দুতরফা দাখিলা পদ্ধতি কাকে বলে
দু’তরফা দাখিলা পদ্ধতি (Double Entry System)
প্রতিটা লেনদেন ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানের দুটি দিককে সমপরিমাণে এবং বিপরীতভাবে প্রভাবিত করে। যে পদ্ধতিতে উপরোক্ত প্রভাব সৃষ্টিকারী দুটি দিক বা পক্ষকে একই সংগে হিসাবভুক্ত করা হয় তাকে দু’তরফা দাখিলা পদ্ধতি বলে।
হিসাববিজ্ঞানের দ্বৈতসত্তা ধারণা অনুযায়ী প্রতিটি লেনদেনে দুটি পক্ষ বা হিসাব সংশি-ষ্ট থাকে। এক পক্ষ সুবিধা গ্রহণ করে (Debtor) এবং অপর পক্ষ সুবিধা প্রদান করে (Creditor)। যে হিসাব পদ্ধতিতে প্রতিটি লেনদেনের দুটি পক্ষ বা হিসাবের একটিকে ডেবিট ও অন্যটিকে ক্রেডিট করে হিসাবের বইতে লিপিবদ্ধ করা হয় তাকে দু’তরফা দাখিলা পদ্ধতি বলে। যেমনঃ নগদ মূল্যে ২০,০০০ টাকার পণ্য বিক্রয় করা হল। এখানে সংশি-ষ্ট হিসাব দুটি হলঃ নগদান হিসাব ও বিক্রয় হিসাব। একটি হিসাবকে (নগদান হিসাব) ডেবিট ও অন্যটিকে (বিক্রয় হিসাব) ক্রেডিট করে হিসাবভুক্ত করা হয়। এই পদ্ধতিই দু’তরফা দাখিলা পদ্ধতি। লেনদেনের মধ্যস্থিত একটি হিসাব ডেবিট হলে অপরটি সমপরিমাণ টাকার অংকে ক্রেডিট হবে। আবার একটি ক্রেডিট হলে অপরটি ডেবিট হবে।
দু’তরফা দাখিলা পদ্ধতি একটি পূর্ণাঙ্গ বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতি। ইতালীয় ধর্মযাজক ও গণিতশাস্তবিদ লুকা ডি প্যাসিওলি প্রথম দু’তরফা দাখিলা পদ্ধতির উপর বই লিখেন। যুগের চাহিদা ও পরিবর্তনশীল ব্যবসায় জগতের প্রয়োজনে হিসাববিজ্ঞানের প্রভূত উন্নতি সাধিত হলেও দু’তরফা দাখিলা পদ্ধতিই মূলভিত্তি হিসাবে পরিগণিত।
সংক্ষেপে বলা যায়, যে হিসাব ব্যবস্থায় ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের প্রতিটি লেনদেনকে দ্বৈতসত্তায় বিশ্লেষণ করে সম অংকের টাকা দ্বারা একটি হিসাব পক্ষকে ডেবিট ও অন্য হিসাব পক্ষকে ক্রেডিট করে হিসাবভুক্ত করা হয় তাকে দু’তরফা দাখিলা পদ্ধতি বলে।
দু’তরফা দাখিলা পদ্ধতির বৈশিষ্ট্য (Features of Double Entry System):
বর্তমান শতাব্দীতেও দু’তরফা দাখিলা পদ্ধতি বিশেব একমাত্র নির্ভরযোগ্য ও সর্বোত্তম হিসাব পদ্ধতিরূপে গণ্য হয়ে আসছে। এ হিসাব পদ্ধতির কিছু মূলনীতি বা বৈশিষ্ট্য রয়েছে যার জন্য এটা অন্যান্য হিসাব পদ্ধতি থেকে বেশী গ্রহণযোগ্য।
নিমেণ দু’তরফা দাখিলা পদ্ধতির মূলনীতি বা বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করা হলঃ
১. দুটি পক্ষ নির্ণয়ঃ দু’তরফা দাখিলা পদ্ধতি অনুযায়ী প্রতিটি লেনদেনের সংশি-ষ্ট পক্ষ বা হিসাব দুটি নির্ণয় করে তারপর হিসাবভুক্ত করতে হয়।
২. দাতা ও গ্রহীতাঃ লেনদেনে সংশি-ষ্ট পক্ষ বা হিসাব দুটির একটি সুবিধা গ্রহণ করে এবং অন্যটি সুবিধা প্রদান করে। সুবিধা গ্রহণকারী পক্ষকে গ্রহীতা (উবনরঃ) এবং সুবিধা প্রদানকারী পক্ষকে দাতা (Credit) বলা হয়।
৩. ডেবিট ও ক্রেডিটঃ দু’তরফা দাখিলা পদ্ধতিতে প্রতিটা হিসাবের ডেবিট ও ক্রেডিট নির্ণয় করে হিসাবভুক্ত করা হয়। হিসাবের বাম দিককে ডেবিট এবং ডান দিককে ক্রেডিট বলে। লেনদেনের এক পক্ষ ডানদিকে লিপিবদ্ধ করলে অপরটি বাম দিকে লিপিবদ্ধ করা হয়।
৪. সমমূল্যের লেনদেনঃ প্রতিটি লেনদেনের দাতা যে পরিমাণ অর্থ মূল্যের সুবিধা প্রদান করে গ্রহীতা সমপরিমাণ অর্থ মূল্যের সুবিধা গ্রহণ করে। অর্থাৎ ডেবিট ও ক্রেডিট সর্বদাই সমপরিমাণ অর্থ মূল্যের হয়ে থাকে।
৫. পৃথক সত্তাঃ দু’তরফা দাখিলা পদ্ধতিতে ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানকে মালিক থেকে পৃথক বলে বিবেচনা করা হয়। অর্থাৎ ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান কৃত্রিম ব্যক্তি সত্তা বলে গণ্য হয়।
৬. নির্ভুল হিসাবঃ এই পদ্ধতিতে হিসাব রাখলে রেওয়ামিল প্রস্তুত করে হিসাবের গাণিতিক শুদ্ধতা যাচাই করা যায়।
৭. বিস্তারিত ও নির্ভরযোগ্য তথ্যঃ এই পদ্ধতিতে সমস্ত লেনেদেনের সঠিক হিসাব রাখা হয় এবং হিসাব থেকে বিস্তারিত ও নির্ভরযোগ্য তথ্য লাভ করা যায়।
৮. বিজ্ঞানসম্মত পূর্ণাঙ্গ হিসাব ব্যবস্থাঃ এই পদ্ধতিতে হিসাব রাখার ক্ষেত্রে বৈজ্ঞানিক সূত্রসমূহ (যেমন, হিসাব সমীকরণ) প্রয়োগ করা হয় এবং আর্থিক বিবরণীসমূহ প্রস্তুত করে ব্যবসায়ের কার্যফল ও আর্থিক অবস্থা জানা যায়।
দু’তরফা দাখিলা পদ্ধতির সুবিধা (Advantages of Double Entry System):
দু’তরফা দাখিলা পদ্ধতি হিসাব রাখার একমাত্র বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতি। এ পদ্ধতিতে হিসাব রাখলে অনেক ব্যবহারিক সুবিধা পাওয়া যায়। ছোট, বড় ব্যবসায়ি, অব্যবসায়ী সব ধরনের প্রতিষ্ঠানেই এ পদ্ধতিতে হিসাব রাখা যায়।
নিম্নে দু’তরফা দাখিলা পদ্ধতির সুবিধা বর্ণনা করা হল:
১. লেনদেনের পরিপূর্ণ হিসাবঃ এ পদ্ধতিতে লেনদেনের দুটি পক্ষকে স্থায়ীভাবে সংরক্ষণ করা হয় বলে নির্দিষ্ট সময়ান্তে প্রতিটি লেনদেনের প্রকৃতি, পরিমাণ ও ফলাফল নির্ভরযোগ্য উপায়ে নির্ণয় করা যায়।
২. গাণিতিক শুদ্ধতা যাচাইঃ এ পদ্ধতিতে প্রত্যেকটি লেনদেনের এক পক্ষকে ডেবিট ও অপর পক্ষকে সমপরিমাণ অর্থে ক্রেডিট করে লিপিবদ্ধ করা হয়। ফলে সমস্ততলেনদেনের মোট ডেবিটের পরিমাণ মোট ক্রেডিটের সমান হতে বাধ্য। কোন নির্দিষ্ট সময় পর রেওয়ামিল প্রস্তুত করে হিসাবের গাণিতিক শুদ্ধতা যাচাই করা যায়।
৩. আর্থিক ফলাফল নির্ণয়ঃ দু’তরফা দাখিলা পদ্ধতিতে ব্যবাসায়ের মুনাফাজাতীয় আয়-ব্যয় সংক্রান্তত লেনদেনগুলোর পরিপূর্ণ হিসাব রাখা হয়। ফলে বছর শেষে ক্রয়-বিক্রয় ও লাভ-লোকসান হিসাব প্রস্তুত করে ব্যবসায়ের মোট ও নীট লাভ বা লোকসান নির্ণয় করা যায়।
৪. আর্থিক অবস্থা নির্ণয়ঃ আর্থিক অবস্থা বলতে ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানের চলতি ও স্থায়ী সম্পদ, মূলধন ও দায়ের পরিমাণকে বুঝায়। দু’তরফা দাখিলা পদ্ধতিতে লেনদেনের পরিপূর্ণ হিসাব রাখা হয়। ফলে হিসাবকাল শেষে উদ্বৃত্তপত্র প্রস্তুত করে আর্থিক অবস্থা নির্ণয় করা যায়।
৫. দেনা-পাওনা নির্ধারণঃ দু’তরফা দাখিলা পদ্ধতিতে সমস্ততব্যক্তিক হিসাবগুলো সঠিকভাবে রাখা হয়। ফলে দেনাদার পাওনাদার ও ঋণ সংক্রান্তত দায়ের পরিমাণ জানা যায় এবং নিসত্তিতে সুবিধা হয়।
৬. তুলনামূলক বিশ্লেষণঃ এ পদ্ধতিতে পূর্ণাংঙ্গ হিসাব সংরক্ষণ করা হয়। ফলে বিভিন্ন বৎসরের কার্যফল ও আর্থিক অবস্থা তুলনা করে ভবিষ্যত কর্মপন্থা নির্ধারণ করা সহজ হয়।
৭. ব্যয় নিয়ন্ত্রণঃ এ পদ্ধতিতে ব্যয় সংক্রান্ত সকল হিসাব সঠিকভাবে রাখা হয়। ফলে কোন খাতের কত ব্যয় হওয়া উচিত তা প্রকৃত ব্যয়ের সাথে তুলনা করে ব্যয় নিয়ন্ত্রণের পদক্ষেপ নেয়া যায়।
৮. আয়কর, ভ্যাট ও অন্যান্য কর নির্ধারণঃ এ পদ্ধতিতে সকল আয় ব্যয়ের সঠিক হিসাব রাখা হয় যার ভিত্তিতে আয়কর, ভ্যাট ও অন্যান্য কর বিবরণী প্রস্তুত করা সহজ হয় এবং তা কর কর্তৃপক্ষের কাছে গ্রহণযোগ্য হয়।
৯. ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের দক্ষতা বিচারঃ এ পদ্ধতিতে প্রস্তুতকৃত আর্থিক বিবরণী ও প্রতিবেদন থেকে হিসাব সংক্রান্তত বিভিন্ন অনুপাতের সাহায্যে মুনাফা অর্জন, সম্পদ ব্যবহার ও দায় পরিশোধের ক্ষমতা ও দক্ষতা বিচার করা সম্ভব।
১০. মূল্য নির্ধারণঃ এ প্রক্রিয়ায় হিসাব সংরক্ষণ করলে ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের বাণিজ্যিক পণ্যমূল্য ও অন্যান্য সম্পত্তির মূল্য নির্ধারণ সহজ হয়।
১১. ভুল ও জালিয়াতি উদ্ঘাটন ও প্রতিরোধঃ লেনদেনের উভয় পক্ষের হিসাব সংরক্ষিত হয় বলে ভুল ও জালিয়াতি সহজেই ধরা পড়ে এবং প্রতিরোধের ব্যবস্থা নেয়া যায়।
১২. তথ্য সরবরাহঃ ভবিষ্যত কর্মপন্থা নির্ধারণ, সিদ্ধান্তত গ্রহণ ও নিয়ন্ত্রণের জন্য প্রয়োজনীয় ও নির্ভরযোগ্য তথ্য এ পদ্ধতিতে রক্ষিত হিসাব থেকে প্রণীত বিবরণী ও প্রতিবেদনের মাধ্যমে সহজেই লাভ করা যায়।
১৩. জবাবদিহিতা সৃষ্টিঃ এ পদ্ধতিতে রক্ষিত হিসাব নির্ভরযোগ্য ও বিজ্ঞানসম্মত হওয়ায় প্রতিষ্ঠানে কর্মরত কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের দায়িতব ও কর্তব্য পালনে জবাবদিহিতা সৃষ্টিতে বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করে।
১৪. সহজ প্রয়োগঃ এ পদ্ধতিতে বিজ্ঞানসম্মত পন্থায় ও স্বর্ণসূত্রের সাহায্যে লেনদেন বিশ্লেষণ করে হিসাবের বইতে লিপিবদ্ধকরণ অত্যন্তত সহজ। ফলে সব ধরনের প্রতিষ্ঠানে এটি সহজেই প্রয়োগ করা যায়।
0 মন্তব্য(গুলি):
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
Comment below if you have any questions