রক্ত কি
দেহকে সচল ও কার্যক্রম রাখার জন্য দেহে যে সমসত্ম তন্ত্র আছে, তার মধ্যে রক্ত সংবহনতন্ত্র উল্লেখযোগ্য। এ তন্ত্রে প্রবাহিত রক্তের মাধ্যমে পরিপাককৃত খাদ্যের সারাংশ অক্সিজেন এবং বজ্য পদার্থ প্রতিনিয়ত দেহের একস্থান থেকে অন্যস্থানে পরিবাহিত হয়।
রক্ত এক ধরনের তরল যোজক কলা। রক্তরস এবং কয়েক ধরনের রক্ত কণিকার সমন্বয়ে রক্ত গঠিত হয়। মানুষ ও অন্যান্য মেরুদন্ডী প্রাণিদেহের রক্ত লাল রঙের হয়। লোহিত রক্ত কণিকায় হিমোগেস্নাবিন নামক লৌহঘটিত প্রোটিন জাতীয় পদার্থ থাকায় রক্তের রং লাল হয়। হিমোগেস্নাবিন অক্সিজেনের সাথে যুক্ত হয়ে অক্মিহিমোগ্লোবিন যৌগ গঠন করে অক্সিজেন পরিবহন করে।
রক্তের কাজ কি
রক্ত দেহের বিভিন্ন ধরনের কাজ করে থাকে। যথা-
১। আমরা যে খাদ্য খাই, পরিপাকের পর তার সারাংশ রক্তের সাথে মিশ্রিত হয়। রক্ত সেই খাদ্যসারকে দেহের সকল অংশে নিয়ে যায়। এভাবে জীবকোষগুলো পুষ্টি সাধন করে।
২। রক্তের লোহিত কণিকাস্থ হিমোগ্লোবিন অক্সিজেনকে ফুসফুস হতে দেহের বিভিন্ন কোষে পৌঁছায় এবং কোষগুলো হতে কার্বন-ডাই অক্সাইড বহন করে এনে ফুসফুসের মাধ্যমে বাইরে বের করে দেয়।
৩। দেহের মধ্যে সর্বদাই দহনক্রিয়া সম্পাদিত হচ্ছে। তাতে বিভিন্ন অঙ্গের মধ্যে যে বিভিন্ন তাপমাত্রার সৃষ্টি হয়, তা রক্তের মাধ্যমে দেহের সর্বত্র পরিব্যাপ্ত হয় এবং এভাবে দেহে তাপের সমতা রক্ষা পায়।
৪। নালীবিহীন গ্রন্থিগুলোতে অমত্মঃনিসৃত রস সরাসরি রক্তে মিশে। এ রসকে হরমোন বলে। সঞ্চালিত রক্তের দ্বারা হরমোন প্রয়োজন অনুযায়ী দেহের বিভিন্ন অংশে সরবরাহ হয়।
৫। রক্তের শ্বেতকণিকা ফ্যাগোসাইটোসিস প্রক্রিয়ায় প্রবেশকৃত অবৈধ ক্ষতিকর জীবাণু ধ্বংস করে দেহকে রোগমুক্ত রাখে।
৬। দেহের কোনো স্থান কেটে গেলে অণুচক্রিকা রক্ত জমাট বাঁধতে সহায়তা করে। ফলে রক্তপাত বন্ধ হয়।
৭। রক্ত দেহের বিভিন্ন প্রকার দুষিত পদার্থ ও বর্জ্য উপাদান ফুসফুস, মূত্রাশয় ও ত্বকে নিয়ে আসে ও সেখান হতে তাদের নিষ্কাশন করতে সহায়তা করে।
রক্তের গ্রুপ
দেখতে একই রকম হলেও প্রকৃতপক্ষে সব রক্ত এক ধরনের নয়। একজনের রক্ত অন্যজনের রক্তের সাথে মিল নাও হতে পারে। রক্তের বিভিন্ন গ্রুপ আছে। যখন কোনো কারণে মানুষের দেহে রক্ত কমে যায় বা কোনো কারণে দেহে রক্তের প্রয়োজন পড়ে, তখন অবশ্যই তাকে রক্ত দিতে হবে। যাকে রক্ত দিতে হবে এবং যার শরীর থেকে দিতে হবে উভয় ব্যক্তির রক্ত পরীক্ষা করতে হবে। উভয় ব্যক্তির রক্ত সম-বিভাগের হতে হবে। অনেক ক্ষেত্রে দাতা-গ্রহিতার রক্তের মিল না হওয়ায় বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয় এবং অল্প সময়ের মধ্যে গ্রহিতা মারা যেতে পারে। ১৯০০ সালে ডা. কার্ল ল্যান্ডস্টেইনার (Karl Landsteiner) ভিয়েনার একটি মেডিক্যাল ল্যাবরেটরিতে কাজ করার সময় দেখতে পেয়েছিলেন, যখন কোনো ব্যক্তির রক্তকণিকা অন্য ব্যক্তির রক্তের সাথে মেশানো হচ্ছে, তখন কোনো কোনো ক্ষেত্রে রক্তকণিকাগুলো গুচছবন্ধ হচ্ছে। তিনি এটির উপর আরও পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে উদঘাটন করেন, মানুষের রক্তকোষে দুই ধরনের অ্যান্টিজেন আছে এবং একইভাবে রক্তের সিরামে (Serum) দুই ধরনের অ্যান্টিবডি আছে।
সিরাম কাকে বলে
রক্ত জমাট বাধার পর রক্তের জমাট অংশ থেকে যে হালকা হলুদ বা খড়ের রঙের মতো এক রকম স্বচ্ছ রস নিঃসৃত হয়, তাকে সিরাম বলে। রক্তরস বা পস্নাজমা এবং সিরামের মধ্যে পার্থক্য হচ্ছে- রক্তরসে রক্তকণিকা থাকে কিন্তু সিরামে কোনো রক্তকণিকা থাকে না।
বোঝার সুবিধার জন্য দুই ধরনের অ্যান্টিজেনকে ‘A’ এবং ‘B’ নামকরণ করা হয়। একজন মানুষ তার রক্তে এই দুটি অ্যান্টিজেনের মধ্যে যে কোনো একটি অথবা দুটিই ধারণ করে অথবা দুটির একটিও ধারণ করে না। রক্তের অ্যান্টিজেনের ভিত্তিতে পৃথিবীতে চার ধরনের মানুষ বিরাজ করছে। যে মানুষের রক্তকোষে A অ্যান্টিজেন থাকে,তাকে গ্রুপ ‘A’, যে মানুষের রক্তকোষে ‘B’ অ্যান্টিজেন থাকে তাকে গ্রুপ ‘B’, যে মানুষের রক্তে ‘A’ ও ‘B’ উভয় অ্যান্টিজেন থাকে তাকে AB গ্রুপ এবং যার মধ্যে ‘A’ ও ‘B’ অ্যান্টিজেনের কোনোটিই থাকে না, তাকে গ্রুপ ‘O’ বলে আখ্যায়িত করা হয়।
মানুষের রক্তকোষে যে ধরনের অ্যান্টিজেন থাকবে, ঠিক তার অনুরূপ অ্যান্টিবডি তার রক্ত সিরামে থাকবে না। এটি স্পষ্ট, যদি A অ্যান্টিজেন বহনকারী মানুষের সিরামে A অ্যান্টিজেনের বিরুদ্ধ অ্যান্টিবডি থাকতো তাহলে সে ব্যক্তির রক্ত গুচছবন্ধ হয়ে তার মৃত্যু হতো। সুতরাং একজন মানুষের রক্তের গ্রুপ A হলে তার রক্তে A অ্যান্টিজেন থাকবে। এর বিরুদ্ধে কোনো অ্যান্টিবডি থাকবে না, তার রক্তে কোনো B অ্যান্টিজেন নেই, কিন্তু B অ্যান্টিবডি থাকবে।
0 মন্তব্য(গুলি):
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
Comment below if you have any questions