কুরআনের আলোচ্য বিষয় কি
আল-কুরআনের আলোচ্য বিষয়:
মানব জীবনের জন্য প্রয়োজনীয় সব কিছুই আল-কুরআনে বর্ণিত হয়েছে। এ সকল বিষয়ের মধ্যে কিছু বিষয় বিস্তারিতভাবে উল্লিখিত হয়েছে আর কিছু বিষয় সংক্ষেপে উল্লেখ করা হয়েছে। এগুলোর কোন-কোনটি বিভিন্ন জাগতিক কর্ম তৎপরতার সাথে সম্পর্কিত এবং কোন কোনটি ইবাদাতের সাথে সম্পর্কিত ।
আল-কুরআনের কেন্দ্রীয় আলোচ্য বিষয় মানব জাতি। কুরআনের উদ্দেশ্য হলো মানব জাতিকে আল্লাহর দেওয়া জীবন ব্যবস্থার দিকে পথ প্রদর্শন করা, যাতে মানুষ দুনিয়ার জীবনে কল্যাণ লাভ করতে পারে এবং আখিরাতে সুখময় জীবনের অধিকরী হতে পারে।
কুরআনের প্রথমেই ঘোষণা করা হয়েছে
ذَلِكَ الْكِتَابُ لَا رَيْبَ فِيهِ هُدًى لِلْمُتَّقِينَ
এ তো সেই কিতাব ; এতে কোন সন্দেহ নেই, আল্লাহভীরু লোকদের জন্য এ কিতাব নির্দেশক” (সূরা বাকারা-২: ২) মহান আল্লাহ বলেন,
لَقَدْ أَنْزَلْنَا إِلَيْكُمْ كِتَابًا فِيهِ ذِكْرُكُمْ أَفَلَا تَعْقِلُونَ
“আমি তো তোমাদের প্রতি কিতাব নাযিল করেছি যাতে তোমাদের জন্য উপদেশ রয়েছে; তবুও কি তোমরা বুঝবে না ? ” (সূরা আম্বিয়া-২১: 10 )
আরো বর্ণিত হয়েছে-
وَلَقَدْ صَرَّفْنَا لِلنَّاسِ فِي هَذَا الْقُرْآنِ مِنْ كُلِّ مَتْلٍ فَأَبَى أَكْثَرُ النَّاسِ إِلَّا كُفُورًا
“আর অবশ্যই আমি মানুষের জন্য এ কুরআনে বিভিন্ন উপমা বিশদভাবে বর্ণনা করেছি; কিন্তু অধিকাংশ মানুষ কুফরী করা ব্যতীত ক্ষান্ত হলো না।” (সূরা বনী ইসরাইল-১৭ :৮৯)
আরো বলা হয়েছে-
شَهْرُ رَمَضَانَ الَّذِي أُنْزِلَ فِيهِ الْقُرْآنُ هُدًى لِلنَّاسِ وَبَيِّنَاتٍ مِنَ الْهُدَى وَالْفُرْقَانِ
“রামাযান মাস, এতে মানুষের দিশারী এবং সৎপথের স্পষ্ট নিদর্শন সত্যাসত্যের পার্থক্যকারীরূপে কুরআন নাযিল হয়েছে।” (সূরা বাকারা- ২: ১৮৫)
মহান আল্লাহ তা'আলা আরো বলেন-
إِنْ هُوَ إِلَّا ذِكْرٌ لِلْعَالَمِينَ
“এটা তো বিশ্বজগতের জন্য উপদেশমাত্র।” (সূরা আন'আম-৬ : ৯০)
وَنَزَّلْنَا عَلَيْكَ الْكِتَابَ تِبْيَانًا لِكُلِّ شَيْءٍ وَهُدًى وَرَحْمَةً وَبُشْرَى لِلْمُسْلِمِينَ
“আমি মুসলিমদের জন্য প্রত্যক বিষয় সুষ্পষ্ট ব্যাখ্যা স্বরূপ, পথনির্দেশ, দয়া ও সু সংবাদরূপে তোমার প্রতি কিতাব নাযিল করলাম।” (সূরা নাহল-১৬ : ৮৯)
এভাবে আরো বলা হয়েছে-
كِتَابٌ أَنْزَلْنَاهُ إِلَيْكَ لِتُخْرِجَ النَّاسَ مِنَ الظُّلُمَاتِ إِلَى النُّورِ بِإِذْنِ رَبِّهِمْ إِلَى صِرَاطِ الْعَزِيزِ الْحَمِيدِ
“এ কিতাব, এটা তোমার প্রতি নাযিল করেছি যাতে তুমি মানবজাতিকে তাদের প্রতিপালকের নির্দেশক্রমে অন্ধকার থেকে আলোর দিকে বের করে আনতে পারো, তাঁর পথে যিনি পরাক্রমশালী প্রশংসনীয়” (সূরা ইবরাহীম-১৪ : ১)
يَا أَيُّهَا النَّاسُ قَدْ جَاءَتْكُمْ مَوْعِظَةٌ مِنْ رَبِّكُمْ وَشِفَاءٌ لِمَا فِي الصُّدُورِ وَهُدًى وَرَحْمَةٌ لِلْمُؤْمِنِينَ
“হে মানব! তোমাদের প্রতি তোমাদের প্রতিপালকের নিকট হতে এসেছে উপদেশ ও তোমাদের অন্তরে যা আছে তার আরোগ্য এবং বিশ্ববাসীদের জন্য পথনির্দেশ ও রহমত” (সূরা ইউনুস- ১০ : ৫৭)
এসব আয়াতে পবিত্র কুরআনের আলোচ্য বিষয় বা উদ্দেশ্য কি, তা সুষ্পষ্টভাবে বলে দেওয়া হয়েছে। যার সার কথা হলো- • মানব জাতির উন্নতি ও কল্যাণ সাধন করাই যেহেতু পবিত্র কুরআনের মূল উদ্দেশ্য ও প্রতিপাদ্য বিষয়, তাই মানব জীবনের সকল বিভাগ নিয়েই পবিত্র কুরআনে আলোচনা করা হয়েছে। মানুষের ব্যক্তি জীবন এবং আধ্যাত্মিকতায় উৎকর্ষ সাধনের জন্য যা কিছু প্রয়োজন, ধর্ম-সংস্কৃতি-রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজনীতি, মানবাধিকার সমরনীতি, যুদ্ধ-শান্তি, সন্ধি, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ইত্যাদি যাবতীয় বিষয়ের উল্লেখ কুরআনে আছে। মূলত এসব আলোচ্য বিষয় কুরআনের কেন্দ্রীয় বিষয়বস্তুর সাথে অত্যন্ত নিবিড়ভাবে জড়িত।
আল-কুরআনের আলোচ্য বিষয়ের শ্রেণি বিভাগ
হযরত শাহ ওয়ালী উল্লাহ দেহলবী (র) পবিত্র কুরআনের আলোচ্য বিষয়সমূহকে প্রধানত পাঁচ ভাগে ভাগ করেছেন-
১.ইলমুল আহকাম বা সংবিধান সংক্রান্ত জ্ঞান
পবিত্র কুরআনে ইবাদত-বন্দেগী, পারস্পরিক মু'আমালাত, আচার-ব্যবহার, দাম্পত্য জীবন, সমাজ, রাষ্ট্র, অর্থ, যুদ্ধ-সন্ধি প্রভৃতি মানব জীবনের যাবতীয় প্রয়োজন ও বিষয় সংক্রান্ত বিধি-বিধান ও নির্দেশাবলি আলোচিত হয়েছে। ফরয, ওয়াজিব, মুস্তাহাব, হালাল-হারাম-মাকরূহ মুবাহ এবং যাবতীয় আদেশ-নিষেধ এর অন্তর্ভুক্ত।
২.ইলমুল মুখাসামা বা তৰ্ক শাস্ত্ৰ
ইয়াহুদি, খ্রিষ্টান, কাফির-মুশরিক ও মুনাফিক এ চার শ্রেণির পথভ্রষ্ট মানুষের সাথে বিতর্ক সম্পর্কিত জ্ঞান। এ পর্যায়ে তাদের আকিদা-বিশ্বাস এবং মতবাদের ভ্রান্ততা প্রমাণ করা হয়েছে। সাথে সাথে তাদের ভ্রান্ত ও অযৌক্তিক মতাদর্শের প্রতি জনমনে ঘৃণা জাগ্রত করা হয়েছে। এদের কুসংস্কার ও ভ্রান্ত মতবাদের অসারতা প্রতিপন্ন করা হয়েছে। সেগুলোর জবাব দান করা হয়েছে।
৩.ইলমুত্ তাযকীর-বি-আ'লা ইল্লাহ বা স্ৰষ্টাতত্ত্ব
বিশ্ব স্রষ্টা ও নিয়ন্তা হিসেবে মহান আল্লাহর পরিচয়, অনুগ্রহ, অবদান এবং কুদরতী নিদর্শনাবলি সম্পর্কিত জ্ঞান। এ ছাড়াও আকাশ ও পৃথিবী সৃষ্টি রহস্য, দৈনন্দিন জীবনে প্রাপ্ত বান্দার অভিজ্ঞান, সর্বোপরি স্রষ্টার সর্ববিধ গুণাবলির পরিচয় সম্পর্কিত আলোচনা সন্নিবেশিত হয়েছে।
৪.ইলমুত্ তাযকীর-বি-আইয়্যামিল্লাহ বা সৃষ্টিতত্ত্ব
আল্লাহর সৃষ্টিবস্তুর অবস্থা সংক্রান্ত জ্ঞান। এতে হক ও বাতিল, সত্য ও মিথ্যার মধ্যে অতীত সংঘর্ষ ও রেষা-রেষির ইতিহাস আলোচনা করা হয়েছে। সেই সাথে হক ও সত্যপ্রিয়তার শুভ পরিণাম, মিথ্যা ও বাতিলের শোচনীয় পরিণতি এবং মিথ্যার জন্য সতর্ক ও সাবধান করা হয়েছে।
৫.ইলমুত্ তাযকীর বিল-মাউত বা পরকাল সংক্রান্ত জ্ঞান
পবিত্র কুরআনে সৃষ্টিলোকের লয়, মানুষের মৃত্যু, অক্ষমতা এবং মৃত্যুর পর অনন্ত জীবন-জান্নাত বা জাহান্নামের দৃশ্যের প্রত্যক্ষ বর্ণনা রয়েছে। রহমত ও আযাবের ফেরেশতাদের উপস্থিতি, কিয়ামতের আলামত, হযরত ঈসা (আ) -এর অবতরণ, দাজ্জাল- ইয়াজুজ-মাজুজের আবির্ভাব, ইসরাফিলের শিঙ্গায় ফুঁকের উল্লেখ। হাশর-নশর, হিসাব-নিকাশ, পাপ- পুণ্যের জ্ঞান, আমলনামা, মু'মিনগণের আল্লাহর সাথে দীদার ইত্যাদির বর্ণনা। তাছাড়া আযাব ও শাস্তির নানা রকম ভীতিপ্রদ বর্ণনা। জান্নাতের নয়নাভিরাম দৃশ্য ও নিয়ামত রাশির বিবরণ। মানব জাতিকে আত্মসচেতন ও সদা সতর্ক করার জন্য এবং আল্লাহ তা'আলার দাসত্ব ও আনুগত্যের জন্য উৎসাহিত করাই এর মূল উদ্দেশ্য।
0 মন্তব্য(গুলি):
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
Comment below if you have any questions