শরীয়ত ও তাসাউফ
ইসলাম একটি পরিপূর্ণ জীবন বিধানের নাম। তাই স্বাভাবিক কারণেই ইসলামের সব বিধি-বিধান পরস্পর সম্পর্কযুক্ত। মুসলিম জাতির ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক জীবনের দিক- নির্দেশনা রয়েছে ইসলামে। শরী'আতের সম্পর্ক মানুষের প্রকাশ্য কার্যকলাপের সাথে। আর তাসাউফের সম্পর্ক মানুষের আত্মার সাথে । সুতরাং একটি অপরটির সহায়ক ও পরিপূরক। তাসউফের সাথে শরীআতের সম্পর্ক অত্যন্ত সুদৃঢ়। কাজেই যারা বলার চেষ্টা করেন যে, শরী'আত ও তাসাউফ এক জিনিস নয়, বরং ভিন্ন জিনিস কিংবা যারা বলেন যে, শরী'আতের সাথে তাসাউফের কোন সম্পর্ক নেই- তাদের বক্তব্য ইসলামের দৃষ্টিতে ভিত্তিহীন।
তবে এ বিদআতপন্থী তথাকথিত সূফিবাদের সাথে ইসলামের দূরতম সম্পর্ক নেই। সুতরাং যারা তাসাউফ মানেন কিন্তু শরী'আত মানার প্রয়োজন বোধ করেন না-এরূপ সূফিবাদকে ইসলাম সমর্থন করে না। কাজেই তথাকথিত যে সব বিদআতপন্থী সূফি ইসলামি শরী'আত তথা সালাত, সাওম, হজ্জ, যাকাত ইত্যাদি পালন করবে না, তারা প্রকৃত মুসলমান নয়। অনুরূপভাবে যারা ইসলামি শরী‘আতকে বাদ দিয়ে কেবল মোরাকাবার নামে ধ্যানমগ্ন থাকার ওপর বেশি গুরুত্ব আরোপ করেন-সেটাকেও প্রকৃত তাসাউফ বা সূফিবাদ বলা যায় না। তাই স্পষ্ট করেই বলা যায়- শরী'আত ছাড়া তাসাউফ হতে পারে না। শরী'আত ছাড়া তাসাউফ বৈরাগ্যবাদের শামিল। বৈরাগ্যবাদের সাথে ইসলামের দূরতম সম্পর্ক নেই। বর্ণিত আছে যে- ‘ইসলামে বৈরাগ্যবাদ নেই' ইসলাম বিশ্বাসের ধর্ম, ইসলাম কর্মের ধর্ম। বিশ্বাস ও কর্মের সমন্বয় ছাড়া ইসলাম ধর্ম অর্থবহ হয় না। কাজেই পবিত্র ইসলাম ধর্ম যে তাসাউফের স্বীকৃতি দেয়, তা সম্পূর্ণরূপে কুরআন ও হাদিস সমর্থিত। ইসলামি শরী'আতের বিধি-বিধানের সাথে সম্পর্ক থাকবে না- ইসলামে এমন তাসাউফের স্থান নেই। সুতরাং একথা নির্দ্বিধায় বলা যায়, তাসাউফ শাস্ত্র ইসলামের অবিচ্ছেদ্য অংশ।
এখানে শরী'আত ও তাসাউফের সম্পর্কের কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক তুলে ধরা হলো-
অভিন্ন উৎস
শরী'আত ও তাসাউফ উভয়েরই উৎস এক ও অভিন্ন। আল্লাহ তা'আলা পৃথিবীর মানুষের জীবন পরিচালনার জন্য যেমন শরী'আত দিয়েছেন, তেমনি আধ্যাত্মিক জীবনের জন্য তাসাউফ দিয়েছেন। আল্লাহ তা'আলা বলেন-
لِكُلِّ جَعَلْنَا مِنْكُمْ شِرْعَةً وَمِنْهَاجًا
“তোমাদের প্রত্যেকের জন্য ‘শরী‘আত’ ও সুষ্ঠুপথ নির্ধারণ করেছি।” (সূরা মায়িদা-৫ : ৪৮)
শরী‘আত ও তাসাউফ পরস্পর সম্পূরক
শরী'আত ও তাসাউফ একে অপরের বিরোধী নয়; বরং সম্পূরক। সেজন্য কেবল শরী'আত পালন করে চললে সবকিছু মানা হয় না; তেমিন শুধু তাসাউফের অনুসরণের মাধ্যমে সফলতা আসবে না। শরী'আত ও তাসাউফ একসাথে পালন করতে হবে। একটিকে বাদ দিয়ে অন্যটি পালনের কোন সুযোগ নেই। যেমন আল্লাহ তা'আলা আল-কুরআনে ইসলামি শরী'আতের অন্যতম বিধান কুরবানী করার নির্দেশ দিয়েছেন। কিন্তু এই কুরবানী আল্লাহর তা'আলার নিকট কবুল হওয়া-না হওয়া নির্ভর করে তাকওয়া ও খুলুসিয়াতের ওপর। আর তাকওয়া ও খুলুসিয়াতের অপর নাম হলো তাসাউফ। আল্লাহ তা'আলা বলেন-
(কুরবানী)র পশুর গোশত এবং রক্ত আল্লাহর নিকট পৌঁছায় না। বরং পৌঁছায় তোমাদের তাকওয়া (সূরা হজ্জ-২২ : ৩৭) এখানে তাকওয়া বা আল্লাহভীতি বলতে তাসাউফকেই বুঝানো হয়েছে। কাজেই বলা যায়-শরী'আত ও তাসাউফ পরস্পর সম্পর্কযুক্ত।
দেহ ও রূহের সম্পর্ক
দেহের সাথে রূহের যেরূপ সম্পর্ক শরী'আত ও তাসউফের সম্পর্ক তেমনি। একটি অপরটি থেকে কখনও বিছিন্ন করা যায় না। নামায, রোযা, হজ্জ, যাকাত প্রভৃতি ইবাদত শরী'আতের অন্যতম বিধান। তাসাউফের যথাযথ অনুশীলন ছাড়া এসব ইবাদত পালন প্রাণহীন জড়বস্তুতে পরিণত হয়। তাই যথার্থভাবেই বলা যায় যে, শরী'আত ও তাসাউফ একটি আপরটির সাথে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত।
অবিভাজ্য সম্পর্ক
শরী‘আত ও তাসাউফ এর মধ্যে ইসলামের অবিভাজ্য সম্পর্ক। একটি ছাড়া অন্যটি পরিপূর্ণ হয় না। কাজেই উভয়টি এক হওয়ার মধ্য দিয়েই ইসলামের পরিপূর্ণতা লাভ করে। ইমাম মালিক (র) বলেন-
مَنْ تَصَوَّفَ وَلَمْ يَتَفَقَّهُ فَقَدْ تَزَنْدَقَ .
وَمَنْ تَفَقَّهَ وَلَمْ يَتَصَوَّفْ فَقَدْ تَفَسَقَ، وَمَنْ جَمَعَ بَيْنَهُمَا فَقَدْ تَحَقَّقَ"
“যে ব্যক্তি কেবল তাসাউফ শিখেছে, শরী'আত শেখেনি সে যিন্দিক (ফাসিক); আর যে কেবল শরী'আত শিখেছে তাসাউফ শেখেনি সে ফাসিক (দুর্বৃত্ত)। আর যিনি উভয় শিক্ষা অর্জন করেছেন তিনিই পরিপূর্ণতা লাভ করেছেন।” (মওসু‘আতির রাদ্দি আলাস্ সূফিয়্যাহ,পৃ.-২)
নক্ষত্র ও চন্দ্রের মত সম্পর্ক
সূফি সম্রাট আবদুল কাদির জিলানি (রহ.) বলেছেন, প্রথমে শরী'আত শিক্ষা করো। তারপর তাসাউফের জ্ঞান অর্জনের জন্য সাধনা করো । তাঁর এ বক্তব্য থেকেই তাসাউফ ও শরী'আতের সম্পর্ক কতটা গভীর তা অনুমান করা যায়।
মোটকথা শরী'আত ও তাসাউফ উভয়টি চর্চা করার উদ্দেশ্য হলো আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করা। সুতরাং সামগ্রিক বিবেচনায় শরী'আত ও তাসাউফের সম্পর্ক অত্যন্ত নিবিড়।
0 মন্তব্য(গুলি):
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
Comment below if you have any questions