শিক্ষা গবেষণা কি
বর্তমান প্রতিযোগিতাময় যুগে যে কোন পেশায় পেশাভিত্তিক উন্নয়ন ক্রমাগতভাবে পর্যবেক্ষণ করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কাজ। গবেষণা প্রক্রিয়ার মাধ্যমে এই সমস্ত কর্মকান্ডের উন্নতি, অগ্রগতি, সবল দুর্বল দিক চিহ্নিত করা ইত্যাদি কাজগুলো হয়ে থাকে। শিক্ষকতা পেশা অতি প্রাচীনকাল থেকে প্রচলিত হলেও বর্তমানে এর বিভিন্ন দিক নিয়ে বিশ্বের সবগুলো দেশেই কম বেশি শিক্ষা সংক্রান্ত মৌলিক বা প্রয়োগমূলক গবেষণা কাজ করা হচ্ছে। ইদানীং কালে প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে তাই শিক্ষা গবেষণা জনপ্রিয়তা লাভে সমর্থ হয়েছে।
মৌলির মতে “research is best conceived as the process of arriving at dependable solutions to problems through the planned and systematic collection, analysis and interpretation of data.”
অর্থাৎ পরিকল্পিত, ধারাবাহিকভাবে তথ্য সংগ্রহপূর্বক সেই তথ্যের বিশ্লেষণ এবং ব্যাখ্যার মাধ্যমে যখন কোন সমস্যার নির্ভরযোগ্য সমাধান খুঁজে পাওয়া যায় তখন সেই পদ্ধতিকে গবেষণা বলা হয়।
মৌলি আরও বলেছেন “It is a most important tool for advancing knowledge, for promoting progress and for enabling man to relate more effectively to his environment, to accomplish his purposes and to resolve his conflicts." জ্ঞানের সম্প্রসারণ, উন্নতি কিংবা পরিবেশের সাথে নিজেকে সম্পৃক্ত করা, নিজস্ব উদ্দেশ্য বাস্তবায়িত করা বা নিজের সংঘাতের সমাধান খুঁজে বের করার জন্য গবেষণা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ উপকরণ ।
গবেষণা প্রথম কে বা কখন শুরু করেন বা কারা একে জনপ্রিয় করেন এ ধরনের তথ্য বর্তমান পাঠে সংযোজন করার প্রয়োজন নেই। বিজ্ঞানী ডারউইন ১৮৫৯ সালে প্রকাশিত বই “Origin of Species” এ প্রথম পদার্থ বিজ্ঞান, রসায়ন, জীববিজ্ঞান ও ভূগোলের সাথে মানবজাতির সম্পর্ক ব্যাখ্যাকারী গবেষণাধর্মী তথ্য প্রকাশ করেন। ১৮৯৬ সালে ডিউই কর্তৃক যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ে ল্যাবরেটরি স্কুল প্রতিষ্ঠা করাকে শিক্ষা গবেষণার শুরু বলে ধরে নিতে পারি ।
এরপর সময়ের সাথে বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে শিক্ষাবিদ ও মনোবিজ্ঞানীগণ আনুষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যবস্থার বিভিন্ন দিক নিয়ে গবেষণা কাজ করেছেন। এভাবেই শিক্ষা ব্যবস্থার সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত সমস্যার সমাধান খুঁজে পাওয়ার লক্ষ্যে শিক্ষা গবেষণা জনপ্রিয়তা ও বিশ্বস্ততা অর্জন করেছে।
এবার আমরা শিক্ষাক্ষেত্রে গবেষণার প্রয়োজনীয়তা নিয়ে কিছু কথা বলব। রাষ্ট্র যখন দেশের জনগণের জন্য প্রয়োজনীয় শিক্ষা ব্যবস্থা পরিকল্পনা, প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের দায়িত্ব গ্রহণ করে তখন এর বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রায়শ বিভিন্ন সমকালীন অসম্পূর্ণতা চিহ্নিত করার প্রয়োজন দেখা দেয়। পর্যায়ভিত্তিক যে শিক্ষাক্রম দেশের বিশিষ্ট শিক্ষাবিদগণ প্রণয়ন করেন তাতে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন কারণে অসম্পূর্ণতা, অসঙ্গতি ধরা পড়ে। ঠিক তেমনি শ্রেণীকক্ষে যখন বিষয়ভিত্তিক শিক্ষকগণ শিক্ষণ শিখন কার্যক্রম পরিচালনা করেন তখন তারাও মুদ্রিত পাঠ্যপুস্তক, প্রশ্নপত্র ও উত্তরপত্রের ধারা, মানবণ্টন ইত্যাদি বিষয়ে বিভিন্ন ধরনের অসুবিধা চিহ্নিত করতে সমর্থ হন। পরবর্তী শিক্ষা বৎসর সমূহের ক্লাশগুলোতে যেন এ সমস্ত অসুবিধা মিটিয়ে ফেলা সম্ভব হয় তার জন্য শিক্ষককেও শ্রেণীকক্ষ শিক্ষণ নির্ভর গবেষণা করতে হয়।
সরকারের শিক্ষা মন্ত্রণালয়কেও শিক্ষানীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের বিভিন্ন দিক নিয়ে গবেষণার মাধ্যমে মৌলিক, কার্যকর, গ্রহণযোগ্য সিদ্ধান্তে পৌছাতে হয়। মূল্যায়ন কার্যক্রম পরিচালনাকারী সংস্থা (উদহারণঃ আমাদের দেশের “মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ড”) নিজস্ব কার্যক্রমের সবল, দুর্বল দিক চিহ্নিত করা ও উন্নতি আনয়নের লক্ষ্যে প্রতিনিয়ত গবেষণা করতে পারেন। আবার উন্নয়নশীল দেশসমূহে দাতাসংস্থার অর্থ সাহায্যে যে সমস্ত শিক্ষা প্রকল্প চালু করা হয় সে সমস্ত প্রকল্পেও নির্বাহী কর্মকর্তাবৃন্দ নিজেরা কিংবা গবেষক নিয়োগের মাধ্যমে প্রকল্পের বিভিন্ন অংশের মূল্যায়ন কাজের জন্য গবেষণা করেন।
আমরা বলতে পারি, শিক্ষা পদ্ধতি ও এর সাথে সম্পর্কিত যে কোন সংস্থা, অঙ্গ সংস্থাসমূহ শিক্ষা সম্পর্কিত ঘটনার কার্যকারণ নির্ণয়ের জন্য যে ধরনের গবেষণা কাজ করেন তা সবই শিক্ষা গবেষণার অন্তর্ভুক্ত এবং সময় ও যুগোপযোগী শিক্ষা ব্যবস্থা পরিচালনার জন্য এ ধরনের গবেষণার প্রয়োজনীয়তা দিন দিন বাড়ছে।
শিক্ষাক্রম, শিক্ষণ শিখন সামগ্রী প্রণয়ন ও ব্যবহার, পাঠ্যপুস্তক এর বিভিন্ন দিক, শিক্ষণ-শিখন পদ্ধতি, শিক্ষা মূল্যায়ন ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ অংশসমূহের অসঙ্গতি, দুর্বলতা ইত্যাদি দিক অবলম্বনে শিক্ষা গবেষণা কাজ পরিচালনা করার প্রয়োজনীয়তা আজকের দ্রুত উন্নয়নশীল বিশ্বে অনস্বীকার্য।
শিক্ষা গবেষণার আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত লক্ষ্যসমূহ সময়ের সাথে ক্রমশ পরিবর্তিত হয়েছে। গোড়ার দিকে বৈজ্ঞানিক গবেষণার পদক্ষেপসমূহ শিক্ষা গবেষণার ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা হত। এই সময়ের আন্দোলনকে বলা হয় “Science in Education Movement”; ঊনবিংশ এবং বিংশ শতকে এই ধরনের গবেষণা জনপ্রিয়তা লাভ করেছিল। এরপরে জন ডিউই এক নতুন ধারা প্রবর্তন করলেন; “experimentalist and progressive educational thought” বলে পরিচিত এই ধারা সাধারণত শিক্ষা, মনোবৈজ্ঞানিক ও দর্শন শাস্ত্র সম্বন্ধীয় বিষয় নিয়ে “সমস্যা সমাধানমূলক” কৌশলের মাধ্যমে গবেষণা করাকে উৎসাহ দিত। ১৯৪০ এর দিকে "group dynamics movement” এর কারণে action research বা কার্যোপযোগী গবেষণা গবেষকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করল।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর উন্নত বিশ্বে “re-constructionist curriculum development activity” প্রবল হল এবং ফলশ্রুতিতে “action research” আরো জনপ্রিয় হল। এই সময় হিল্ডা টাবা তাঁর বিশ্ববিখ্যাত “curriculum development project” এর মাধ্যমে শিক্ষাক্রম পরিমার্জন ও পরিবর্ধনের এক বৈজ্ঞানিক উপায় প্রতিষ্ঠিত করলেন। এই সময়ের action research বা কার্যোপযোগী গবেষণা “সমন্বিত কার্যোপযোগী গবেষণা” বা cooperative action research নামে পরিচিত।
আমরা যদি প্রকৃতি অনুসারে শিক্ষা গবেষণার ধারাকে চিহ্নিত করতে চাই তবে দেখব এর মধ্যে রয়েছে মূলত -
• শিক্ষার্থীকে পর্যবেক্ষণ করা মূলক ধারা
• নতুন ধারার শিক্ষা বা অগ্রগামী আন্দোলনের ধারা (এখানে বিজ্ঞানের চেয়ে দর্শনকে এবং জীবনের অভিজ্ঞতাকে পরীক্ষণের চেয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হত।)
• বিজ্ঞানভিত্তিক গবেষণার ধারা
• মানবধর্মী গবেষণার ধারা; ১৯৬০ এর পরবর্তী সময়ে এই ধারা প্রাধান্য পায় ।
এবার আমরা লক্ষ্য করব বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থার উন্নতিকল্পে যে ধরনের গবেষণা করা প্রয়োজন তার লক্ষ্য কি প্রকৃতির হতে পারে। প্রাথমিক স্তরের শিক্ষা ব্যবস্থার জন্য প্রয়োজনীয় গবেষণার লক্ষ্য নিম্নরূপ হতে পারে –
- অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত প্রাথমিক স্তরের শিক্ষা ব্যবস্থা উন্নীতকরণের উপযোগিতা যাচাই।
- বর্তমান আর্থসামাজিক ব্যবস্থায় অভিভাবক সমাজ কর্তৃক অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত প্রাথমিক স্তর বাধ্যতামূলক করার উপযোগিতা ও অবৈতনিক শিক্ষা ব্যবস্থার গ্রহণযোগ্যতা নির্ণয় করা।
- প্রাথমিক স্তরের বিজ্ঞান শিক্ষাক্রমের জীবনধর্মীতা নিরীক্ষণ করা ইত্যাদি।
মাধ্যমিক স্তরের জন্য প্রয়োজনীয় গবেষণার বহুবিধ লক্ষ্যের মধ্যে কয়েকটি উদাহরণ নিম্নরূপ হতে পারে -
- মাধ্যমিক শিক্ষার কার্যকারিতা যাচাই ।
- শ্রেণীকক্ষ শিক্ষণ-শিখন ব্যবহার সার্থকতা নিরূপণ ।
- মূল্যায়ন পদ্ধতি কম্পিউটারায়নের সবল ও দুর্বল দিক নির্ণয়।
অন্যান্য যে কোন প্রচলিত ও জনপ্রিয় বিষয়ভিত্তিক ক্ষেত্রের গবেষণার ন্যায় শিক্ষা গবেষণাকে প্রধানত দুই ভাগে ভাগ করা সম্ভব: মৌলিক গবেষণা (fundamental) এবং ব্যবহারিক গবেষণা (applied)।
মৌলিক গবেষণা প্রধানত কোন তত্ত্বীয় ধারণা উদ্ভাবনের লক্ষ্যে পরিচালনা করা হয়। এ ধরনের গবেষণার মাধ্যমে তত্ত্ব উদ্ভাবন, প্রসার ও বিস্তৃতি ঘটানো সম্ভব। মৌলিক গবেষণা অত্যন্ত সুষ্ঠু এবং সুনিয়ন্ত্রিত ভাবে কোন নতুন সত্য উদ্ঘাটনের লক্ষ্যে পরিচালনা করা হয়।
Anderson- "research in education is a disciplined attempt to address questions or solve problems through the collection and analysis of primary data for the purpose of description, explanation, generalization and prediction of workable results."
শিক্ষাক্ষেত্রে মৌলিক গবেষণার চেয়ে ব্যবহারিক গবেষণাই বেশি প্রচলিত।
ব্যবহারিক শিক্ষা গবেষণা সে সমস্ত issue বা ধারণা নিয়ে কাজ করে যেখানে বাস্তবতার পরিপ্রেক্ষিতে কোন সমস্যা দেখা দেয় বা যেখানে প্রচলিত ব্যবস্থা ও কৌশলের চেয়ে নতুনভাবে পরীক্ষিত কৌশল বেশি উপযোগী হতে পারে বলে মত প্রকাশ করা হয়। মৌলিক গবেষণার মাধ্যমে প্রাপ্ত নতুন তত্ত্ব বা পরিবর্তিত তত্ত্ব প্রয়োগের মাধ্যমেও ফলিত বা ব্যবহারিক গবেষণা পরিচালনা করা হয়।
প্রাকৃতিক বিজ্ঞান, জৈব বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, প্রকৌশল সবক্ষেত্রেই তত্ত্বীয় ভাবধারার প্রয়োগ, প্রমাণ, পরিবর্তন ইত্যাদির লক্ষ্যে ব্যবহারিক গবেষণা ক্রমশ জনপ্রিয়তা লাভ করছে। উন্নতবিশ্ব মৌলিক এবং ব্যবহারিক দুই প্রকারের গবেষণাই পরিচালনা করে থাকে। কিন্তু উন্নয়নশীল বিশ্বের দেশসমূহ মূলত নিজস্ব সমস্যাভিত্তিক ব্যবহারিক গবেষণা পরিচালনা করার প্রতি ঝুঁকছে। প্রত্যেক উন্নয়নশীল দেশ তার নিজস্ব আর্থসামাজিক অবস্থার উপর নির্ভর করে শিক্ষা ব্যবস্থার বিভিন্ন দিক উন্নয়নকল্পে জরুরী ভিত্তিতে বিভিন্ন ব্যবহারিক শিক্ষা গবেষণা পরিচালনার উপর জোর দিচ্ছে।
আমরা শিক্ষা গবেষণাকে আরো এক ধরনের দৃষ্টিকোণ থেকে বিভিন্ন ভাগে ভাগ করতে পারি ।
• ঐতিহাসিক (historical)
• উন্নয়নধর্মী (developmental)
* জরিপ (survey)
• বিষয়ী অনুধ্যান (case study)
সংশে- যাত্মক (correlational )
বিগতকালীন বিষয় সম্পর্কিত (ex-postfacto)
• পরীক্ষণমূলক (experimental) ও
• কার্যোপযোগী গবেষণা (action research)।
প্রকারভেদ করার সময় একটা কথা আমাদের মনে রাখতে হবে- পদ্ধতি, কৌশল এর প্রকারভেদ বা বিভিন্নতা থাকলেও বেশিরভাগ ক্ষেত্রে দেখা গেছে গবেষক শুধুমাত্র একটি পদ্ধতি অনুসরণ না করে প্রয়োজনবোধে একাধিক কৌশল ব্যবহার করতে উদ্যোগী হন। পদ্ধতি বা methodology শিক্ষা গবেষণার ক্ষেত্রে দুইটি মেরুর মধ্যে অবস্থান করছে - কৌশল এবং বৈজ্ঞানিক দর্শন। সাম্প্রতিককালে দেখা গেছে শিক্ষা গবেষকগণ কিভাবে কাজটি করবেন তা নিয়ে বেশি সময় নষ্ট না করে বরং কাজ সম্পন্ন করে কার্যকর ফল খুঁজে পেতে আগ্রহী ।
0 মন্তব্য(গুলি):
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
Comment below if you have any questions