তাসাউফ ও আত্মশুদ্ধি
মানবজীবনের দুটি দিক রয়েছে : একটি বাহ্যিক বা প্রকাশ্য দিক এবং অপরটি আত্মিক বা অপ্রকাশ্য দিক। ইসলাম মানুষের বাহ্যিক জীবনব্যবস্থা পরিচালনার জন্য প্রয়োজনীয় বিধান দিয়েছে। এর নাম শরী'আত। অপরদিকে মানুষের আত্মিক বা অদৃশ্য দিক নিয়ন্ত্রণের জন্যও নীতি-আদর্শ রয়েছে-এর নাম তাসাউফ ।
মানুষের কেবল বাহ্যিক দিক পরিচালিত হবে ইসলামী জীবন বিধানের আলোকে, আর অন্তর পরিচালিত হবে নিজের ইচ্ছা মাফিক- তা কখনো হতে পারে না। মানুষের অন্তর নিয়ন্ত্রণ, পরিচালন ও পরিশোধনের জন্য ইসলামে প্রয়োজনীয় দিক- নির্দেশনা রয়েছে। এর প্রচলিত নাম হচ্ছে তাসাউফ।
তাসাউফ শব্দের উৎপত্তি ও অর্থ : তাসাউফ (ii) শব্দটি (৩) সুফুন শব্দ থেকে নেয়া হয়েছে। ‘সুফ' শব্দের অর্থ পশম বা Wool। সাদাসিধে জীবন যাপনের জন্য সূফিগণ পশমী পোশাক পরিধান করতেন। এ থেকেই ‘সূফি’ ও তাসাউফ শব্দের উৎপত্তি হয়েছে। এ মতটিই বেশি গ্রহণযোগ্য ।
মোল্লা জামি বলেন, তাসাউফ শব্দটি ’সাফা’ থেকে উৎপত্তি লাভ করেছে। ‘সাফা’ শব্দের অর্থ পবিত্রতা। সামআনীর মতে, তাসাউফ শব্দটি ‘বনু সাফা’ শব্দ থেকে এসেছে। আত্মার পবিত্রতার জন্য তারাই বেশি অগ্রণী ছিলেন। কারো মতে তাসউফ শব্দটি ’আসসাফফুল আউয়াল’ থেকে উৎপত্তি হয়েছে। এর অর্থ হলো ‘প্রথম সারি’ । আবার কারো কারো মতে তাসাউফ শব্দটি আহলুস সুফ্ফা থেকে উৎপত্তি লাভ করেছে। আহলুস সুফ্ফা হলো রাসূল (স) এর একদল বিশিষ্ট সাহাবী, যারা আত্মার শুদ্ধি-জ্ঞান অর্জনের জন্য মসজিদে জীবন কাটিয়েছিলেন। পশ্চিমা পন্ডিতদের মতে- সূফি শব্দটি গ্রিক শব্দ ‘সাফি' থেকে এসেছে। সাফিয়া শব্দের অর্থ জ্ঞান। সূফিরা আধ্যাত্মিক জ্ঞানের অধিকারী ছিলেন বলে তাদেরকে ‘সূফি’ বলা হয়। আর তাদের শাস্ত্রকে ‘তাসাউফ' বলা হয়।
তাসাউফের পারিভাষিক পরিচয় :
বিভিন্ন সূফি-সাধক ও ইসলামি চিন্তাবিদগণ তাসাউফ বা সূফিবাদের বিভিন্ন সংজ্ঞা প্রদান করেছেন। যেমন-
ইমাম গাযালি (র) বলেন, ‘তাসাউফ এমন এক বিদ্যা যা মানুষকে পাশবিকতা থেকে উন্নীত করে মনুষ্যত্বের চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছিয়ে দেয়।
বিশ্ববিখ্যাত সূফি যুননুন মিসরি (র) বলেন- “আল্লাহ তা'আলা ছাড়া আর সব কিছু বর্জন করাই হলো তাসাউফ।”
জুনায়েদ বাগদাদি (র) বলেন- “তাসাউফ হলো জীবন মৃত্যুসহ সকল বিষয়ে আল্লাহর ওপর পরিপূর্ণ নির্ভরশীল হওয়া।” বায়েজিদ বোস্তামি (র) বলেন- “আল্লাহর ইবাদতে পরিপূর্ণভাবে নিয়োজিত হওয়া এবং নৈকট্য লাভের উদ্দেশে পৃথিবীর সকল দুঃখ-কষ্ট সানন্দে গ্রহণ করার নাম তাসাউফ।
মোটকথা তাসাউফ বা সূফিবাদ হলো অন্তরের বিভিন্ন পাশবিক প্রবৃত্তি তথা কাম, ক্রোধ, লোভ, মোহ, হিংসা, পরশ্রিকাতরতা প্রভৃতি থেকে মুক্ত হয়ে এক আল্লাহর পরিচয়, তাঁর প্রেম ও নৈকট্য লাভ করার চেষ্টা করা । আর এ চেষ্টা করার সাধনাকেই তাসাউফ বা সূফিবাদ বলা হয়।
যে সব ব্যক্তি নিরন্তর চেষ্টা সাধনার মধ্য দিয়ে ইসলামের গভীর জ্ঞান লাভ করার চেষ্টা করেন, নিজের পাপের অনুশোচনা করে আত্মাকে পবিত্র করেন এবং নিজের জীবন উৎসর্গ করে আল্লাহ তা'আলার সন্তুষ্টি লাভের চেষ্টা করেন তাকে সূফি বলা যায়।
তাসাউফ ও আত্মশুদ্ধির গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা
আত্মাকে পবিত্রকরণের মাধ্যম :
আত্মাকে পূত-পবিত্র ও কলুষমুক্ত রাখার মাধ্যমে জীবনে সফলতা লাভ করা যায়। মহান আল্লাহ বলেন,
قَدْ أَفْلَحَ مَن زَكَّاهَا . وَقَدْ خَابَ مَن دَسَّاهَا
“যে ব্যক্তি আত্মাকে পূত-পবিত্র রাখল, সে সাফল্য লাভ করল। আর যে ব্যক্তি আত্মাকে কলুষিত করল সে ধ্বংস হয়ে গেল।” (সূরা আশ-শামস৯১ ৯-১০)
আল্লাহ পাক অন্যত্র বলেন-
قَدْ أَفْلَحَ مَن تَزَكَّى . وَذَكَرَ اسْمَ رَبِّهِ فَصَلَّىٰ .
“সেই ব্যক্তিই সফল, যে পবিত্রতা ও পরিশুদ্ধি অর্জন করে এবং তার প্রভুর স্মরণ করে ও সালাত আদায় করে।” (সূরা আল-আলা- ৮৭:১৪-১৫)
লোভ লালসা কামনা-বাসনা, হিংসা-বিদ্বেষ ইত্যাদি মানুষকে কলুষিত করে। এতে আত্মা অপবিত্র হয়ে পড়ে। সৎ চিন্তা, সৎ কর্ম, আল্লাহর যিকর ইত্যাদি মানুষের আত্মাকে পবিত্র রাখে। সুতরাং আত্মার শুদ্ধতার ওপর গুরুত্ব আরোপ করে রাসূল (স) বলেন-
كُلُهُ أَلَا وَهِيَ
ألَا وَإِنَّ فِي الْجَسَدِ مُضْغَةً إِذَا صَلَحَتْ صَلَحَ الْجَسَدُ كُلُّهُ وَإِذَا فَسَدَتْ فَسَدَ الْجَسَدُ كُلُّهُ ألا و
الْقَلْبُ
“সাবধান ! নিশ্চয় মানুষের দেহের মধ্যে একখন্ড গোশত আছে, যখন তা সুস্থ থাকে, তখন সমস্ত দেহই সুস্থ থাকে । আর যখন তা দূষিত হয়ে পড়ে তখন সমস্ত দেহই অসুস্থ হয়ে পড়ে। জেনে রেখো, তা হচ্ছে অন্তকরণ।” (বুখারী ও মুসলিম) কাজেই সবসময় আত্মাকে সুস্থ রাখার চেষ্টা করতে হবে। আর তা অর্জন করা যায় তাসাউফের মাধ্যমে।
মানবিক গুণাবলি অর্জনের মাধ্যম
মানবিক সৎ গুণাবলি অর্জন এবং পাশবিকতা দমন করা যায় তাসাউফ অর্জনের মাধ্যমে। কাজেই মানবিক গুণাবলি ও অন্তরের পবিত্রতা আনয়নের জন্য সাধ্যমত চেষ্টা করতে হবে।
কল্যাণ লাভের মাধ্যম
শান্তিময় জীবন নিশ্চিত করার জন্য তাসাউফের চর্চা ও বাস্তব জীবনে এর অনুশীলন করা প্রয়োজন। তাসাউফের সাধনার মাধ্যমে কল্যাণ লাভের আশা করা যায়। মহান আল্লাহ বলেন- “সে কল্যাণ লাভ করেছে, যে নিজেকে পবিত্র করেছে। আর ধ্বংস হয়েছে সে, যে নিজের আত্মাকে অপবিত্র করেছে।” (আশ্-শাম্স-৯১:৯-১০)
সকল প্রকার মন্দ এক হয়ে অন্তরে মরিচা পড়ে। অন্তরে যাতে কোন ধরনের মরিচা পড়তে না পারে- সেই ব্যাপারে মহান আল্লাহ বলেন-
كَلَّا بَلْ رَانَ عَلَىٰ قُلُوبِهِم مَّا كَانُوا يَكْسِبُونَ
“কখনো নয়, বরং তাদের কৃতকর্মই তাদের হৃদয়ে জং ধরিয়েছে।” (সূরা মুতাফফিফীন- ৮৩:১৪)
0 মন্তব্য(গুলি):
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
Comment below if you have any questions