অপুষ্টি কি
মানবসম্পদ উন্নয়ন ও বৃদ্ধি পুষ্টির সঙ্গে অবিচ্ছেদ্যভাবে সংশ্লিষ্ট। খাদ্যের পুষ্টি উপাদানের উপর নির্ভর করে মানবীয় বৃদ্ধি ও বিকাশ। পুষ্টি কোনো খাদ্য নয়, বরং এটি একটি জৈবিক প্রক্রিয়া। যে জৈবিক প্রক্রিয়ায় গৃহীত খাদ্যদ্রব্যের পুষ্টি উপাদান পরিপাক ও পরিশোধিত হয়ে তা সমগ্র দেহের কোষে কোষে ছড়িয়ে পড়ে এবং দেহের বৃদ্ধি সাধন, ক্ষয়পূরণ, শক্তি উৎপাদন ও রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে তাকে পুষ্টি বলা হয়। সহজকথায়, দেহের প্রয়োজন অনুযায়ী খাদ্যে পুষ্টি উপাদানের অভাব হলে বা খাদ্যে পুষ্টি উপাদানের আধিক্য ঘটলে শরীরের যে অস্বাভাবিক লক্ষণাদি প্রকাশ পায়, তাকে অপুষ্টি বলা হয়। খাদ্যের গুণগত ও পরিমাণগত ভারসাম্যহীনতার কারণে পুষ্টিহীনতা দেখা দেয়।
আমাদের দেহের প্রয়োজনীয় খাদ্য উপাদানগুলোকে ৬ ভাগে ভাগ করা হয়েছে, যেমন শর্করা, আমিষ, স্নেহ, ভিটামিন, খনিজ লবণ ও পানি। খাদ্যের এই পুষ্টি উপাদানগুলোর মোট পরিমাণ দেহের প্রয়োজনীয় চাহিদার তুলনায় কম হলে তাকে অপুষ্টি বা পুষ্টিহীনতা বা malnutrition বলে। মানববৃদ্ধি ও বিকাশের অন্যতম প্রতিবন্ধক হলো অপুষ্টি। দেহের প্রয়োজন অনুযায়ী অপরিমিত পুষ্টি উপাদান বিশিষ্ট্য খাদ্য ক্রমাগত গ্রহণ করার ফলে দেহের ক্ষয়পূরণ, বৃদ্ধিসাধন, রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা ইত্যাদির অভাবে কিছু রোগের লক্ষণাদি দেখা দিলেও তাকে অপুষ্টি বা পুষ্টিহীনতা বলা হয়। বয়স ও দৈহিক চাহিদা অনুযায়ী খাদ্যে যে পরিমাণ পুষ্টি উপাদান থাকা প্রয়োজন তার অভাব ঘটলে অথবা পুষ্টি উপাদানের আধিক্যের কারণে অপুষ্টি দেখা দিতে পারে।
সমাজকর্ম অভিধানের (১৯৯৫) ব্যাখ্যানুযায়ী, “অপুষ্টি হলো এমন একটি শারীরিক অবস্থা, যা সাধারণভাবে তবে আবশ্যকীয়ভাবে নয়, শারীরিক দুর্বলতার মাধ্যমে প্রকাশ পায়। প্রয়োজনীয় পুষ্টি উপাদান সমৃদ্ধ খাবার অপর্যাপ্ত পরিমানে গ্রহণের প্রভাবে অপুষ্টি দেখা দেয়।” নিচে একটি চিত্রের মাধ্যমে অপুষ্টির বৈশিষ্ট্যসমূহ তুলে ধরা হলো:
অর্থাৎ দেহের প্রয়োজনের প্রেক্ষিতে অপরিমিত খাদ্য গ্রহণ করার ফলে অথবা খাদ্যের মধ্যে পুষ্টি উপাদানের অভাবজনিত কারণে দেহের ক্ষয়পূরণ, বৃদ্ধিসাধন ও রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতার অভাবজনিত অবস্থাকেই অপুষ্টি বা পুষ্টিহীনতা বলা হয়।
অপুষ্টির কারণ
বাংলাদেশে অপুষ্টির বর্তমান অবস্থা কোনো একক কারণের ফলশ্রুতি নয় বরং এর সাথে অন্যান্য অনেক কারণ বিভিন্নভাবে পুষ্টিহীনতাকে ব্যাপকতর করে তুলেছে। অপুষ্টি আমাদের স্বাস্থ্যের জন্য একটি বড় সমস্যা।
অপুষ্টির কারণগুলো নিয়ে আলোচনা করা হলো:
১. খাদ্যে আমিষ ও ক্যালরির ক্রমাগত ঘাটতি: খাদ্যে প্রোটিন ও ক্যালরির অভাবজনিত কারণে সৃষ্ট অপুষ্টিকে প্রোটিন শক্তির ঘাটতিজনিত অপুষ্টি বলা হয়ে থাকে। প্রোটিন শক্তির অভাবজনিত কারণে রক্তে গ্লুকোজের পরিমাণ হ্রাস পায়, শরীরের তাপমাত্রা হ্রাস পায়, পানিস্বল্পতা ও ডায়রিয়া এবং রক্তস্বল্পতা দেখা দেয় ।
২. ভিটামিন এ, ই ও ডি এর অভাব: ভিটামিন দেহের বিপাক ক্রিয়া নিয়ন্ত্রণ করে এবং দেহের বৃদ্ধিসাধন, রক্ষণাবেক্ষণ ও শক্তি উৎপাদনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ভিটামিনের প্রভাবে খাদ্যের প্রোটিন, শর্করা ও স্নেহ উপাদানের পরিপাক ও বিপাক সম্পন্ন হয়। ভিটামিন এ, ই ও ডি এর অভাবজনিত কারণ পুষ্টিহীনতা নির্দেশ করে।
৩. অর্থনৈতিক কারণ: অর্থনৈতিক কারণে দারিদ্র্য, অনুন্নত জীবনযাত্রা ও উৎপাদনে অপ্রাচুর্যের সৃষ্টি হয়। এর ফলশ্রুতিতে দরিদ্র জনগণের পক্ষে পুষ্টিকর খাদ্য গ্রহণ সব সময় সম্ভব হয়ে ওঠেনা। অর্থনৈতিক বৈষম্যও সার্বিক পুষ্টি প্রক্রিয়াকে ব্যাহত করে থাকে ।
৪. জমির তুলনায় জনসংখ্যার আধিক্যঃ বাংলাদেশের মোট আয়তন ১,৪৭,৫৭০ বর্গকিলোমিটার আর জনসংখ্যা প্রায় সাড়ে ১৪কোটি। এদেশে মাথাপিছু আবদী জমির পরিমান .১০ হেক্টরের মত। কিন্তু এই জমি সবার সমপরিমান নেই, কোনো পরিবারের আছে অনেক বেশি আবার কোনো পরিবারের মোটেও নেই। মাথাপিছু এত অল্প পরিমাণ এবং জমির নিম্ন উৎপাদনশীলতা নিম্ন আয়ের অনেক মানুষের খাদ্যের চাহিদা পূরণ করতে পারে না। তাছাড়া এদেশের জনসংখ্যা প্রতিনিয়ত বৃদ্ধি পাচ্ছে। এই সার্বিক পরিস্থিতি আমাদের পুষ্টিকর খাদ্য গ্রহণে বঞ্চিত করছে।
৫. জমির নিম্ন উৎপাদনশীলতা: এদেশে জমির হেক্টর প্রতি ফলন কম হয়। অনেক জমিতেই সাধারণত বছরে একটি ফসল হয়। উন্নত দেশগুলোর জমিতে বছরে তিন-চারটা ফসল হয়। তাছাড়া এদেশের কৃষকরা উন্নত চাষ পদ্ধতিও জানে না। ফলে মানুষ পুষ্টিকর খাবার থেকে বঞ্চিত হয়।
৬. সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কারণ: বাংলাদেশে বিদ্যমান পুষ্টিহীনতার পেছনে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কতগুলো কারণ বিদ্যমান। এর মধ্যে অজ্ঞতা, কুসংস্কার, পুষ্টি জ্ঞানের অভাব ও নিরক্ষতা, ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ হতে খাদ্য বর্জন প্রভৃতি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
৭. পরিবেশগত কারণ: পরিবেশগত দিক অপুষ্টির বড় কারণ। অনুন্নত, অপরিস্কার ও অপরিচ্ছন্ন জীবনযাপন অপুষ্টি সৃষ্টি করে। এটি পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থার ত্রুটি, দূষিত পানি, অপরিচ্ছন্ন পরিবেশ প্রভৃতি অপুষ্টির মাত্রা বৃদ্ধি করে।
৮. প্রাকৃতিক বিপর্যয়ঃ আমাদের দেশে প্রাকৃতিক দুর্যোগ যেমন- বন্যা, খরা, সাইক্লোন, ঘূর্ণিঝড় প্রভৃতি ফসল ও জনজীবনের ব্যাপক ক্ষতি সাধন করে। এসব প্রাকৃতিক বিপর্যয় পুষ্টিহীনতাকে চরমভাবে বৃদ্ধি করে ।
৯. রাজনৈতিক কারণ: রাজনৈতিক মতাদর্শে বিরোধীতার জন্য দেশের সার্বিক উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হয়, অস্থিতিশীলতা বিরাজ করে এবং উৎপাদনের প্রবৃদ্ধি কমে। আন্তর্জাতিকভাবেও পুষ্টিকর খাদ্যের সুষম বণ্টন হয় না। প্রচ্ছন্নভাবে তা নিম্ন আয়ের মানুষদের পুষ্টিহীন করে রাখে ।
৫. জমির নিম্ন উৎপাদনশীলতা: এদেশে জমির হেক্টর প্রতি ফলন কম হয়। অনেক জমিতেই সাধারণত বছরে একটি ফসল হয়। উন্নত দেশগুলোর জমিতে বছরে তিন-চারটা ফসল হয়। তাছাড়া এদেশের কৃষকরা উন্নত চাষ পদ্ধতিও জানে না। ফলে মানুষ পুষ্টিকর খাবার থেকে বঞ্চিত হয়।
৬. সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কারণ: বাংলাদেশে বিদ্যমান পুষ্টিহীনতার পেছনে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কতগুলো কারণ বিদ্যমান। এর মধ্যে অজ্ঞতা, কুসংস্কার, পুষ্টি জ্ঞানের অভাব ও নিরক্ষতা, ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ হতে খাদ্য বর্জন প্রভৃতি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
৭. পরিবেশগত কারণ: পরিবেশগত দিক অপুষ্টির বড় কারণ। অনুন্নত, অপরিস্কার ও অপরিচ্ছন্ন জীবনযাপন অপুষ্টি সৃষ্টি করে। এটি পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থার ত্রুটি, দূষিত পানি, অপরিচ্ছন্ন পরিবেশ প্রভৃতি অপুষ্টির মাত্রা বৃদ্ধি করে।
৮. প্রাকৃতিক বিপর্যয়ঃ আমাদের দেশে প্রাকৃতিক দুর্যোগ যেমন- বন্যা, খরা, সাইক্লোন, ঘূর্ণিঝড় প্রভৃতি ফসল ও জনজীবনের ব্যাপক ক্ষতি সাধন করে। এসব প্রাকৃতিক বিপর্যয় পুষ্টিহীনতাকে চরমভাবে বৃদ্ধি করে ।
৯. রাজনৈতিক কারণ: রাজনৈতিক মতাদর্শে বিরোধীতার জন্য দেশের সার্বিক উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হয়, অস্থিতিশীলতা বিরাজ করে এবং উৎপাদনের প্রবৃদ্ধি কমে। আন্তর্জাতিকভাবেও পুষ্টিকর খাদ্যের সুষম বণ্টন হয় না। প্রচ্ছন্নভাবে তা নিম্ন আয়ের মানুষদের পুষ্টিহীন করে রাখে ।
অপুষ্টির প্রভাব
অপুষ্টি সমস্যা একটি দেশের জাতীয় অর্থনীতি ও সমাজবিকাশের পথে বিরাট বাধাস্বরূপ। তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে প্রতিবছর এই পুষ্টিহীন পরিস্থিতির ক্রমশ অবনতি ঘটছে।
অপুষ্টিজনিত যেসব প্রভাব পরিলক্ষিত হয় তা হলো:
১. পুষ্টি উপাদানের অভাবে নানাবিধ স্বাস্থ্যগত সমস্যা সৃষ্টি হয় যেমন- ম্যারাসমাস, কোয়ারশিয়রকর, শরীরের তাপমাত্রা খুব বেশি হ্রাস পায়, রক্তে গ্লুকোজের পরিমাণ হ্রাস পায়, মারাত্মক পানি স্বল্পতা ও ডায়রিয়া দেখা যায় ।
২. নবজাতক কম ওজন নিয়ে জন্ম গ্রহণ করে ও তাদের মনস্তাত্ত্বিক, বুদ্ধিবৃত্তিক ও শারীরিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত হয়। ৩. এদেশের মোট জনগোষ্ঠীর একটি বড় অংশ আয়োডিনের অভাবে গলগন্ড ও ভিটামিন এ এর অভাবে রাতকানা রোগে আক্রান্ত ।
৪. এদেশের প্রসূতি ও বয়ঃসন্ধিক্ষণে থাকা উল্লেখযোগ্য সংখ্যক নারী অপুষ্টিজনিত রক্তশূণ্যতার শিকার।
৫. অপুষ্টিজনিত কারণে প্রায়শই শিশু বিভিন্ন ধরনের রোগে যেমন- হাম, অন্ত্রের প্রদাহ, রিকেটস প্রভৃতিতে আক্রান্ত হয় ।
৬. অপুষ্টিজনিত কারণে শিশু ও প্রাপ্তবয়স্ক যুবাদের স্বাস্থ্যগঠন বিঘ্নিত হয় ।
৭. অপুষ্টির শিকার মা অপুষ্ট সন্তানের জন্ম দেয় এবং অধিক মেধাসম্পন্ন হিসেবে এসব সন্তান বেড়ে উঠতে পারে না ।
৮. পুষ্টিহীনতা মাতৃমুত্যু ও শিশুমৃত্যুর জন্যও দায়ী থাকে ।
অপুষ্টি মোকাবিলায় সমাজকর্মীর ভূমিকা
দারিদ্র্য ও অপুষ্টির সমস্যা যেহেতু পরস্পর জড়িত সেহেতু অর্থনৈতিক দিক থেকে এবং জাতীয়ভিত্তিতে পুষ্টিহীনতা সমাধানের জন্য কার্যক্রম গ্রহণ করা যেতে পারে। বাংলাদেশে যে পর্যাপ্ত মানবিক ও বৈষয়িক সম্পদ রয়েছে তা সুষ্ঠুভাবে কাজে লাগানো হলে জনগণের পুষ্টিগত সমস্যা উন্নয়ন করা সম্ভব। এক্ষেত্রে একজন সমাজকর্মী যে ভূমিকা রাখতে পারেন:
১. কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি করতে, অনাবাদী বা পতিত জমিতে চাষের ব্যবস্থা করতে ও কৃষিতে আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধি করতে সংশ্লিষ্ট বিভাগগুলোকে উদ্বুদ্ধ করা;
২. সাধারণ জনগণের মাঝে স্বাস্থ্য ও পুষ্টি বিষয়ক সচেতনতা সৃষ্টি করা;
৩. জনসংখ্যা রোধে সরকারকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে উদ্ধুদ্ধ করা;
৪. খাদ্য ও পুষ্টিবান্ধব নীতিমালা ও পরিকল্পনা প্রণয়নে সরকারকে উদ্ধুদ্ধ করা;
৫. নিম্ন আয়ের জনগোষ্ঠীর জন্য ভর্তুকি প্রদত্ত খাদ্য প্রদান ও সুষম খাদ্য বণ্টনের ব্যবস্থা করতে সরকারকে উদ্ধুদ্ধ করা;
৬. খাদ্যে ভেজাল প্রতিরোধে সামাজিক সচেতনতা তৈরি ও সরকারকে উদ্ধুদ্ধ করা;
৭. পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন ও স্বাস্থ্যসম্মত জীবনযাপনে সাধারণ জনসমষ্টিকে উদ্বুদ্ধ করা;
৮. পুষ্টিকর খাদ্যাভ্যাস গড়ে তোলা ও পুষ্টিকর খাদ্য গ্রহণে অন্তরায় সৃষ্টিকারী দৃষ্টিভঙ্গি ও মূল্যবোধসমূহ দূর করতে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলা;
৯. স্বাস্থ্যবান্ধব সচেতন জীবনযাপন করতে জনসমষ্টিকে উদ্ধুদ্ধ ও অনুপ্রাণিত করা ।
0 মন্তব্য(গুলি):
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
Comment below if you have any questions