঞানের যে শাখায় আলোচিত হয়, তাকে বাক্যতত্ত্ব (Syntax) বলে।
ভাষাবিজ্ঞানে বাক্যকে বিশ্লেষণের বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি রয়েছে। যেমন— ঐতিহ্যগত বাংলা ব্যাকরণ, বর্ণনামূলক ও সাংগঠনিক (Descriptive and Structural), রূপান্তরমূলক সৃষ্টিশীল (Transformational Generative Grammar) ব্যাকরণের দৃষ্টিভঙ্গি।
ঐতিহ্যগত ব্যাকরণে বাক্যকে প্রথমত দু'টি অংশে ভাগ করা হয়েছে যথা- উদ্দেশ্য (Subject) ও বিধেয় (Predicate) ।
উদ্দেশ্য ও বিধেয়কে মৌলিক উপাদান হিসাবে নির্ণয় করে বাক্যকে তিনটি শ্রেণিতে ভাগ করা হয়:
(১) সরল বাক্য (Simple Sentence), (২) মিশ্র বা জটিল বাক্য (Complex Sentence) ও (৩) যৌগিক বাক্য (Compound Sentence)।
যে বাক্যে একটি মাত্র উদ্দেশ্য এবং একটি মাত্র বিধেয় থাকে তা-ই হল সরল বাক্য। যেমন- ‘কপিল পড়ছে’।
যে বাক্যে একটি প্রধান উপবাক্য থাকে এবং এক বা একাধিক অপ্রধান বা আশ্রিত উপবাক্য থাকে তাকে মিশ্র বা জটিল বাক্য বলে। যেমন- ‘যে মানুষেরা জীবনকে ভালবাসতেন, তাঁরাই জীবনের পথ রচনা করতে পেরেছেন' । এই বাক্যে ‘যে মানুষেরা জীবনকে ভালবাসতেন' হল আশ্রিত বা অধীন উপবাক্য আর ‘তাঁরাই জীবনের পথ রচনা করতে পেরেছেন' হল প্রধান উপবাক্য ।
যে বাক্য একের বেশী প্রধান উপবাক্য সংযোগে গঠিত হয় তাকে যৌগিক বা সংযুক্ত বাক্য (Compound Sentence) বলে।
একের বেশী সরল বা মিশ্র বাক্যকে সংযোজক অব্যয় (এবং, ও, আর প্রভৃতি) বা বিয়োজক অব্যয় (অথবা, বা, কিংবা) দিয়ে যুক্ত করে যে বাক্য গঠিত হয় তাকে যৌগিক বা সংযুক্ত বাক্য বলে।
যেমন- ‘কপিল লেখা পড়ায় ভাল এবং দেশের রাজনৈতিক অর্থনৈতিক অবস্থা সম্পর্কেও সচেতন' ।
এখানে দু'টি সরল বাক্যকে একটি সংযোজক অব্যয় (এবং) দিয়ে যোগ করা হয়েছে।
বর্ণনামূলক ভাষাবিজ্ঞানে বাক্যকে ভাষার বৃহত্তম একক (Unit) ধরে তাকে ধাপে ধাপে ক্রমশ বৃহত্তর থেকে ক্ষুদ্রতর উপাদানে বিশ্লেষণ করা হয়। বাক্যের এই বিশ্লেষণে প্রথমেই কতকগুলি মূল ধারণা সম্পর্কে আমাদের সুস্পষ্ট জ্ঞান থাকা দরকার। এ রকমের একটি মূল ধারণা হল গঠন (Construction)। খণ্ডিত বা পূর্ণ অর্থসমন্বিত যে কোন পদ সমষ্টিকে বা রূপমূল সমষ্টিকে গঠন বলা হয়। যেমন ‘কপিল যখন কাজের একঘেয়েমিতে বিমর্ষ তখন ভালবাসার সজীব পরশ এনে দিল সুচিতা'। এই সমগ্র পদসমষ্টির মধ্যে একটি সম্পর্কের বন্ধন আছে এবং এর একটি পূর্ণাঙ্গ অর্থ আছে, এটি একটি বাক্য। এই সমগ্র বাক্যটি হল গঠন। আবার ‘কপিল যখন কাজের একঘেয়েমিতে বিমর্ষ'- এই পদসমষ্টির অর্থ পূর্ণাঙ্গ নয়; কিন্তু এরও একটা অর্থ আছে যদিও তা খণ্ডিত এবং এর পদগুলির মধ্যেও পারস্পরিক সম্পর্ক আছে। এই পদসমষ্টিও গঠন। এর চেয়ে ক্ষুদ্র পদসমষ্টি হল ‘কাজের একঘেয়েমিতে'। এরও কিছু অর্থ আছে, যদিও তা আরো খণ্ডিত। এই রকম পদসমষ্টিকে আমরা পদগুচ্ছ (Phrase) বলি। এই রকম পদগুচ্ছকেও গঠন বলে। সুতরাং ভাষাবিজ্ঞানে গঠন কথাটি খুবই ব্যাপক অর্থ বহন করে। একাধিক শব্দ বা রূপমূল নিয়ে যখনই কোনো খণ্ডিত বা পূর্ণ অর্থযুক্ত একক (Unit) গড়ে উঠে তখনই তাকে গঠন বলে। একটি মাত্র শব্দ বা রূপমূলকে গঠন বলে না। গঠন হল- অর্থের সংহতিযুক্ত একাধিক শব্দ বা রূপমূলের সমষ্টি। আবার একাধিক শব্দ একসঙ্গে নিলেই তাদের গঠন বলে না। দেখতে হবে তাদের মধ্যে অর্থগত সংহতি বা ঘনিষ্ঠতা আছে কিনা। উপরের বাক্য থেকে দু'টি শব্দ নিলাম- একঘেয়েমি ও কপিল, এটা গঠন নয়, কারণ শব্দ দু'টির মধ্যে কোনো পারস্পরিক সম্পর্ক নেই। কিন্তু ‘কাজের একঘেয়েমিতে' হল একটি গঠন। কারণ, এদের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক আছে।
বর্ণনামূলক ভাষাবিজ্ঞানে বাক্যকে ধাপে ধাপে বৃহত্তর থেকে ক্ষুদ্রতর উপাদানে ভাগ করা হয়। যে কোনো গঠনকে প্রথম ধাপে আমরা যে ক'টি বৃহত্তম অর্থপূর্ণ উপাদানে ভাগ করতে পারি তাদের ‘অব্যবহিত গঠনগত উপাদান' (Immediate Constituent) বলে। যেমন- কাজের একঘেয়েমিতে কপিল যখন বিমর্ষ তখন ভালাবাসার সজীব পরশ এনে দিল সুচিতা'- এই বাক্যটিকে বিশ্লেষণ করতে গেলে একে আমরা প্রথম ধাপে সবচেয়ে বড় যে দু'টি অংশে ভাগ করতে পারি তা হল- (১) ‘কাজের একঘেয়েমিতে কপিল যখন বিমর্ষ’ এবং (২) ‘তখন ভালাবাসার সজীব পরশ এনে দিল সুচিতা'। ঐ বাক্যটিকে এর চেয়ে বড় উপাদানে আর ভাগ করা যায় না। এই বৃহত্তম উপাদান দু'টি হল সমগ্র বাক্যটির অব্যবহিত গঠনগত উপাদান। আবার যদি শুধু ‘কাজের একঘেয়েমিতে কপিল যখন বিমর্ষ'- এই উপবাক্যটি আরো বিশ্লেষণ করতে যাই তাহলে একে দু'টি বৃহত্তম উপাদানে ভাগ করতে পারি- (১) কপিল এবং (২) যখন কাজের একঘেয়েমিতে বিমর্ষ। এখানে এই দুটি হল উপবাক্যটির অব্যবহিত গঠনগত উপাদান। আবার যদি ‘যখন কাজের একঘেয়েমিতে বিমর্ষ' এই অংশটুকুই বিশ্লেষণ করি তাহলে একে দু'টি বৃহত্তম উপাদানে ভাগ করতে পারি- (১) ‘যখন কাজের একঘেয়েমিতে' এবং (২) ‘বিমর্ষ’। এখানে এই দুটি হল ‘যখন কাজের একঘেয়েমিতে বিমর্ষের' অব্যবহিত গঠনগত উপাদান। কিন্তু মনে রাখতে হবে ‘যখন কাজের একঘেয়েমিতে’ বা ‘বিমর্ষ' সমগ্র বাক্যটির গঠনগত উপাদান হলেও এটি সমগ্র বাক্যটির অব্যবহিত গঠনগত উপাদান নয়। ‘অব্যবহিত গঠনগত উপাদান' কথাটির অর্থ আপেক্ষিক। যে গঠনটি বিশ্লেষণ করা হয় তার বৃহত্তম উপাদানকে শুধু তারই অব্যবহিত গঠনগত উপাদান বলে; তার চেয়ে বৃহত্তর গঠনের অব্যবহিত উপাদান নয়। পূর্বোক্ত সমগ্র বাক্যটিকে আমরা চিত্রের সাহায্যে ধাপে ধাপে অব্যবহিত গঠনগত উপাদানে বিশ্লেষণ করে উপস্থাপিত করতে পারি।
এভাবে বাক্যকে বৃহত্তর থেকে ধাপে ধাপে ক্ষুদ্রতর গঠনগত উপাদানে বিশ্লেষণ করার ফলে শেষ ধাপে আমরা যে সব শব্দ পাই তাদের বাক্যের চরম গঠনগত উপাদান বলে। এই যে চরম গঠনগত উপাদান শব্দ। সেই শব্দ পর্যন্ত বিশ্লেষণ করা বাক্য তত্ত্বের আলোচ্য বিষয়ের মধ্যে পড়ে।
0 মন্তব্য(গুলি):
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
Comment below if you have any questions