ইজমা কি
ইজমা শব্দটি আরবি। এর আভিধানিক অর্থ- ঐকমত্য হওয়া, শক্তিশালী করা, দৃঢ় সিদ্ধান্ত নেওয়া, একমত হওয়া ইত্যাদি। সুতরাং কোন বিষয়ে ঐকমত্য পোষণ করার নামই হলো ইজমা। ইসলামি শরীআতের ভাষায়-“কোন কাজ অথবা কথার ওপর এক যুগের উম্মাতে মুহাম্মদীর ন্যায়বান মুজতাহিদগণের ঐক্যবদ্ধ সিদ্ধান্তকে ইজমা বলে।” ইজমা শরীআতের তৃতীয় উৎস। গুরুত্বের বিচারে কুরআন ও হাদিসের পরেই ইজমার স্থান। কোন বিশেষ যুগে আইন সংক্রান্ত কোন বিশেষ সমস্যার সমাধান কুরআন ও হাদিসকে অবলম্বন করে মুসলিম পণ্ডিতগণ যে সম্মিলিত অভিমত পোষণ করেছেন ইসলামি শরীআতে সেটা ইজমা।
ইজমা শরীআতের উৎস হওয়ার প্রমাণ
ইজমা শরীআতের উৎস হওয়ার পেছনে কুরআন ও হাদিসের যে দলিল রয়েছে তা নিচে আলোচনা করা হলো- কুরআনে বলা হয়েছে—
كُنْتُمْ خَيْرَ أُمَّةٍ أُخْرِجَتْ لِلنَّاسِ تَأْمُرُونَ بِالْمَعْرُوفِ وَتَنْهَوْنَ عَنِ الْمُنْكَرِ وَتُؤْمِنُونَ بِاللَّهِ
“তোমরাই উত্তম উম্মাত, মানব জাতির জন্য তোমাদের আবির্ভাব হয়েছে; তোমরা সৎকাজের নির্দেশ দিবে অসৎকাজের নিষেধ করবে এবং আল্লাহতে ইমান আনবে।” (সূরা আলে ইমরান-৩ : ১১০)
কুরআনে আরও বলা হয়েছে— “আর আমি তোমাদেরকে মধ্যমপন্থী উম্মাতরূপে পরিণত করেছি, যাতে তোমরা মানুষের প্রতি সাক্ষ্যদানকারী হতে পার। “আয়াতে উম্মাতের ন্যায়পরায়ণতাকে মধ্যপন্থী উল্লেখ করেছে, যা কিনা ইজমার একটি পরোক্ষ দলিল।
রাসূলুল্লাহ (স) বলেন-
ان أُمَّتِي لَا تَجْتَمِعُ عَلَى الضَّلَالَةِ
“আমার উম্মাত কোন ভুল বিষয়ে ঐকমত্য হবে না।” (ইবনে মাযাহ)
উপরিউক্ত কুরআন ও হাদিসের বাণী প্রমাণ করে উম্মাতের ইজমা শরীআতের উৎস।
ইজমা যে শরীআতের উৎস তা প্রমাণিত হয় সাহাবীগণের ইজমা প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে। মহানবী (স)-এর ইন্তিকালের পর মদীনা রাষ্ট্রের ভিত্তি সম্প্রসারিত হলে বিভিন্ন সমাজ ও সভ্যতার সাথে ইসলামের পরিচয় হয়। ফলে সমস্যাও বৃদ্ধি পায়। তখন সাহাবীগণ বাধ্য হয়ে ইজমার আশ্রয় গ্রহণ করেন। আর সাহাবীদের কর্মের উপরে কোন মুসলমান সন্দেহ পোষণ করতে পারে না। সুতরাং ইজমা শরীআতের উৎস।
ইজমা উৎপত্তির সময়কাল
ইজমা শরীআতের তৃতীয় উৎস। এটা তৃতীয় উৎস হিসেবে হযরত মুহাম্মদ (স)-এর যুগ থেকেই স্বীকৃতি লাভ করে। রাসূলুল্লাহ (স)-এর যুগেও কোন সমস্যার সমাধান কুরআনের মধ্যে না পাওয়া গেলে রাসূলুল্লাহ (স) বিশিষ্ট সাহাবাগণের সাথে পরামর্শ করে তার সমাধান দিতেন। আল্লাহ তা'আলা বলেন-
যেমন-
وَأَمْرُهُمْ سوري بينهم
“তারা নিজেদের মধ্যে পরামর্শের মাধ্যমে নিজেদের কর্ম সম্পাদন করে।” (সূরা শুরা- ৪২ : ৩৮)
রাসূলুল্লাহ (স) উহুদ যুদ্ধে সম্মুখ যুদ্ধ এড়াতে চেয়েছিলেন। কিন্তু সাহাবীগণের সংখ্যাধিক্যের ইচ্ছায় গুরুত্ব প্রদান করলে রসূলুল্লাহ (স) উহুদে সম্মুখ যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন ।
খোলাফায়ে রাশেদার যুগে ইজমা
খোলাফায়ে রাশেদার আমলে ইসলামি রাষ্ট্রের পরিসীমা বিস্তৃতি লাভ করলে নানা জাতি-গোষ্ঠীর সাথে ইসলামের পরিচয় ঘটে। ফলে নানা সমস্যারও উদ্ভব হয়। তখন উদ্ভূত সমস্যার সমাধানের জন্য ইসলামি চিন্তাবিদগণ ঐকমত্য পোষণ করে ঐ সমস্যার সমাধান করেন। হযরত উমর (রা) নানা বিষয়ে ইজমার মাধ্যমে সমাধান দিয়েছেন। খোলাফায়ে রাশেদার অন্যান্য খলিফাগণও ইজমার মাধ্যমে সমস্যার সমাধান দিতেন। সাহাবীদের জীবনে বহু ইজমা প্রতিষ্ঠিত হওয়ার ঘটনা ঘটে। তাঁরাও যে সকল বিষয়ে কুরআন ও হাদিস দ্বারা সমাধান দিতে পারেননি, সেসব বিষয়ে ইজমা প্রতিষ্ঠা করেছেন। যেমন-
হযরত উমর (রা)-এর আমলে রমাযান মাসের বিশ রাকআত তারাবীর নামায জামাতের সাথে আদায় জনিত সমস্যার সমাধানটি উল্লেখ করা যেতে পারে ।
তাবিঈগণও কোন সমস্যার সমাধানে সরাসরি কুরআন ও হাদিসের সাহায্য পেতে ব্যর্থ হলে কুরআন ও হাদিসের সাহায্য নিয়ে ইজমা করতেন ।
বর্তমান যুগে ইজমা
বর্তমান যুগেও ইজমা প্রতিষ্ঠিত হতে পারে। এ ব্যাপারে সকল আলিম একমত পোষণ করেছেন।
যেমন-
পবিত্র নগরী জেরুসালেমকে ইয়াহুদিদের হাত থেকে উদ্ধার করতে মুসলমানগণ ইজমার মাধ্যমে ঐকমত্য পোষণ করেছেন। ১.৪ ইজমার প্রয়োজনীয়তা
মানব সমাজ গতিশীল। মুসলিম রাষ্ট্রের বিস্তৃতির সাথে সাথে রাষ্ট্রীয় প্রয়োজনে মুসলিম সমাজ এমন কতকগুলো নতুন সমস্যার সম্মুখীন হয় যার সমাধানের সুস্পষ্ট নির্দেশনা কুরআন ও হাদিসে পাওয়া যায়নি। অথচ কুরআনে আল্লাহ মানুষের জন্য সব কিছু বর্ণনা করেছেন। আল্লাহ তা'আলা বলেন-
مَا فَرَّطْنَا فِي الْكِتَبِ مِنْ شَيْءٍ
“আমি কুরআনে কিছু বাদ রাখিনি।” (সূরা আনআম ৬ : ৩৮)
মানব জ্ঞান সসীম । তাদের সীমিত জ্ঞান-গবেষণায় কুরআন থেকে যাবতীয় সমস্যার সমাধান আহরণ করতে সক্ষম হয় না । . সাবাহীদের যুগ হতেই কুরআন-হাদিস থেকে না পাওয়া বিষয় ইজমার মাধ্যমে সমাধান করার প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। এ থেকে ইজমার উৎপত্তি।
ইজমার গুরুত্ব
কুরআনের বিভিন্ন আয়াতে পরোক্ষভাবে ইজমার প্রতি ইংগিত করা হয়েছে। মহান আল্লাহ বলেন-
“সুস্পষ্ট প্রমাণ আসার পরও যারা নিজেদেরকে বিচ্ছিন্ন করেছে ও নিজেদেও মধ্যে দ্বিমত সৃষ্টি করেছে, তোমরা তাদের মত হয়ো না।” (সূরা আলে ইমরান-৩:১০৫)
মহান আল্লাহ আরো বলেন : “তুমি যদি নিজে না জান, তবে যে জানে তাকে জিজ্ঞেস কর।” (সূরা আল নাহল-১৬:৪৩) মহানবী (স) বলেন : “আমার উম্মত ভুল বিষয়ে একমত হবে না।”
সকল মায্হাবে ইজমাকে আইনের উৎস গন্য করা হয়েছে। সুতরাং কুরআন-হাদিসে নেই এমন কোন বিষয়ে উম্মাহর ইজমা প্রতিষ্ঠিত হলে তা মেনে চলা প্রত্যেকের কর্তব্য।
ইজমার পদ্ধতি
ইজমা তিনটি উপায়ে বা পদ্ধতিতে সংঘঠিত হয়। (ক) মৌখিক উক্তি দ্বারা অর্থাৎ যখন মুজতাহিদগণ কোন বিশেষ বিষয় সম্পর্কে প্রকাশ্য মতামত প্রকাশ করেন। (খ) ii বা কর্ম দ্বারা অর্থাৎ কার্যক্ষেত্রে যখন সকলে একই পন্থা অবলম্বন করে কাজ করে। এতেও ইজমা সংঘঠিত হয় এবং (গ) এ বা মৌন সম্মতি অর্থাৎ মুজতাহিদগণ যখন এক বা একাধিক ব্যক্তির প্রকাশিত মতের সঙ্গে মতৈক্য প্রকাশ করেন তখন ইজমা সংঘঠিত হয়।
ইজমার হুকুম
ইসলামি শরীআত সংক্রান্ত বিষয়ে ইজমা দ্বারা অকাট্য দলিল সাব্যস্ত হয়। তাই কোন ক্রমেই ইজমার বিরোধিতা করা যায় না। ইজমার দ্বারা প্রবর্তিত বিধি-বিধান বিনা দ্বিধায় পালন করা কর্তব্য।
0 মন্তব্য(গুলি):
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
Comment below if you have any questions