ব্যাংক কাকে বলে
ব্যাংক কাকে বলে (What is meant by Bank) : ব্যাংক ব্যবসার সূচনা হয় খ্রীষ্টপূর্ব ৫,০০০ সাল থেকে। গ্রীক সভ্যতা, সিন্ধু সভ্যতা, রোম সভ্যতা, ব্যাবিলনীয় সভ্যতা, চীন সভ্যতা, মিশরীর সভ্যতা, পারস্য সভ্যতা, মেসোপটোমিয়ান সভ্যতা, বৈদিক যুগ প্রভৃতি সময়ে ব্যাংক ব্যবস্থার অসিত্মতব ছিল বলে প্রমাণ পাওয়া যায়। সভ্যতার আদি যুগে মুদ্রা ব্যবস্থা ছিল না। তখন বিনিময় প্রথা প্রচলিত ছিল। মুদ্রা ব্যবস্থার আবির্ভাবের পর থেকেই মূলত: ব্যাংক ব্যবস্থার শুরু। আধুনিক ব্যাংকের পূর্বসুরীদের মধ্যে রয়েছে মহাজন, কাবুলিওয়ালা, স্বর্ণকার, সাহুকার, শেঠী, শরাফ ইত্যাদি। এ উপমহাদেশের ব্যাংক ব্যবসার ইতিহাসও এই ধারাবাহিকতায় চলেছে।
বর্তমান আধুনিক যুগে ব্যাংক ছাড়া কোন অর্থনেতিক কর্মকান্ডে অচল বললেই চলে। ব্যাংক অন্যের টাকা নিয়ে ব্যবসা করে। ইহা জনগণের অলস অর্থ আমানত হিসেবে গ্রহণ করে এবং অন্যকে ঐ অর্থ ধার দিয়ে থাকে। আমানতের অর্থের উপর নির্দিষ্ট হারে সুদ দেয়া হয় এবং ঋণ দেয়া অর্থের উপর নির্দিষ্ট হারে সুদ নেয়া হয়। এতে বিভিন্ন ব্যবসা ও শিল্প প্রতিষ্ঠান তাদের কাজের গতি সচল রাখে। গৃহীত সুদ ও প্রদত্ত সুদের পার্থক্যই ব্যাংকের মুনাফা। বর্তমানে ব্যাংক শুধু আমানত গ্রহণ ও ঋণই প্রদান করে না। ইহা আন্তজার্তিক বাণিজ্যে ভূমিকা রাখার সাথে সাথে গ্রাহকের নানাবিধ সেবামূলক কাজ সম্পাদন করে থাকে।
ব্যাংকের সংজ্ঞা দিতে যেয়ে দেখা যায়, অভিধানে এক রকম সংজ্ঞা দেয়া হয়েছে, বিশবকোষগুলোতে একেক রকম সংজ্ঞা দেয়া রয়েছে, বিভিন্ন আইন ও অধ্যাদেশে বিভিন্নভাবে একে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে, বিভিন্ন ব্যাংকিং ইনষ্টিটিউট-এর নানাবিধ সংজ্ঞা দিয়েছে এবং বিভিন্ন পন্ডিত ও লেখক একে নিজস্ব ভঙ্গিতে সংজ্ঞায়িত করেছেন।
নিম্নে এর কিছু উদাহরণ দেয়া হল:
১. ‘‘ব্যাংক এমন একটি প্রতিষ্ঠান যা অর্থ ও মূল্যবান সামগ্রী নিরাপদে সংরক্ষণ এবং গ্রাহকের নির্দেশে অর্থ প্রদান সংক্রান্ত কাজে নিয়োজিত’’ - অক্সফোর্ড অ্যাডভ্যান্সড লার্নারস ডিক্শনারী।
২. ‘‘অর্থ গচ্ছিত রাখার জন্য ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে এ অর্থ বিনিয়োগের জন্য নিয়োজিত প্রতিষ্ঠান হল ব্যাংক’’ - সংসদ ডিকশনারী।
৩. ‘‘বাণিজ্যিক ব্যাংক হল মুদ্রা, চেক ও বিনিময় বিলের মত বিকল্প মুদ্রা ব্যবসায়ী’’ - নিউ এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকা।
৪. ‘‘যথার্থ ব্যাংকিং ব্যবসায় নিয়োজিত ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে (কর্পোরেশন) ব্যাংক বলে’’- ইংরেজ অর্থ আইন, ১৯১৫।
৫. ‘‘ব্যাংকের অন্তর্ভুক্ত হল ব্যক্তি, কর্পোরেশন বা কোম্পানী যে ব্যাংকার হিসাবে কাজ করে’’ - হস্তান্তরযোগ্য দলীল আইন, ১৮৮১।
৬. ‘‘যে প্রতিষ্ঠান মুদ্রা ব্যবসা এবং মুদ্রা সংক্রান্ত আর্থিক সেবা কাজে নিয়োজিত তাকে ব্যাংক বলে’’ - আমেরিকান ব্যাংকার্স এসোসিয়েশন।
৭. ‘‘ব্যাংক বিতরণমূলক কাজ ও সেবা সম্পাদন এবং ঋণদান ও ঋণগ্রহীতার মধ্যে একজন মধ্যস্তাকারী হিসেবে গুরুত্বপুর্ন ভূমিকা পালন করে’’ - আমেরিকান ইন্সটিটিউট অব ব্যাংকার্স।
৮. ‘‘অর্থ সংরক্ষণ, ঋণদান এবং বিনিময় কাজে নিয়োজিত অফিস বা প্রতিষ্ঠানকে বলা হয় ব্যাংক’’ - অধ্যাপক চেম্বার্স।
৯. ‘‘ব্যাংক এমন একটি প্রতিষ্ঠান যার মূল কাজ হ’ল মানুষের অব্যবহৃত অর্থ জমা রাখা এবং এ অর্থ অন্যকে ধার দেয়া’’- আর.পি.কেন্ট।
বর্তমানে ইসলামী ব্যাংকগুলি সুদের পরিবর্তে অর্থ লাভে বিনিয়োগ করে এবং আমানত হিসাবগুলিতে লাভের অংশ প্রদান করে। এসব আলোচনা ও উদ্ধৃতি বিশে-ষণ করলে আমরা বলতে পারি, ব্যাংক এমন একটি প্রতিষ্ঠান যা ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের অব্যবহৃত অর্থ আমানত হিসেবে গ্রহণ করে, লাভ বা সুদের বিনিময়ে উক্ত অর্থ বিনিয়োগ করে, বৈদেশিক বাণিজ্যে সহায়তা করে এবং এতদ্সংক্রান্ত অন্যান্য গ্রাহক সেবা প্রদান করে।
ব্যাংকের কার্যাবলী (Functions of a Bank) :
ব্যাংক মূলত: দু’ধরনের। কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও বাণিজ্যিক ব্যাংক। আমরা মূলত: বাণিজ্যিক ব্যাংকের কার্যাবলী আলোচনা করব।
নিম্নে একটি বাণিজ্যিক ব্যাংকের কার্যাবলী উল্লেখ করা হ’ল:
১. আমানত গ্রহণ (Receiving Deposit) : ব্যাংকের অন্যতম প্রধান কাজ হল জনগণের বিক্ষিপ্ত ও অলস সঞ্চিত অর্থ বিভিন্ন হিসাবে আমানত হিসেবে গ্রহণ করা। এর মাধ্যমে জনগণের অর্থ নিরাপত্তা ও লাভজনকতা প্রাপ্ত হয় এবং ব্যাংক ও বিনিয়োগযোগ্য তহবিল পেয়ে থাকে।
২. ঋণ মঞ্জুর (Sanctioning Credit) : ব্যাংকের দ্বিতীয় প্রধান কাজ হল বিভিন্ন মেয়াদে ঋণ মঞ্জুর করা। ব্যাংকের তারল্য ঠিক রেখে ব্যাংক লাভজনক খাতে ঋণ দিয়ে কাম্য লাভ অর্জন করতে পারে। ব্যাংক সাধারণত: স্বল্প মেয়াদী ঋণ দিয়ে থাকে। তবে বিশেষ সুবিধাজনক খাতে মধ্যম মেয়াদী বা দীর্ঘ মেয়াদী ঋণও বর্তমানে দিয়ে থাকে।
৩. লাভ/সুদ প্রদান ও গ্রহণ (Receiving and Paying Profit/Interest)t ব্যাংক গৃহীত আমানত বিনিয়োগের মাধ্যমে লাভ/সুদ অর্জন বা গ্রহণ করে থাকে। এ থেকে ব্যাংক আমানতের উপর লাভ/সুদ প্রদান করে এবং বাকী অর্থ ব্যাংকের লাভ হিসেবে ব্যাংককে সচল রাখে।
৪. বিনিয়োগের মাধ্যম সৃষ্টি (Creating Medium of Exchange) : ব্যাংক চেক, ড্রাফট, পে-অর্ডার, প্রত্যয়নপত্র, বিনিময় বিল, ক্রেডিট কার্ড, ট্রাভেলার্স চেক প্রভৃতি বিনিময়ের মাধ্যমে অভ্যন্তরীণ, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক লেন-দেন ও দেনা-পাওনা নিষ্পত্তি করে থাকে।
৫. আন্তুজার্তিক বানিজ্যে সহায়তা (Helping Foreign Trade) : বাণিজ্যিক ব্যাংক আমদানী ও রপ্তানী বাণিজ্যে মধ্যস্থতাকারী হিসেবে এক গুরুত্বপুর্ণ ভূমিকা পালন করে। বিনিময় বিলে স্বীকৃতি দান, বিল ভাঙ্গানো, বিভিন্ন মাধ্যমে অর্থ প্রেরণ প্রভৃতি সেবা দিয়ে ব্যাংক আমদানী-রপ্তানীকারককে সহায়তা করে থাকে।
৬. অর্থনৈতিক উন্নয়ন (Developing Economy) t ব্যাংক ব্যবসা, শিল্প, বাণিজ্য, যোগাযোগ, গৃহনির্মাণ প্রভৃতি খাতে মূলধন বিনিয়োগ করে অর্থনৈতিক উন্নয়নে বিরাট ভূমিকা রাখছে।
৭. অন্যান্য সেবামূলক কার্য সম্পাদন (Performing other Service Oriented Functions) : বাণিজ্যিক ব্যাংক দেশের শিল্প ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানকে বিশেষজ্ঞমূলক পরামর্শ প্রদান করে, দেশী-বিদেশী জনগণের মধ্যে সেতু বন্ধন রচনা করে, মক্কেলদের অছি ও জামিনদার হিসেবে কাজ করে, প্রতিনিধিত্বমূলক কাজ করে, কোম্পানির শেয়ার অবলেখন (underwriting) করে থাকে, ব্যবসায়িক সুষ্ঠু পরিবেশ রক্ষায় তথ্য প্রদান করে এবং কর্মসংস্থানে বিরাট ভূমিকা রাখে।
0 মন্তব্য(গুলি):
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
Comment below if you have any questions