হিসাব বিজ্ঞান কাকে বলে
ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানের মূল উদ্দেশ্য মুনাফা অর্জন করা। কোন নির্দিষ্ট সময়ে একটি ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান মুনাফা অর্জন করেছে না ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে তা জানা অপরিহার্য। তাছাড়া প্রতিষ্ঠানের আর্থিক লেন-দেনসমূহের সঠিক হিসাব রাখা, আর্থিক অবস্থা, সম্পত্তি ও মূলধনের পরিমাণ প্রভৃতি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য জানা প্রয়োজন হয়। হিসাববিজ্ঞানের সাহায্যে এই সমস্ত গুরুত্বপূর্ণ তথ্য সংগ্রহ, প্রক্রিয়াকরণ ও পরিবেশন করা যায়। ব্যবস্থাপক কর্তৃক এই সমস্ত তথ্য সঠিক বিশ্লেষণ ও ব্যবহারের উপর প্রতিষ্ঠানের সফলতা নির্ভর করে। তাই হিসাববিজ্ঞান ব্যবসায় ব্যবস্থাপনার মৌলিক উপাদান হিসেবে স্বীকৃত।
ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান ছাড়াও সরকারি, স্বায়ত্বশাসিত, এনজিও এবং অ-মুনাফাভোগী প্রতিষ্ঠানে তথা ব্যক্তিক, পারিবারিক, সামাজিক, ধর্মীয়, রাষ্ট্রীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ের প্রতিটি ক্ষেত্রে আর্থিক লেনদেন লিখে রাখা, আর্থিক অবস্থা, লাভক্ষতি ও দেনা-পাওনা সম্পর্কে ধারণা দেওয়াই হিসাববিজ্ঞানের উদ্দেশ্য।
তথ্য প্রযুক্তি ও মুক্ত বাজার অর্থনীতির কারণে পৃথিবী এখন ‘গ্লোবাল ভিলেজ’-এর আকৃতি ধারণ করেছে। প্রতিযোগিতামূলক ও গতিময় বিশ্বের প্রত্যেকটি প্রতিষ্ঠানের অস্তিত্ব সংরক্ষণ, উন্নয়ন ও বিকাশের জন্য আর্থিক কর্মকান্ডের লিখন, প্রক্রিয়াকরণ ও তথ্য পরিবেশনে হিসাববিজ্ঞানের উপযোগিতা ক্রমেই বাড়ছে। শুধু তাই নয় হিসাববিজ্ঞানের প্রয়োগ ক্ষেত্রেও সংযোজিত হচ্ছে নতুন মূলনীতি, পদ্ধতি, সূত্র ও কৌশল। মালিক, বিনিয়োগকারী, দেনাদার, পাওনাদার, ছাত্র, গবেষক, সরকার, সংবাদ মাধ্যম, কর কর্তৃপক্ষ ইত্যাদিকে প্রতিষ্ঠানের আর্থিক অবস্থা, দেনাপাওনা, লাভক্ষতি, সম্পত্তি, মূলধন সহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ তথ্য জানতে হয়। তথ্যগুলো অবশ্যই প্রাসঙ্গিক, বিশ্বাসযোগ্য, নিরপেক্ষ, সময়োপযোগী, সামঞ্জস্যপূর্ণ, বস্তুনিষ্ঠ, তুলনামূলক ও বোধগম্য হওয়া প্রয়োজন। এই সমস্ত তথ্য সংগ্রহ, প্রক্রিয়াকরণ ও সরবরাহই হিসাববিজ্ঞানের প্রধান কাজ। কম্পিউটার আবিষ্কার ও প্রয়োগের ফলে হিসাববিজ্ঞানের কলাকৌশল ও প্রযুক্তিগত উন্নতি সাধিত হয়েছে। যদিও হিসাববিজ্ঞানের ভিত্তি দু’তরফা দাখিলা পদ্ধতি যা ১৪৯৪ সালে ইতালীর ভেনিস শহরে লুকা প্যাসিওলি (Luca Pacioli) কর্তৃক প্রথম প্রবর্তিত হয়।
হিসাববিজ্ঞানের সংজ্ঞা (Definition of Accounting):
হিসাববিজ্ঞান শব্দটি ‘হিসাব’ ও ‘বিজ্ঞান’ শব্দ দুটির সম্মিলিত রূপ। আভিধানিক অর্থে হিসাব বলতে গণনা বুঝায়। পারিভাষিক হিসাব বলতে অর্থের দ্বারা পরিমাপযোগ্য ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের সম্পত্তি, দায় ও আয়-ব্যয় সংক্রান্ত লেনদেনের বিবরণকে বুঝায়। অন্যদিকে বিজ্ঞান বলতে কোন বিষয়ে সুসংবদ্ধ ও সুশৃংখল জ্ঞানকে বুঝায়। সুতরাং ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের আর্থিক লেনদেন সুশৃংখলভাবে লিপিবদ্ধকরণ, সংরক্ষণ, আর্থিক ফলাফল ও অবস্থা নির্ণয় এবং বিশ্লেষণ করার সুসংবদ্ধ জ্ঞানকে হিসাববিজ্ঞান বলে।
খ্যাতনামা হিসাববিদ ও সংস্থা হিসাববিজ্ঞানের সংজ্ঞা কিভাবে দিয়েছেন তা নিয়ে আলোচনা করি:
A. W. Johnson এর মতে, ‘‘অর্থের মাপকাঠিতে পরিমাপযোগ্য ব্যবসায়িক লেনদেনসমূহের সংগ্রহ, সংরক্ষণ, সুসংবদ্ধ লিপিবদ্ধকরণ, আর্থিক প্রতিবেদন প্রস্তুতকরণ ও বিশ্লেষণ ও বিশদ ব্যাখ্যাকরণকে হিসাববিজ্ঞান বলে। এ সকল প্রতিবেদন থেকে প্রাপ্ত তথ্যসমূহ ব্যবসার পরিচালকগণকে ভবিষ্যত ব্যবসা পরিচালনা বিষয়ে নির্দেশ দিয়ে থাকে।’’
Prof. H. Chakrabarty বলেন, ‘‘হিসাববিজ্ঞান হল স্থির ও গতিময় রীতিতে সম্পদ পরিমাপের একটি বিজ্ঞান যা অবরোহ পদ্ধতির প্রায়োগিক ও সামাজিক নিয়মে গৃহীত তথ্য, নীতি, মতবাদ ও নিয়মাবলীর আওতায় আর্থিক লেনদেন লিপিবদ্ধকরণ, শ্রেণীবদ্ধকরণ, সংক্ষিপ্তকরণ ও আর্থিক অবস্থার সামগ্রিক বিচার বিশ্লেষণ করে থাকে।’’
American Accounting Association (AAA) -এর সংজ্ঞাটি সর্বাধুনিক ও উলে-খযোগ্য : ‘‘তথ্য ব্যবহারকারীগণের তথ্য নির্ভর বিচার ও সিদ্ধান্ত গ্রহণে সহায়তার জন্য যে প্রক্রিয়ায় অর্থনৈতিক তথ্য নির্ণয়, পরিমাপ ও সরবরাহ করা হয় তাকে হিসাববিজ্ঞান বলে।’’
অতএব হিসাববিজ্ঞান হল এমন একটি কলাকৌশল বিশিষ্ট সামাজিক বিজ্ঞান যার সাহায্যে স্বীকৃত রীতিনীতি অনুসারে ব্যবসায়ী, অব্যবসায়ী ও রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের সকল প্রকার আর্থিক লেনদেনসমূহকে প্রকৃতি ও তারিখ অনুসারে সুসংবদ্ধভাবে লিপিবদ্ধকরণ, সংরক্ষণ, শ্রেণীবদ্ধকরণ ও সংক্ষেপণ এবং বিশ্লেষণের মাধ্যমে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য আয়-ব্যয়, লাভ-ক্ষতি, সম্পত্তি-দায় ইত্যাদির বিবরণ প্রস্তুত ও বাখ্যা করা যায় এবং ব্যবস্থাপনা, বিনিয়োগকারী ও অন্যান্য আগ্রহী পক্ষকে প্রয়োজনীয় তথ্য সরবরাহ করে পরিকল্পনা ও সিদ্ধান্ত গ্রহণে সাহায্য করা সম্ভব হয়।
হিসাববিজ্ঞানের উদ্দেশ্য (Objective of Accounting)
হিসাববিজ্ঞান একটি সেবামূলক কর্মকান্ড। এর উদ্দেশ্য বহুবিধ। মূলত: প্রতিষ্ঠানের সংঘটিত লেনদেন হিসাবভুক্তকরণ, ফলাফল ও আর্থিক অবস্থা নির্ণয় এবং মূল্যায়ন ও বিশ্লেষণ সংক্রান্ত তথ্য স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন পক্ষকে সরবরাহ করাই হিসাববিজ্ঞানের প্রধান উদ্দেশ্য।
নিম্নে হিসাববিজ্ঞানের উদ্দেশ্যগুলো সম্পর্কে আলোকপাত করা হলো-
১. আর্থিক লেনদেনের স্থায়ী হিসাব সংরক্ষণঃ প্রতিদিনের অসংখ্য লেনদেন দীর্ঘকাল মনে রাখা সম্ভব নয়। তাছাড়া আর্থিক ফলাফল নির্ণয়ের জন্যও লেনদেন লিপিবদ্ধ করা প্রয়োজন। তাই হিসাববিজ্ঞানের প্রাথমিক উদ্দেশ্য হলো আর্থিক লেনদেন জাবেদায় ধারাবাহিকভাবে লিপিবদ্ধ করা এবং পরে স্থায়ীভাবে খতিয়ানে হিসাব সংরক্ষণ করা।
২. কার্যক্রমের ফলাফল নির্ণয়ঃ নির্দিষ্ট সময় পর মালিক ও অন্যান্য স্বার্থ সংশ্লিষ্ট পক্ষ প্রতিষ্ঠানের আর্থিক কার্যক্রমের ফলাফল জানতে চায়। ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানের জন্য লাভ-লোকসান হিসাব ও অব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানের জন্য আয়-ব্যয় হিসাব প্রস্তুত করে আর্থিক কার্যক্রমের ফলাফল নির্ণয় করা হিসাববিজ্ঞানের অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য।
৩. প্রতিষ্ঠানের আর্থিক অবস্থা নিরূপণঃ আর্থিক অবস্থা নিরূপণ করা হিসাববিজ্ঞানের আর একটি প্রধান উদ্দেশ্য। প্রতিষ্ঠানের দায়-দেনা, মূলধন, চলতি সম্পত্তি, স্থায়ী সম্পত্তি ইত্যাদির পরিমাণ নির্ধারণ করার জন্য হিসাব বৎসর শেষে নির্দিষ্ট দিনে উদ্বৃত্তপত্র (Balance sheet) প্রস্তুত করা হয়। আর্থিক বিবরণীর এই অংশ আর্থিক অবস্থা নির্দেশ করে।
৪. কার্যক্রম মূল্যায়ন ও নীতি নির্ধারণঃ আর্থিক বিবরণীসমূহের বিশ্লেষণ ও ব্যাখ্যাকরণ এবং প্রয়োজনীয় আর্থিক তথ্য সরবরাহের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম মূল্যায়নে ও নীতি নির্ধারণে ব্যবস্থাপনাকে সহায়তা করা হিসাববিজ্ঞানের অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য।
৫. কার্যক্রম ও দেনাপাওনা সম্পর্কে অবহিতকরণঃ দৈনন্দিন লেনদেন, ক্রয়বিক্রয় ও দেনাপাওনা সম্পর্কে অবহিত করা হিসাববিজ্ঞানের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উদ্দেশ্য।
৬. হিসাববিজ্ঞানের শুদ্ধতা যাচাইকরণঃ প্রতিটি লেনদেন দু’তরফা দাখিলা পদ্ধতি অনুসারে লিপিবদ্ধ করা হয়। হিসাবের গাণিতিক শুদ্ধতা যাচাই করার উদ্দেশ্যে রেওয়ামিল প্রস্তুত করা হয়।
৭. হিসাববিজ্ঞানে ভুল ও জালিয়াতি উদ্ঘাটনঃ সংরক্ষিত হিসাবসমূহের নিরীক্ষার মাধ্যমে ভুল ও জালিয়াতি উদ্ঘাটন ও প্রতিরোধ হিসাববিজ্ঞানের উদ্দেশ্য।
৮. কর নির্ধারণঃ হিসাববিজ্ঞানের উদ্দেশ্য হলো সুষ্ঠুভাবে হিসাব সংরক্ষণের মাধ্যমে আয়কর, VAT ও অন্যান্য কর নির্ধারণ কর্তৃপক্ষকে সহায়তা করা।
৯. আইনগত বিধি নিষেধ পালনঃ সব ধরনের প্রতিষ্ঠানকে আইনগত বিধি-নিষেধ মেনে চলার জন্য সঠিকভাবে হিসাব সংরক্ষণ করতে হয়। অংশিদারী, কোম্পানি, বাণিজ্য, আয়কর, সিকিউরিটি ও এক্সচেঞ্জ ইত্যাদি বিভিন্ন ধরনের আইনের জন্য ব্যবসা প্রতিষ্ঠানকে সঠিকভাবে হিসাব রাখতে হয়।
১০.মূল্যবোধ ও জবাবদিহিতা সৃষ্টিঃ হিসাববিজ্ঞানের অন্যতম উদ্দেশ্য হচ্ছে ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের মধ্যে উন্নত মূল্যবোধ জাগ্রত করা এবং হিসাবে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা।
হিসাববিজ্ঞানের পরিধি (Scope of Accounting):
হিসাববিজ্ঞানের আওতা বা পরিধি শুধুমাত্র ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের লেনদেনসমূহের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয় বরং সকল শ্রেণীর প্রতিষ্ঠান, এমনকি ব্যক্তি ও পারিবারিক পর্যায় পর্যন্ত বিস্তৃত। যেখানেই আর্থিক লেনদেন সংঘটিত হয় সেখানেই হিসাববিজ্ঞান প্রয়োজন। অতএব হিসাববিজ্ঞানের পরিধি অত্যন্ত ব্যাপক।
হিসাববিজ্ঞানের কার্যক্ষেত্র বা পরিধি সম্পর্কে নিম্নে আলোচনা করা হলোঃ
১. ব্যক্তিগত ও পারিবারিক জীবনেঃ প্রত্যেক ব্যক্তি বিভিন্ন কাজ ও লেনদেন থেকে অর্থ উপার্জন করে এবং পারিবারিক কলাণে ব্যয় করে। এই আয়-ব্যয়ের হিসাব সংরক্ষণের জন্য হিসাববিজ্ঞানের নীতি ও পদ্ধতি প্রয়োজন হয়।
২. ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানেঃ ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানের মূল উদ্দেশ্য হল মুনাফা অর্জন। মুনাফা অর্জিত হয়েছে কিনা ও আর্থিক অবস্থা জানার জন্য হিসাববিজ্ঞানের প্রয়োগ অপরিহার্য। তাছাড়া ব্যবসায়ের কার্যক্রম মূল্যায়ন, নিয়ন্ত্রণ ও সম্প্রসারণের সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রেও হিসাববিজ্ঞানের সাহায্য প্রয়োজন।
৩. অব্যবসায় প্রতিষ্ঠানেঃ স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা, মন্দির, ক্লাব, সমিতি, হাসাপাতাল, পাবলিক লাইব্রেরি, এনজিও, সমবায় সমিতি ইত্যাদি প্রতিষ্ঠানে আর্থিক লেনদেন সংঘটিত হয়। ফলে এ সব প্রতিষ্ঠানেও হিসাববিজ্ঞান দরকার।
৪. সরকারি প্রতিষ্ঠানের জন্যঃ সরকারের বিভিন্ন বিভাগ, মন্ত্রণালয়, অফিস আদালত, রাষ্ট্রীয় সংস্থা, কর্পোরেশন, আধাসরকারি ও স্বায়ত্বশাসিত সংস্থা ইত্যাদির সুষ্ঠু হিসাব সংরক্ষণের জন্য হিসাববিজ্ঞানের নীতিও পদ্ধতি প্রয়োগ করা হয়।
৫. পেশাজীবিদের জন্যঃ চার্টার্ড একাউটেন্ট, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, কর উপদেষ্টা, কনসালটেন্ট, এ্যাডভোকেট ইত্যাদি পেশার ব্যক্তিরা আয়-ব্যয়ের সঠিক হিসাব সংরক্ষণ ও কর নির্ধারণের জন্য হিসাববিজ্ঞান প্রয়োগ করে।
বর্তমান বিশ্বায়নের যুগে ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানের ধরন ও আয়তন পরির্তন হচ্ছে। ব্যবসার জটিলতা বাড়ছে এবং সেসাথে প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়ছে। তথ্য প্রযুক্তি ও যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি এবং স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতা বৃদ্ধির ফলে হিসাববিজ্ঞানের প্রয়োজনীয়তা বাড়ছে। তাই হিসাববিজ্ঞানের পরিধিও ব্যাপকতর হচ্ছে। বিভিন্ন ধরনের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের প্রয়োজনে হিসাববিজ্ঞানের বিশেষ বিশেষ শাখার উদ্ভব ঘটেছে।
নিম্নে হিসাববিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখার সংক্ষিপ্ত বর্ণনা দেওয়া হল:
আর্থিক হিসাববিজ্ঞান (Financial Accounting):
কোন প্রতিষ্ঠানের আর্থিক লেনদেনসমূহ লিবিপদ্ধ করে নির্দিষ্ট সময় অন্তর ফলাফল ও আর্থিক অবস্থা নির্ণয় করা আর্থিক হিসাববিজ্ঞানের প্রধান কাজ। এই উদ্দেশ্যে, বিভিন্ন আর্থিক বিবরণী, প্রতিবেদন ও বিবৃতি প্রস্তুত করে স্বার্থ সংশ্লিষ্ট পক্ষসমূহকে সরবরাহ করে।
ব্যবস্থাপনা হিসাববিজ্ঞান (Management Accounting):
প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনাকে দৈনন্দিন সিদ্ধান্ত গ্রহণ, ভবিষ্যত পরিকল্পনা প্রণয়ন ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় তথ্য সরবরাহ করা হিসাববিজ্ঞানের এই শাখার কাজ।
নিরীক্ষাশাস্ত্র (Auditing):
আর্থিক লেনদেনসমূহ লিপিবদ্ধকরণ, আর্থিক প্রতিবেদন ও বিবরণী প্রস্তুতকরণ সঠিকভাবে সম্পন্ন হয়েছে কিনা তা পরীক্ষা করে ভুল ও জালিয়াতি উদঘাটন করা ও প্রতিরোধ করা হিসাবিজ্ঞানের এই শাখার কাজ। পৃথিবীর প্রায় সকল দেশেই সনদপ্রাপ্ত পেশাদারী একাউনটেন্ট স্বাধীনভাবে নিরীক্ষা কার্য সম্পাদন করেন।
উৎপাদন ব্যয় হিসাববিজ্ঞান (Cost Accounting):
উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের উৎপাদিত পণ্য বা সেবার উৎপাদন ব্যয় নির্ধারণ, বিশ্লেষণ ও নিয়ন্ত্রণ উৎপাদন ব্যয় হিসাববিজ্ঞানের প্রধান কাজ।
কর হিসাববিজ্ঞান (Tax Accounting):
প্রতিষ্ঠানের নির্দিষ্ট সময় পর আয়কর ও অন্যান্য কর নির্ধারণ ও বিভিন্ন লেনদেনের উপর করের প্রভাব সম্পর্কে ব্যবস্থাপনাকে অবহিত করা কর হিসাববিজ্ঞানের প্রধান কাজ।
সরকারি ও অব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানের হিসাববিজ্ঞান (Accounting for Government and Non-trading Concern):
এই সমস্ত প্রতিষ্ঠান ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান থেকে পৃথক। মুনাফা অর্জন এগুলোর উদ্দেশ্য নয় বরং উদ্দেশ্য হল সেবা প্রদান করা। এই সমস্ত প্রতিষ্ঠানের লেনদেনসমূহ লিবিপদ্ধ করে হিসাববিরণী প্রস্তুত করাই হিসাববিজ্ঞানের এই শাখার কাজ।
হিসাববিজ্ঞানের প্রয়োজনীয়তা (Importance of Accounting):
কোন আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রমের ফলাফল নিরূপণ, গতি প্রকৃতি নির্ধারণ, আর্থিক অবস্থা নিরূপণ ও ব্যবস্থাপনার সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য হিসাববিজ্ঞানের সাহায্য অতি অপরিহার্য।
নিম্নে হিসাববিজ্ঞানের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে আলোকপাত করা হলোঃ
১। স্থায়ী হিসাব সংরক্ষণঃ প্রতিদিন ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানে অনেক লেনদেন সংঘটিত হয় যার বিবরণ অনেক দিন পর্যন্ত মনে রাখা সম্ভব নয়। এ সব লেনদেন হিসাবের বইতে স্থায়ীভাবে লিপিবদ্ধ ও সংরক্ষণ করার কলাকৌশল হিসাববিজ্ঞান শিক্ষা দেয়।
২। প্রতিষ্ঠানের আর্থিক ফলাফল নির্ণয়ঃ ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানের প্রধান উদ্দেশ্য হলো মুনাফা অর্জন। এই উদ্দেশ্য কতটা অর্জিত হয়েছে নির্দিষ্ট সময় পর তা জানা প্রয়োজন। হিসাববিজ্ঞান আর্থিক লেনদেনের সুষ্ঠু হিসাব রেখে ও হিসাব কাজ শেষে আর্থিক বিবরণ প্রস্তুত করে ফলাফল নির্ণয় করে থাকে।
৩। আর্থিক অবস্থা নিরূপণঃ হিসাববিজ্ঞান কোন নির্দিষ্ট সময়ে প্রতিষ্ঠানের উদ্বৃত্তপত্র (Balance sheet) প্রস্তুত করে আর্থিক অবস্থা তথা মূলধন, দেন-পাওনা, চলতি সম্পদ, স্থায়ী সম্পদ, হাতে নগদ ইত্যাদি সম্পর্কে জানতে সহায়তা করে।
৪। ফলাফল ও আর্থিক অবস্থার তুলনাঃ প্রতিষ্ঠানের সঠিক কার্যক্রম গ্রহণ ও সম্প্রসারণ পরিকল্পনার জন্য এবং অন্যান্য প্রতিযোগী সংগঠনের ফলাফল ও আর্থিক অবস্থার তুলনামূলক পর্যালোচনার প্রয়োজন হয় যা হিসাববিজ্ঞানের সহায়তা ছাড়া সম্ভব নয়।
৫। ভুল-জালিয়াতির উদঘাটন ও প্রতিরোধঃ সঠিকভাবে হিসাব সংরক্ষণ করলে রেওয়ামিল প্রস্তুত করে হিসাবের গাণিতিক শুদ্ধতা যাচাই করা যায়। তাছাড়া নিরীক্ষাশাসভুল ও জালিয়াতি উদ্ঘাটন ও প্রতিরোধে সাহায্য করে।
৬। কর নির্ধারণঃ সঠিক পদ্ধতিতে ও সুষ্ঠু হিসাব সংরক্ষণের মাধ্যমে হিসাববিজ্ঞান আয়কর, ভ্যাট, বিক্রয় কর ইত্যাদি নির্ধারণে সাহায্য করে।
৭। ব্যয় নিয়ন্ত্রণঃ বিচ্যুতি বিশ্লেষণ, মান ব্যয়, বাজেটীয় নিয়ন্ত্রণ, দায়িত্ব (responsibility) হিসাব ইত্যাদি কৌশল ব্যবহার করে ব্যয় নিয়ন্ত্রণে হিসাববিজ্ঞান সহায়তা করে থাকে।
৮। ব্যবস্থাপকীয় সিদ্ধান্ত গ্রহন ও পরিচালনাঃ ব্যবস্থাপনাকে প্রতিনিয়ত বিভিন্ন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হয়। হিসাববিজ্ঞান বিভিন্ন প্রতিবেদন ও বিবরণীর মাধ্যমে প্রয়োজনীয় তথ্য সরবরাহ করে সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে কার্যকর ভূমিকা পালন করে। এই জন্য হিসাববিজ্ঞানকে ব্যবস্থাপনার সহায়ক বলা হয়।
৯। প্রামাণ্য দলিলঃ সঠিকভাবে সংরক্ষিত দলিল প্রামাণ্য দলিল হিসেবে কাজ করে। বিভিন্ন পক্ষের মধ্যে ভুল বুঝাবুঝি এড়ানো যায় এবং বিরোধ নিসঅত্তিতে আদালতে প্রমাণপত্র হিসেবে উপস্থাপন করা যায়।
১০। মূল্য নির্ধারণঃ সাধারণত পণ্য বা সেবার ব্যয়ের সাথে মুনাফা যোগ করে বিক্রয়মূল্য নির্ধারণ করা হয়। সঠিক হিসাব সংরক্ষণের মাধ্যমে পণ্য বা সেবার প্রকৃত ব্যয় ও মুনাফার হার নির্ণয় করে মূল্য নির্ধারণে হিসাববিজ্ঞান গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
১১। ঋণ গ্রহণঃ ব্যবসায়ের প্রয়োজনে অনক সময় ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণ গ্রহণ করতে হয়। ঋণদাতা আর্থিক বিবরণী বিশ্লেষণ করে ঋণ যোগ্যতা যাচাই করে। হিসাববিজ্ঞান যথার্থ আর্থিক বিবরণী প্রস্তুত করে ঋণ প্রাপ্তিতে সাহায্য করে।
১২। সংশ্লিষ্ট পক্ষসমূহকে তথ্য পরিবেশনঃ সর্বোপরি হিসাববিজ্ঞান বিভিন্ন আর্থিক বিবরণী, প্রতিবেদন ও বিবৃতির মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানের সাথে স্বার্থ সংশ্লিষ্ট ভিতর ও বাইরের পক্ষসমূহকে প্রয়োজনীয় তথ্য সরবরাহ করে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
হিসাববিজ্ঞানের কার্যাবলী (Functions & of Accounting):
কেবলমাত্র আর্থিক লেনদেন লিপিবদ্ধকরণ, কার্যক্রম নির্ণয় ও আর্থিক অবস্থা নিরূপণের মধ্যেই হিসাববিজ্ঞানের কাজ সীমিত নয়। বিবরণী ও অন্যান্য প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করে তথ্য প্রস্তুতকরণ এবং উক্ত তথ্য মালিক, ব্যবস্থাপনা ও অন্যান্য স্বার্থ সংশ্লিষ্ট পক্ষসমূহকে পরিবেশন করাও হিসাববিজ্ঞানের কাজের আওতা। হিসাববিজ্ঞানের কার্যাবলীকে দুই ভাগে ভাগ করা যায় যথা -
১। ঐতিহাসিক বা তত্ত্বাবধানমূলক কার্যাবলী ২। ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত কার্যাবলী
১। ঐতিহাসিক বা তত্ত্বাবধানমূলক কার্যাবলী (Historical/Supervisory Functions):
তত্ত্বাবধানমূলক কার্যাবলী বলতে যথাযথভাবে হিসাব রাখার মাধ্যমে ব্যবসায়ে ব্যবহৃত মালিকের মূলধন সংরক্ষণ ও লাভজনক ও কার্যকরী ব্যবহার নিশ্চিত করা বুঝায়। সুনির্দিষ্ট তত্ত্বাবধানমূলক কার্যাবলী নিম্নরূপ-
• সংঘটিত ঘটনা পর্যবেক্ষণ ও অর্থনৈতিক ঘটনা চিহ্নিতকরণ;
• আর্থিক ঘটনা টাকায় পরিমাপ ও লিপিবদ্ধকরণ;
• লেনদেনের শ্রেণীবিন্যাস ও স্থায়ী হিসাবভুক্তকরণ;
• হিসাবের উদ্বৃত্ত নির্ণয় ও সারসংক্ষেপ প্রস্তুতকরণ;
• হিসাবের সমন্বয় লিপিবদ্ধকরণ;
• আর্থিক বিবরণী ও প্রতিবেদন প্রস্তুতকরণ এবং;
• ফলাফল ও আর্থিক অবস্থা বিশ্লেষণ ও ব্যাখ্যাকরণ।
২। ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত কার্যাবলী (Managerial Functions):
ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত কার্যাবলী বলতে আর্থিক ও পরিসংখ্যানগত তথ্য সংগ্রহকরণ, লিপিবদ্ধকরণ, বিশ্লেষণকরণ এবং বিবরণী ও প্রতিবেদনের আকারে মালিক, ব্যবস্থাপক ও অন্যান্য স্বার্থ সংশ্লিষ্ট পক্ষমূহকে পরিবেশন করাকে বুঝায়। প্রতিষ্ঠানের লক্ষ্য অর্জনের জন্য ব্যবস্থাপকদের পরিকল্পনা প্রণয়ন, নিয়ন্ত্রণ ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রয়োজনীয় তথ্য সরবরাহ করা ব্যবস্থাপনা বিষয়ক কার্যাবলীর আওতাভুক্ত।
নিচে হিসাববিজ্ঞানের ব্যবস্থাপনা বিষয়ক কার্যাবলী বর্ণনা হলোক.
ক) তথ্য সংগ্রহ (Data collection): তথ্য বলতে প্রতিষ্ঠানের আয়-ব্যয়, লাভ-লোকসান, মূলধন, দায়-সম্পদ অতীত ও
বর্তমান আর্থিক অবস্থা এবং ভবিষ্যত সম্ভাবনা সংক্রান্ত যাবতীয় উপাত্তকে বুঝায় যা ব্যবস্থাপনাকে বিভিন্ন সিদ্ধান্ত
গ্রহণে সাহায্য করে।
হিসাববিজ্ঞানে তথ্য দু’রকমের হতে পারে যথা- ১। নিয়মিত তথ্য ও ২। বিশেষ তথ্য।
হিসাববিজ্ঞানের নিয়মানুয়ায়ী সংরক্ষিত হিসাব ও আর্থিক বিবরণী থেকে প্রাপ্ত তথ্যকে নিয়মিত তথ্য বলে।
হিসাববিজ্ঞানের কার্য প্রক্রিয়া থেকে এ সমস্ত তথ্য নিয়মিত সৃষ্টি হয়। অন্যদিকে বিশেষ সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য যে অতিরিক্ত তথ্য প্রয়োজন হয় যা মূলত: হিসাব থেকে প্রাপ্ত তথ্য বিশ্লেষণ করে পাওয়া যায় তাকে বিশেষ তথ্য বলে। যেমন-নতুন পণ্য উৎপাদন, নতুন যন্ত্রপাতি ক্রয় ইত্যাদি।
তথ্য সংগ্রহ বলতে সংশ্লিষ্ট হিসাব ও পরিসংখ্যান সংক্রান্ত বিভিন্ন উপাত্ত সংগ্রহ করাকে বুঝায়। উপাত্ত দু’রকমের হতে পারে যথা-প্রাথমিক উপাত্ত ও মাধ্যমিক উপাত্ত। হিসাববিজ্ঞানের তথ্য দু’প্রকার উৎস থেকে সংগৃহীত হতে পারে যথা-
(১) অন্তঃস্থ অর্থাৎ হিসাবের বই, আর্থিক বিবরণী ও প্রতিবেদন এবং
(২) বহি:স্থ অর্থাৎ শেয়ার বাজার, বাণিজ্য সভা, কোম্পানি নিবন্ধকের কার্যালয়ে রক্ষিত হিসাবপত্র, গবেষণা পত্রিকা, অর্থনৈতিক ও পরিসংখ্যান সংস্থাসমূহের বিবরণী ও প্রতিবেদন।
খ) তথ্য প্রস্তুতকরণ (Preparing information) : উপাত্ত সংগ্রহ করে ভালভাবে পরীক্ষা করতে হবে। ভুল-ত্রঅটিপূর্ণ এবং অপ্রাসঙ্গিক উপাত্ত বাদ দিতে হবে। বাকি উপাত্তগুলো সময়, পরিমাণ ও ভৌগলিক অবস্থানের ভিত্তিতে শ্রেণীবিন্যাস ও বিশ্লেষণ করতে হবে। এরপর প্রাসঙ্গিক, সময়োপযোগী, বিশ্বাসযোগ্য, বস্তুনিষ্ঠ ও বোধগম্য উপাত্তসমূহ নিয়ে প্রতিবেদন প্রস্তুত করতে হবে। এ সব প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সংগৃহীত উপাত্ত তথ্যে পরিণত হয়।
গ) তথ্য পরিবেশন (Presentation of information)
সাধারণতঃ দু’ভাবে তথ্য পরিবেশন করা হয়ঃ
১) নিয়মিত তথ্য পরিবেশনঃ বিভিন্ন প্রতিবেদন ও চিত্রের মাধ্যমে। এক্ষেত্রে বিভিন্ন প্রতিবেদন যথা- লাভ-লোকসান হিসাব, উদ্বৃত্তপত্র, নগদ প্রবাহ বিবরণী, কার্যকরী মূলধন প্রতিবেদন, অনুপাত বিশ্লেষণ প্রতিবেদন প্রস্তুত করা হয়। চিত্র:তথ্য চিত্র, রেখা চিত্র, বার চিত্র, পাই চিত্র ইত্যাদি।
২) চাহিদা অনুযায়ী তথ্য পরিবেশনঃ তথ্য ব্যবহারকারীর প্রয়োজন ও নির্দেশনা অনুযায়ী তথ্য পরিবেশন করা হয়।
0 মন্তব্য(গুলি):
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
Comment below if you have any questions