Home » » বিড়াল বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়

বিড়াল বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়

ভূমিকা
‘বিড়াল’ বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় রচিত একটি রম্যরচনা। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের যতগুলো রম্য রচনা আছে, ‘বিড়াল’ তার মধ্যে অন্যতম। এটি ‘কমলাকান্তের দপ্তর’ গ্রন্থ থেকে নেয়া হয়েছে। প্রবন্ধটি ছোট কিন্তু চির নতুন। কমলাকান্ত ও বিড়ালের কথাবার্তার মধ্য দিয়ে লেখক গভীর দর্শনের কথা বলেছেন। বিড়াল চরিত্রকে লেখক দরিদ্র বঞ্চিত ও শোষিত সমাজের প্রতিনিধি বা প্রতীক হিসেবে সৃষ্টি করেছেন। আর ধনী সমাজের প্রতীক হলেন কমলাকান্ত। দুইজনের আলোচনায় আমাদের সমাজের আসল ছবি ফুটে উঠেছে। অন্যদিকে সত্যিকার মানুষ হতে হলে তাকে কী কী গুণের অধিকারী হতে হবে সে কথাও বলা হয়েছে। সমাজে শৃঙ্খলা আনতে হলে মানুষকেই যে বিচারবুদ্ধি নিয়ে চলতে হবে, ধনী দরিদ্রের বৈষম্য দূর করতে চাইলে মানুষের ভূমিকাই যে প্রধান হতে হবে, স্পষ্ট ইঙ্গিত করা হয়েছে সেদিকে। রম্য রচনা হিসেবে ‘বিড়াল’ এক অসাধারণ প্রবন্ধ। আজো শত সহস্র পাঠক এ রচনাটি পড়ে আনন্দ ও চিন্তার খোরাক পেয়ে থাকেন।


‘বিড়াল’

-বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়

আমি শয়ন গৃহে চারপায়ীর উপর বসিয়া হুঁকা হাতে, ঝিমাইতেছিলাম। একটু মিট্ মিট্ করিয়া ক্ষুদ্র আলো জ্বলিতেছে- দেয়ালের উপর চঞ্চল ছায়া, প্রেতবৎ নাচিতেছে। আহার প্রস্ত্তত হয় নাই-এ জন্য হুকা হাতে ,নিমীলিতলোচনে আমি ভাবিতেছিলাম যে, আমি যদি নেপোলিয়ন হইতাম, তবে ওয়াটার্লু জিতিতে পারিতাম কি না। এমত সময়ে একটু ক্ষুদ্র শব্দ হইল, ‘মেও!’’ চাহিয়া দেখিলাম-হঠাৎ কিছু বুঝিতে পারিলাম না। প্রথমে মনে হইল, ওয়েলিংটন হঠাৎ বিড়ালত্ব প্রাপ্ত হইয়া, আমার নিকট আফিঙ্গ ভিক্ষা করিতে আসিয়াছে। প্রথম উদ্যমে পাষাণবৎ কঠিন হইয়া, বলিব মনে করিলাম যে, ডিউক মহাশয়কে ইতিপূর্বে যথোচিত পুরস্কার দেয়া গিয়াছে, এক্ষণে আর অতিরিক্ত পুরস্কার দেয়া যাইতে পারে না। বিশেষ অপরিমিত লোভ ভাল নহে। ডিউক বলিল, ‘‘মেও!’’ তখন চক্ষু চাহিয়া ভাল করিয়া দেখিলাম যে, ওয়েলিংটন নহে। একটি ক্ষুদ্র মার্জার; প্রসন্ন আমার জন্য যে দুগ্ধ রাখিয়া গিয়াছিল, তাহা নিঃশেষ করিয়া উদরসাৎ করিয়াছে, আমি তখন ওয়াটার্লুর মাঠে ব্যুহ-রচনায় ব্যস্ত, অত দেখি নাই। এক্ষণে মার্জারসুন্দরী, নির্জল দুগ্ধপানে পরিতৃপ্ত হইয়া আপন মনের সুখ এ জগতে প্রকটিত করিবার অভিপ্রায়ে, অতি মধুর স্বরে বলিতেছেন, ‘‘মেও!’’ শব্দে একটু মন বুঝিবার অভিপ্রায় ছিল। বুঝি বিড়ালের মনের ভাব, ‘‘তোমার দুধ খাইয়া বসিয়া আছি-এখন বল কি?’’

বলি কি? আমি ত ঠিক করিতে পারিলাম না। দুধ আমার বাপেরও নয়। দুধ মঙ্গলার, দুহিয়াছে প্রসন্ন। অতএব সে দুগ্ধে আমারও যে অধিকার, বিড়ালেরও তাই; সুতরাং রাগ করিতে পারি না। তবে চিরাগত একটি প্রথা আছে যে, বিড়াল দুধ খাইয়া গেলে, তাহাকে তাড়াইয়া মারিতে যাইতে হয়। আমি যে সেই চিরাগত প্রথার অবমাননা করিয়া মনুষ্যকুলে কুলাঙ্গার স্বরূপ পরিচিত হইব, ইহাও বাঞ্ছনীয় নহে। কি জানি, এই মার্জারী যদি স্বজাতিমন্ডলে কমলাকান্তকে কাপুরুষ বলিয়া উপহাস করে? অতএব পুরুষের ন্যায় আচরণ করাই বিধেয়। ইহা স্থির করিয়া,

সকাতরচিত্তে, হস্ত হইতে হুঁকা নামাইয়া, অনেক অনুসন্ধানে এক ভগ্ন ষষ্টি আবিষ্কৃত করিয়া সগর্বে মার্জারী প্রতি ধাবমান হইলাম। মার্জারী কমলাকান্তকে চিনিত; সে ষষ্টি দেখিয়া বিশেষ ভীত হওয়ার কোন লক্ষণ প্রকাশ করিল না। কেবল আমার মুখপানে চাহিয়া হাই তুলিয়া, একটু সরিয়া বসিল। বলিল, ‘‘মেও’’! প্রশ্ন বুঝিতে পারিয়া ষষ্টি ত্যাগ করিয়া পুনরপি শয্যায় আসিয়া হুকা লইলাম। তখন দিব্যকর্ণ প্রাপ্ত হইয়া, মার্জারের বক্তব্যসকল বুঝিতে পারিলাম।

বুঝিলাম যে বিড়াল বলিতেছে, ‘‘মারপিট কেন? স্থির হইয়া, হুঁকা হাতে করিয়া, একটু বিচার করিয়া দেখ দেখি? এ সংসারের ক্ষীর, সর, দুগ্ধ, দধি, মৎস্য, মাংস, সকলই তোমরা খাইবে, আমরা কিছু পাইব না কেন? তোমরা মনুষ্য, আমরা বিড়াল, প্রভেদ কি? তোমাদের ক্ষুৎপিপাসা আছে-আমাদের কি নাই? তোমরা খাও, আমাদের আপত্তি নাই; কিন্তু আমরা খাইলে তোমরা কোন্ শাস্ত্রানুসারে ঠেঙ্গা লাঠি লইয়া মারিতে আইস, তাহা আমি বহু অনুসন্ধানে পাইলাম না। তোমরা আমার কাছে কিছু উপদেশ গ্রহণ কর। বিজ্ঞ চতুষ্পদের কাছে শিক্ষালাভ ব্যতীত তোমাদের জ্ঞানোন্নতির উপায়ান্তর দেখি না। তোমাদের বিদ্যালয় সকল দেখিয়া আমার বোধ হয়, তোমরা এত দিনে এ কথাটি বুঝিতে পারিয়াছ।

‘‘দেখ, শয্যাশায়ী মনুষ্য! ধর্ম কি? পরোপকারই পরম ধর্ম। এই দুগ্ধটুকু পান করিয়া আমার পরম উপকার হইয়াছে। তোমার আহরিত দুগ্ধে এই পরোপকার সিদ্ধ হইল-অতএব তুমি সেই পরম ধর্মের ফলভাগী-আমি চুরিই করি, আর যাই করি, আমি তোমার ধর্মসঞ্চয়ের মূলীভূত কারণ। অতএব আমাকে প্রহার না করিয়া, আমার প্রশংসা কর। আমি তোমার ধর্মের সহায়।

‘‘দেখ আমি চোর বটে, কিন্তু আমি কি সাধ করিয়া চোর হইয়াছি? খাইতে পাইলে কে চোর হয়? দেখ, যাঁহারা বড় বড় সাধু, চোরের নামে শিহরিয়া উঠেন, তাহারা অনেকে চোর অপেক্ষাও অধার্মিক। তাঁহাদের চুরি করিবার প্রয়োজন নাই বলিয়াই চুরি করেন না। কিন্তু তাঁহাদের প্রয়োজনাতীত ধন থাকিতেও চোরের প্রতি যে মুখ তুলিয়া চাহেন না, ইহাতেই চোরে চুরি করে। অধর্ম চোরের নহে-চোরে যে চুরি করে, সে অধর্ম কৃপণ ধনীর। চোর দোষী বটে, কিন্তু কৃপণ ধনী তদপেক্ষা শত গুণে দোষী। চোরের দন্ড হয়; চুরির মূল যে কৃপণ, তাহার দন্ড হয় না কেন?

‘‘দেখ আমি প্রাচীরে প্রাচীরে মেও মেও করিয়া বেড়াই, কেহ আমাকে মাছের কাঁটাখানাও ফেলিয়া দেয় না। মাছের কাঁটা, পাতের ভাত নর্দমায় ফেলিয়া দেয়, জলে ফেলিয়া দেয়, তথাপি আমাকে ডাকিয়া দেয় না। তোমাদের পেট ভরা, আমার পেটের ক্ষুধা কি প্রকারে জানিবে! হায়! দরিদ্রের জন্য ব্যথিত হইলে, তোমাদের কি কিছু অগৌরব আছে? আমার মত দরিদ্রের ব্যথায় ব্যথিত হওয়া, লজ্জার কথা সন্দেহ নাই। যে কখন অন্ধকে মুষ্টি-ভিক্ষা দেয় না, সেও একটা বড় রাজা, ফাঁপরে পড়িলে রাত্রে ঘুমায় না-সকলেই পরের ব্যথায় ব্যথিত হইতে রাজি। তবে ছোটলোকের দুঃখে কাতর! ছি! কে হইবে?

‘‘দেখ যদি অমুক শিরোমণি, কি অমুক ন্যায়ালঙ্কার আসিয়া তোমার দুধটুকু খাইয়া যাইতেন, তবে তুমি তাঁহাকে ঠেঙ্গা লইয়া মারিতে আসিতে? বরং জোড়হাতে করিয়া বলিতে, আর একটু কি আনিয়া দিব? তবে আমার বেলা লাঠি কেন? তুমি বলিবে, তাঁহারা অতি পন্ডিত, বড় মান্য লোক। পন্ডিত বা মান্য বলিয়া কি আমার অপেক্ষা তাঁহাদের ক্ষুধা বেশী? তা ত নয়-তেলা মাথায় তেল দেয়া মনুষ্যজাতির রোগ-দরিদ্রের ক্ষুধা কেহ বুঝে না। যে খাইতে বলিলে বিরক্ত হয়, তাহার জন্য ভোজের আয়োজন কর-আর যে ক্ষুধার জ্বালায় বিনা আহবানেই তোমার অন্ন খাইয়া ফেলে, চোর বলিয়া তাহার দন্ড কর-ছি!ছি!

‘‘দেখ আমাদিগের দশা দেখ, দেখ প্রাচীরে প্রাচীরে, প্রাঙ্গণে প্রাঙ্গণে প্রাসাদে প্রাসাদে, মেও মেও করিয়া আমরা চারি, দিক্ দৃষ্টি করিতেছি-কেহ আমাদিগকে মাছের কাঁটাখানা ফেলিয়া দেয় না। যদি কেহ তোমাদের সোহাগের বিড়াল হইতে পারিল-গৃহমার্জার হইয়া, বৃদ্ধের নিকট যুবতী ভার্যার সহোদর, বা মুর্খ ধনীর কাছে সতরঞ্চ খেলওয়ারে স্থানীয় হইয়া থাকিতে পারিল-তবেই তাহার পুষ্টি তাহার লেজ ফুলে, গায়ে লোম হয় এবং তাহাদের রূপের ছটা দেখিয়া, অনেক মার্জার কবি হইয়া পড়ে।

‘‘আর আমাদিগের দশা দেখ-আহারাভাবে উদর কৃশ, অস্থি পরিদৃশ্যমান, লাঙ্গুল বিনত, দাঁত বাহির হইয়াছে-জিহবা ঝুলিয়া পড়িয়াছে-অবিরত আহারাভাবে ডাকিতেছি, ‘‘মেও’’! মেও! খাইতে পাই না! - আমাদের কালো চামড়া দেখিয়া ঘৃণা করিও না! এ পৃথিবীর মৎস্য মাংসে আমাদের কিছু অধিকার আছে। খাইতে দাও- নহিলে চুরি করিব। আমাদের কৃষ্ণ চর্ম, শুষ্ক মুখ, ক্ষীণ সকরুণ মেও মেও শুনিয়া তোমাদিগের কি দুঃখ হয় না? চোরের দন্ড নাই কেন? দরিদ্রের আহার সংগ্রহের দন্ড আছে, ধনীর কার্পণ্যের দন্ড নাই

কেন? তুমি কমলাকান্ত, দূরদর্শী, কেন না আফিঙ্গখোর, তুমিও কি দেখিতে পাও না যে, ধনীর দোষেই দরিদ্রে চোর হয়? পাঁচ শত দরিদ্রকে বঞ্চিত করিয়া একজনে পাঁচ শত লোকের আহার্য সংগ্রহ করিবে কেন? যদি করিল, তবে সে তাহার খাইয়া যাহা বাহিয়া পড়ে, তাহা দরিদ্রকে দিবে না কেন? যদি না দেয়, তবে দরিদ্র অবশ্য তাহার নিকট হইতে চুরি করিবে; কেন না, অনাহারে মরিয়া যাইবার জন্য এ পৃথিবীতে কেহ আইসে নাই।’’

আমি আর সহ্য করিতে না পারিয়া বলিলাম, ‘‘থাম! থাম মার্জারপন্ডিতে! তোমার কথাগুলি ভারি সোশিয়ালিষ্টিক্! সমাজ বিশৃঙ্খলার মূল! যদি যাহার যত ক্ষমতা, সে তত ধনসঞ্চয় করিতে না পায়, অথবা সঞ্চয় করিয়া চোরের জ্বালায় নির্বিঘ্নে ভোগ করিতে না পায়, তবে কেহ আর ধনসঞ্চয়ে যত্ন করিবে না। তাহাতে সমাজের ধনবৃদ্ধি হইবে না।’’

মার্জার বলিল, ‘‘না হইল ত আমার কি? সমাজের ধনবৃদ্ধির অর্থ ধনীর ধনবৃদ্ধি। ধনীর ধনবৃদ্ধি না হইলে দরিদ্রের কি ক্ষতি?’’ আমি বুঝাইয়া বলিলাম যে, ‘‘সামাজিক ধনবৃদ্ধি ব্যতীত সমাজের উন্নতি নাই।’’ বিড়াল রাগ করিয়া বলিল যে, ‘‘আমি যদি খাইতে না পাইলাম তবে সমাজের উন্নতি লইয়া কি করিব?’’

বিড়ালকে বুঝান দায় হইল। যে বিচারক বা নৈয়ায়িক, কস্মিনকালে কেহ তাহাকে কিছু বুঝাইতে পারে না। এ মার্জার সুবিচারক, এবং সুতার্কিকও বটে, সুতরাং না বুঝার পক্ষে ইহার অধিকার আছে। অতএব ইহার উপর রাগ না করিয়া বলিলাম ‘‘সমাজের উন্নতিতে দরিদ্রের প্রয়োজন না থাকিলে না থাকিতে পারে, কিন্তু ধনীদের বিশেষ প্রয়োজন, অতএব চোরের দন্ডবিধান কর্তব্য।

মার্জারী মহাশয়া বলিলেন, ‘‘চোরকে ফাঁসি দাও, তাহাতেও আমার আপত্তি নাই, কিন্তু তাহার সঙ্গে আর একটি নিয়ম কর। যে বিচারক চোরকে সাজা দিবেন, তিনি আগে তিন দিবস উপবাস করিবেন। তাহাতে যদি তাঁহার চুরি করিয়া খাইতে ইচ্ছা না করে, তবে তিনি স্বচ্ছন্দে চোরকে ফাঁসি দিবেন। তুমি আমাকে মারিতে লাঠি তুলিয়াছিলে, তুমি অদ্য হইতে তিন দিবস উপবাস করিয়া দেখ। তুমি যদি ইতিমধ্যে

নসীরাম বাবুর ভান্ডারঘরে ধরা না পড়, তবে আমাকে ঠেঙ্গাইয়া মারিও, আমি আপত্তি করিব না।’’ বিজ্ঞ লোকের মত এই যে, যখন বিচারে পরাস্ত হইবে, তখন গম্ভীরভাবে উপদেশ প্রদান করিবে। আমি সেই প্রথানুসারে মার্জারকে বলিলাম যে, ‘‘এ সকল অতি নীতিবিরুদ্ধ কথা, ইহার আন্দোলনেও পাপ আছে। তুমি এ সকল দুশ্চিন্তা পরিত্যাগ করিয়া ধর্মাচরণে মন দাও। তুমি যদি চাহ, তবে পাঠার্থে তোমাকে আমি নিউমান ও পার্কারের গ্রন্থ দিতে পারি। আর কমলাকান্তের দপ্তর পড়িলেও কিছু উপকার হইতে পারে-আর কিছু হউক বা না হউক, আফিঙ্গের অসীম মহিমা বুঝিতে পারিবে। এক্ষণে স্বস্থানে গমন কর, প্রসন্ন কাল কিছু ছানা দিবে বলিয়াছে, জলযোগের সময় আসিও উভয়ে ভাগ করিয়া খাইব। অদ্য আর কাহারও হাঁড়ি খাইও না; বরং ক্ষুধায় যদি নিতান্ত অধীর হও, তবে পুনর্বার আসিও, এক সরিষাভোর আফিঙ্গ দিব।’’ মার্জার বলিল, ‘‘আফিঙ্গের বিশেষ প্রয়োজন নাই, তবে হাঁড়ি খাওয়ার কথা, ক্ষুধানুসারে বিবেচনা করা যাইবে।’’ মার্জার বিদায় হইল। একটি পতিত আত্মাকে অন্ধকার হইতে আলোকে আনিয়াছি, ভাবিয়া কমলাকান্তের বড় আনন্দ হইল।


সার-সংক্ষেপ
লেখক নিজেই কমলাকান্ত। হালকা কথায় নিজের মনের ভাব ব্যক্ত করেছেন। বিড়ালের সঙ্গে কমলাকান্তের যে কথা বার্তা সেটা তাঁর নিজস্ব চিন্তা। বিড়াল নিরীহ প্রাণী। সুযোগ পেলেই দুধ চুরি করে খায়। সমাজে ধনী ও দরিদ্রের যে ব্যবধান তা যে মানুষেরই সৃষ্টি এ কথাই লেখক কমলাকান্ত সেজে বলেছেন। তাঁর মতে দরিদ্র অসহায় যারা, তারা অনেক সময় বাধ্য হয়ে অন্যায় করে। তখন ধনীরা তাদের জন্য শাস্তির ব্যবস্থা করে। কেনো তারা অন্যায় করলো তার কারণ কখনো খোঁজা হয় না। বিড়ালকে দরিদ্র সমাজের প্রতিনিধি হিসেবে দাঁড় করিয়েছেন। কমলাকান্তের সমস্ত কথাবার্তা হচ্ছে রূপকের আশ্রয়ে।

বিড়াল তার চুরি করে দুধ খাওয়ার কারণ বলতে গিয়ে আমাদের সমাজ ব্যবস্থার অনিয়মের কথা বলেছে। তার ব্যাখ্যায় ধনী কৃপণদের জন্যই গরিবরা চোর হয়। তাই চোরের শাস্তি হলে যারা চোর তৈরি করে, তাদেরও শাস্তি হওয়া উচিত বলে বিড়াল মনে প্রাণে বিশ্বাস করে। বিড়াল তার অভিজ্ঞতা থেকেই বলেছে যে, মানুষ ‘তেলা মাথায় তেল ঢালে’- এটা তাদের সবচেয়ে বড় দোষ। যাদের খাওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই, তাদের জন্য মানুষ ভোজের আয়োজন করে। আর শুধু বেঁচে থাকার জন্য যাদের একটু খাবার প্রয়োজন, তাদেরকে কেউ খেতে দেয় না। ভোজের আসরে খেতেও ডাকে না। বরং খাবার বেঁচে গেলে তা ফেলে দেয়া হয়, তবু ক্ষুধার্তদের জন্য তা রাখা হয় না। ধনীদের এমন নির্দয় আচরণের জন্যই দরিদ্র অসহায়রা চুরি করে। তাই চুরির জন্য দরিদ্রকে শাস্তি দেয়ার কোনো অধিকার নেই ধনীর। ধনীরা দরিদ্রের কষ্ট বোঝে না। না খেয়ে থাকলেও দরিদ্রের সেবায় কেউ এগিয়ে যায় না। তখন প্রাণ বাঁচানোর জন্য দরিদ্ররা চুরি করে। বিড়াল বলতে চায় যে, কৃপণ ধনীরাই সৃষ্টি করে চোর। তারা একাই পাঁচশো জনের সম্পদ ভোগ করে। এটাও সামাজিক অন্যায়। চোরের শাস্তি হলে ধনী কৃপণদেরও শাস্তি হওয়া উচিত। কারণ তারাই ক্ষুধার্তকে চুরি করতে বাধ্য করে। পৃথিবীতে সবাই বাঁচতে চায় বলেই চুরি করে খেয়ে বাঁচতে হয় চোরকে।

বিড়ালের মতো এক নগণ্য প্রাণীর কথা শুনতে শুনতে কমলাকান্ত অধৈর্য হলেন। কারণ বিড়াল সমাজতামিক মতবাদের কথা বলছে। যে মতবাদে ধনী এবং নির্ধন সমান। কমলাকান্তের যুক্তি হলো ধনী যদি ধন সঞ্চয় না করে তাহলে সমাজের উন্নতি হবে না। আর বিড়াল মনে করে নির্ধন যদি খেতেই না পায় তাহলে সমাজের উন্নতিতে তার লাভ কী? বিড়াল বলেছে যে, চোরকে শাস্তি দেয়ার আগে একটা নিয়ম করা প্রয়োজন। সেটা হলো, বিচারককে তিন দিন না খেয়ে থাকতে হবে। তখন যদি বিচারকের চুরি করে খেতে ইচ্ছে না করে, তবেই তিনি শাস্তি দিতে পারবেন চোরকে। কমলাকান্ত বিড়ালের সঙ্গে তর্কে না পেরে উপদেশ দিতে চাইলেন। বিড়ালকে ধর্মকর্মে মন দিতে বললেন। জ্ঞান বৃদ্ধির জন্য কিছু বইও দিতে চাইলেন পড়ার জন্য। অবশেষে খাবারের ভাগ দিবেন বলে তার্কিক বিড়ালকে চলে যেতে বললেন। খুব খিদে পেলে সর্ষে পরিমাণ আফিম দিতেও চাইলেন। আপোসের কথা শুনে একটু খুশি হয়ে বিদায় নিলো বিড়াল। কমলাকান্ত বিড়ালকে জ্ঞান দিতে পেরেছেন ভেবে আনন্দিত হলেন।

শব্দার্থ:
শয়নগৃহ - শোয়ার ঘর।
চারপায়ী - টুল বা চৌকি।
প্রেতবৎ - প্রেতের মতো।
নিমীলিত লোচনে - বন্ধ চোখে।
নেপোলিয়ন - পূর্ণনাম নেপোলিয়ন বোনাপার্ট (১৭৬৯- ১৮২১ খ্রিঃ) মহাবীর ফরাসী সম্রাট। প্রায় সমগ্র ইউরোপ জয় করেন। ১৮১৫ খ্রিঃ ওয়াটার্লু যুদ্ধে ডিউক অব ওয়েলিংটন কর্তৃক পরাজিত হন। সেন্ট হেলেনা দ্বীপে নির্বাসিত অবস্থায় তাঁর মৃত্যু হয়।
ওয়াটার্লু - যুদ্ধক্ষেত্রের নাম। এখানে নেপোলিয়ন ডিউক অব ওয়েলিংটনের কাছে পরাজিত হন।
ওয়েলিংটন - ডিউক অব ওয়েলিংটন (১৭৬৯-১৮৫৪ খ্রিঃ) নামে সমধিক পরিচিত। ওয়াটার্লু যুদ্ধে ইনি মহাবীর নেপোলিয়নকে পরাজিত করেন।
বিড়ালত্ব প্রাপ্ত হইয়া-বিড়াল হয়ে।
আফিঙ্গ - আফিম (পপি ফুলের রস থেকে তৈরি)।
পাষাণবৎ - পাথরের মতো।
ডিউক মহাশয় - ক্ষুদ্র রাজা, অভিজাত ব্যক্তি।
যথোচিত - যেমন উচিত।
এক্ষণে - এখন।
অপরিমিত - পরিমাণ করা হয়নি যার।
মার্জার - বিড়াল।
নিঃশেষ - একেবারে শেষ।
উদরসাৎ - খেয়ে ফেলা।
ব্যুহ রচনা - যুদ্ধের জন্য সৈন্য সাজানো।
প্রকটিত - প্রকাশ।
অভিপ্রায় - ইচ্ছা।
চিরাগত - প্রথা (বহুদিন ধরে যা হয়ে আসছে)।
অবমাননা - অপমান।
বাঞ্ছনীয় - যা চাওয়া যায় এমন।
কাপুরম্নষ - ভীতু পুরম্নষ।
সকাতর চিত্তে - কাতর মনে।
ষষ্ঠি - লাঠি।
ধাবমান হইলাম - ধেয়ে গেলাম।
সগর্বে - অহঙ্কারের সঙ্গে।
পুনরপি - আবার।
শয্যায় - বিছানায়।
দিব্যকর্ণ - অলৌকিক ক্ষমতায়
শোনার কান।
মনুষ্য - মানুষ।
প্রভেদ - পার্থক্য।
ক্ষুৎপিপাসা - ক্ষুধা ও পিপাসা।
শাস্ত্রানুসারে - নিয়ম অনুসারে।
ঠেঙ্গালাঠি - লম্বা লাঠি।
আইস - আসো।
অনুসন্ধানে - খুঁজে।
বিজ্ঞ - জ্ঞানী।
চতুষ্পদ - চার পেয়ে প্রাণী।
ব্যতীত - ছাড়া।
আহরিত - সংগ্রহ করা হয়েছে এমন।
মূলীভূত - আসল, গোড়ার।
প্রহার - মারা।
সহায় - সহকারী।
শিহরিয়া - শিউরে ওঠা।
প্রয়োজনাতীত - প্রয়োজনের চেয়ে বেশি।
কৃপণ - যে শুধু সঞ্চয় করে খরচ করে না।
তদপেক্ষা - তার চেয়ে।
শিরোমণি - সমাজের প্রধান ব্যক্তি।
ন্যায়ালঙ্কার - ন্যায়শাস্ত্রে পন্ডিত।
মান্য - সম্মান পাওয়ার যোগ্য।
ভোজ - খাওয়া-দাওয়া।
আহবান - ডাকা।
দ- - শাস্তি।
প্রাঙ্গণ - মাঠ।
প্রাসাদ - বিশাল বাড়ি।
যুবতী - যৌবনবতী মেয়ে।
ভার্যা - স্ত্রী, বৌ।
সহোদর - একই উদরে জন্ম অর্থাৎ আপন ভাই।
সতরঞ্চ খেলা - দাবা খেলা।
উদর - পেট।
কৃশ - রোগা।
অস্থি - হাড়।
পরিদৃশ্যমান - দেখা যায় এমন।
লাঙ্গুল - লেজ।
বিনত - নম্র।
অবিরত - অনবরত।
কৃষ্ণচর্ম - কালো চামড়া।
শুষ্ক মুখ - শুকনো মুখ।
ক্ষীণ - দুর্বল।
সকরম্নণ - অতি দুঃখপূর্ণ।
নির্দয় - নিষ্ঠুর, দয়াহীন।
কার্পণ্য - কৃপণতা।
দূরদর্শী - যার ভবিষ্যত দেখার ক্ষমতা আছে।
বঞ্চিত - প্রতারিত, যে ঠকেছে এমন।
আহার্য - খাবার।
সোশিয়ালিষ্টিক- সমাজতামিত্মক; এটি ইংরেজি শব্দ। সমাজতন্ত্র রাজনৈতিক একটি মতবাদ।
নির্বিঘ্নে - নিরাপদে।
নৈয়ায়িক - যিনি ন্যায়শাস্ত্রে অভিজ্ঞ।
কস্মিনকালে - কোন কালে।
সুতার্কিক - তর্কে পটু।
দন্ডবিধান-শাসিত্মর ব্যবস্থা।
মার্জারী মহাশয়া - স্ত্রী বিড়ালকে সম্বোধনের জন্য মহাশয় এর সঙ্গে আ-প্রত্যয় যোগ করা হয়েছে।
উপবাস - না খেয়ে থাকা।
নসীরাম বাবু - কোন
একজনের নাম।
বিজ্ঞ - জ্ঞানী।
পরাস্ত - পরাজিত।
প্রথানুসারে-নিয়ম অনুসারে।
ধর্মাচরণে - ধর্মের আচার আচরণে।
পাঠার্থে - পড়ার জন্য।
নিউমান - বিখ্যাত লেখক।
অসীম - যার সীমা নেই।
মহিমা - গুণ।
এক্ষণে - এখন।
স্বস্থানে - নিজের জায়গায়।
জলযোগ - হালকা খাবার বা নাশতা।
অধীর - অধৈর্য।
পুনর্বার- আবার।
সরিষা ভোর - সর্ষে দানার সমান।
ক্ষুধানুসারে - কেমন খিদে লাগে তা বিবেচনা করে।


নমুনা প্রশ্নোত্তর

প্রশ্ন: ‘ধর্ম কি? পরোপকারই পরম ধর্ম’ - কথাটা কে কাকে কখন বলেছে?

উত্তর: লেখক বঙ্কিমচন্দ্রের রম্য রচনা ‘বিড়াল’-এর মধ্যে বিড়ালই এই কথা বলেছে কমলাকান্তকে। দিব্যকর্ণ খুলে যাওয়ার পর কমলাকান্ত বিড়ালের মনের কথা শুনতে পেলেন। দুধ চুরি করে খাওয়ার জন্য কমলাকান্ত লাঠি নিয়ে বিড়ালকে মারতে এল। সে ভয় না পেয়ে ‘মেও’ অর্থাৎ কেন মারবে’ প্রশ্ন করে। তারপর সে অনেক যুক্তি তোলে তার আচরণকে উচিত প্রমাণ করার জন্য। বিড়ালের মতে মানুষ নিষ্ঠুর এবং স্বার্থপর। তারা অন্যের দুঃখ কষ্টের কথা ভাবে না। সে শিক্ষাও তারা পায় না। অথচ পরোপকার করাই শ্রেষ্ঠ ধর্ম। এ কথা মানুষের জানা এবং সে রকম আচরণ করা উচিত।

0 মন্তব্য(গুলি):

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Comment below if you have any questions

অফিস/বেসিক কম্পিউটার কোর্স

এম.এস. ওয়ার্ড
এম.এস. এক্সেল
এম.এস. পাওয়ার পয়েন্ট
বাংলা টাইপিং, ইংরেজি টাইপিং
ই-মেইল ও ইন্টারনেট

মেয়াদ: ২ মাস (সপ্তাহে ৪দিন)
রবি+সোম+মঙ্গল+বুধবার

কোর্স ফি: ৪,০০০/-

গ্রাফিক ডিজাইন কোর্স

এডোব ফটোশপ
এডোব ইলাস্ট্রেটর

মেয়াদ: ৩ মাস (সপ্তাহে ২দিন)
শুক্র+শনিবার

কোর্স ফি: ৮,৫০০/-

ওয়েব ডিজাইন কোর্স

এইচটিএমএল ৫
সিএসএস ৩

মেয়াদ: ৩ মাস (সপ্তাহে ২দিন)
শুক্র+শনিবার

কোর্স ফি: ৮,৫০০/-

ভিডিও এডিটিং কোর্স

এডোব প্রিমিয়ার প্রো

মেয়াদ: ৩ মাস (সপ্তাহে ২দিন)
শুক্র+শনিবার

কোর্স ফি: ৯,৫০০/-

ডিজিটাল মার্কেটিং কোর্স

ফেসবুক, ইউটিউব, ইনস্টাগ্রাম, এসইও, গুগল এডস, ইমেইল মার্কেটিং

মেয়াদ: ৩ মাস (সপ্তাহে ২দিন)
শুক্র+শনিবার

কোর্স ফি: ১২,৫০০/-

অ্যাডভান্সড এক্সেল

ভি-লুকআপ, এইচ-লুকআপ, অ্যাডভান্সড ফাংশনসহ অনেক কিছু...

মেয়াদ: ২ মাস (সপ্তাহে ২দিন)
শুক্র+শনিবার

কোর্স ফি: ৬,৫০০/-

ক্লাস টাইম

সকাল থেকে দুপুর

১ম ব্যাচ: সকাল ০৮:০০-০৯:৩০

২য় ব্যাচ: সকাল ০৯:৩০-১১:০০

৩য় ব্যাচ: সকাল ১১:০০-১২:৩০

৪র্থ ব্যাচ: দুপুর ১২:৩০-০২:০০

বিকাল থেকে রাত

৫ম ব্যাচ: বিকাল ০৪:০০-০৫:৩০

৬ষ্ঠ ব্যাচ: বিকাল ০৫:৩০-০৭:০০

৭ম ব্যাচ: সন্ধ্যা ০৭:০০-০৮:৩০

৮ম ব্যাচ: রাত ০৮:৩০-১০:০০

যোগাযোগ:

আলআমিন কম্পিউটার প্রশিক্ষণ কেন্দ্র

৭৯৬, পশ্চিম কাজীপাড়া বাসস্ট্যান্ড,

[মেট্রোরেলের ২৮৮ নং পিলারের পশ্চিম পাশে]

কাজীপাড়া, মিরপুর, ঢাকা-১২১৬

মোবাইল: 01785 474 006

ইমেইল: alamincomputer1216@gmail.com

ফেসবুক: facebook.com/ac01785474006

ব্লগ: alamincomputertc.blogspot.com

Contact form

নাম

ইমেল *

বার্তা *