তালিকাভুক্ত ব্যাংক কি
তালিকাভুক্ত ব্যাংক
তালিকাভুক্ত ব্যাংকেকে তফসিলী ব্যাংকও বলা হয়। ব্যাংকিং জগতে ‘তালিকা’ বা ‘তফসিল’ বলতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক কর্তৃক প্রস্ত্তত এবং রক্ষিত একটি বিশেষ তালিকাকে বুঝায়। এই তালিকায় দেশের অভ্যন্তরে কার্যরত বিভিন্ন ব্যাংকের নাম শর্তসাপেক্ষে আন্তর্ভুক্ত করা হয়। দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক এ তালিকায় নাম অন্তর্ভুক্ত করানোর জন্য বিভিন্ন বাণিজ্যিক ব্যাংক, শিল্প ব্যাংক, বিনিয়োগ ব্যাংক, সমবায় ব্যাংক ইত্যাদির উপর কতগুলো শর্ত জুড়ে দেয়। যে সকল ব্যাংক এসব শর্ত পূরণ করতে পারে তারা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তালিকায় স্থান পায়। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এ তালিকায় অন্যান্য ব্যাংকের নাম অন্তর্ভুক্ত করার প্রক্রিয়াকে তালিকাভুক্তকরণ বলে। বাংলাদেশ ব্যাংকে অন্য কোন ব্যাংক নিজ নাম তালিকাভুক্ত করতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক আরোপিত কতিপয় শর্ত পালন করতে হয়। এ শর্তগুলো পূরণ করতে পারলে বাংলাদেশের ভিতরে কার্যরত যে কোন ব্যাংক বাংলাদেশ ব্যাংকে তালিকাভুক্ত হতে পারে। ব্যাংকগুলো তালিকাভুক্ত হওয়ার পর বাংলাদেশ ব্যাংক হতে বিভিন্ন প্রকার সুযোগ-সুবিধা ভোগ করতে পারে। এই বিষয়ে পরে আলোচনা করা হবে। প্রথমে আমরা তালিকাভুক্তকরণ সম্পর্কে ভাল ধারণা পাওয়ার জন্য তালিকাভুক্ত ব্যাংক সংক্রান্ত বিভিন্ন বিষয়ের উপর সাধারণ আলোচনার সূত্রপাত করব।
তালিকাভুক্ত ব্যাংক বলতে কি বুঝায়
একটি দেশে বিভিন্ন ধরনের বহু সংখ্যক ব্যাংক থাকে। কিন্তু এসব ব্যাংকের সবগুলোই কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সদস্য হিসেবে থাকবে এমন কোন বাধ্যবধকতা নাই। কতিপয় শর্তপূরণ সাপেক্ষে কেন্দ্রীয় ব্যাংক নির্দিষ্ট একটি তালিকায় অন্যান্য ব্যাংকের নামধাম লিপিবদ্ধ করে। এ তালিকায় কোন ব্যাংকের নাম অন্তর্ভুক্ত করার পর সেই ব্যাংক কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সদস্য হিসেবে পরিগণিত হয়। যে ব্যাংক কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সদস্য হওয়ার জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তালিকায় নিজের নাম অন্তর্ভুক্ত করে, সে ব্যাংককে ব্যাংকিং-এর পরিভাষায় তালিকাভুক্ত ব্যাংক (scheduled bank) বা তফসিলী ব্যাংক বলে। সোজা কথায় বলা যায়, যে সকল বাণিজ্যিক ব্যাংক, শিল্প ব্যাংক, কৃষি ব্যাংক, সমবায় ব্যাংক, বিনিয়োগ ব্যাংক অথবা অন্য যে কোন ব্যাংক কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সদস্য হিসেবে এর তালিকার অন্তর্ভুক্ত করে, সেগুলোকে তালিকাভুক্ত ব্যাংক বলে। তালিকাভুক্ত ব্যাংক কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিকট থেকে বিশেষ কতিপয় সুযোগ-সুবিধা ভোগ করতে পারে। তবে বিনিময়ে এদেরকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের আদেশ-নির্দেশ মেনে চলতে হয়।
কোন ব্যাংক ইচ্ছা করলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তালিকাভুক্ত না হয়েও কাজ করতে পারে। বাংলাদেশে কয়েকটি স্থানীয় ব্যাংক ব্যতীত বাকি সব বাণিজ্যিক ব্যাংক, শিল্প ব্যাংক ও কৃষি ব্যাংক বাংলাদেশ ব্যাংকের তালিকাভুক্ত। বাংলাদেশের ভিতরে যেসব বিদেশী ব্যাংক কর্মরত রয়েছে, তারাও বাংলাদেশ ব্যাংকের তালিকার অন্তর্ভুক্ত।
তালিকাভুক্ত ব্যাংকের বৈশিষ্ট্যসমূহ
তালিকাভুক্ত ব্যাংকের বৈশিষ্ট্যসমূহ নিমণরূপ:
১. তালিকাভুক্ত ব্যাংক একটি নিজস্ব-সত্তা বিশিষ্ট ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠান।
২. তালিকাভুক্ত ব্যাংক কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একটি বিশেষ তালিকার অন্তর্ভুক্ত।
৩. তালিকাভুক্ত ব্যাংক কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একটি তালিকাভুক্ত সদস্য।
৪. কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সদস্য হলেও তালিকাভুক্ত ব্যাংকের অভ্যন্তরীণ পরিচালনা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণমুক্ত থাকে।
৫. তালিকাভুক্ত ব্যাংককে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তালিকাভুক্ত থাকার জন্য কতিপয় শর্ত মেনে চলতে হয়। শর্তের বরখেলাপ করলে তালিকাচ্যুত হয়ে যেতে পারে।
৬. কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সদস্য হিসেবে তালিকাভুক্ত ব্যাংককে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ব্যাংকিং-সংক্রান্ত আদেশ-নির্দেশ অনুসরণ করতে হয়।
৭. তালিকাভুক্ত হওয়ার কারণে তালিকাভুক্ত ব্যাংক কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিকট হতে বিশেষ ধরনের কতিপয় সুযোগ-সুবিধা ভোগ করতে পারে।
৮. তালিকাভুক্ত ব্যাংক দেশের অর্থ বাজারের একটি সদস্য হিসেবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক কর্তৃক স্বীকৃত।
প্রসঙ্গতঃ উলেস্নখযোগ্য যে, বাংলাদেশের তালিকাভুক্ত ব্যাংকের বৈশিষ্ট্যসমূহও উপরে বর্ণিত বৈশিষ্ট্যসমূহের মত একইরূপ।
তালিকাভুক্ত ব্যাংক হওয়ার শর্তাবলী
একটি ব্যাংককে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তালিকাভুক্ত হতে হলে নিমেণাক্ত শর্তসমূহ পালন করতে হয়:
১. প্রচলিত আইনানুসারে সংগঠিত: কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তালিকাভুক্ত হতে হলে কোন ব্যাংককে দেশের প্রচলিত ব্যাংকিং আইন অনুযায়ী অথবা অন্যান্য প্রচলিত আইন অনুসারে গঠিত ও নিবন্ধিত হতে হবে।
২. মূলধন ও সংরক্ষিত তহবিল: কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তালিকাভুক্ত হওয়ার জন্য প্রত্যেক ব্যাংককে নির্দিষ্ট পরিমাণ মূলধন সংগ্রহ করতে হয় এবং নির্দিষ্ট পরিমাণ তহবিল সংরক্ষিত রাখতে হয়। এ নিয়ম না মানলে কোন ব্যাংক তালিকাভুক্ত হতে পারে না। তবে নির্দিষ্ট পরিমাণ মুলধন ও সংরক্ষিত তহবিলের পরিমাণ কত হবে তা দেশের আইন বা কেন্দ্রীয় ব্যাংক স্বয়ং নির্ধারণ করে দিবে। বাংলাদেশে তালিকাভুক্ত ব্যাংকের যোগ্যতা অর্জন করবার জন্য নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকার মুলধন ও রিজার্ভ সংরক্ষিত রাখা অপরিহার্য।
৩. কেন্দ্রীয় ব্যাংকে নগদ অর্থ সংরক্ষণ: কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তালিকাভুক্তির যোগ্যতা অর্জনের জন্য প্রত্যেক ব্যাংককে এর মোট আমানতের নির্দিষ্ট পরিমাণ অংশ কেন্দ্রীয় ব্যাংকে সংরক্ষণ করতে হয়। এ অর্থ নগদে জমা দেওয়ার পর কেন্দ্রীয় ব্যাংক জমাকারী ব্যাংককে অন্যান্য শর্ত পূরণ সাপেক্ষে তালিকাভুক্ত করে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকে বাধ্যতামূলকভাবে সংরক্ষিত নগদ অর্থের পরিমাণ বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন রকমের হয়ে থাকে।
৪. তরল সম্পদ সংরক্ষণ: তালিকাভুক্ত হওয়ার জন্য প্রত্যেক ব্যাংককে যে সকল শর্ত পূরণ করতে হয় তনমধ্যে তরল সম্পদ সংরক্ষণ অন্যতম। প্রত্যেক ব্যাংক যাতে গ্রাহকদের দাবী ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় খরচাদি সহজেই প্রতিনিয়ত মিটাতে পারে সেইজন্য তাকে মোট আমানতের একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ অংশ তরল সম্পদ (liquid asset) হিসেবে সংরক্ষণ করতে হয়। ব্যাংকের তারল্যের নিশ্চয়তা বিধানই এরূপ সংরক্ষণের প্রধান উদ্দেশ্য।
৫. সাপ্তাহিক প্রতিবেদন দাখিল: তালিকাভুক্ত ব্যাংক যে সকল আর্থিক কার্যাবলী সম্পাদন করে তার একটি সাপ্তাহিক বিবরণী বা প্রতিবেদন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিকট দাখিল করতে হয়। প্রত্যেক সপ্তাহের শেষ দিনে এ প্রতিবেদন দাখিল করা প্রত্যেক তালিকাভুক্ত ব্যাংকের জন্য বাধ্যতামূলক।
৬. সততার নিশ্চয়তা প্রদান: প্রত্যেক তালিকাভুক্ত ব্যাংককে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিকট এরূপ নিশ্চয়তা প্রদান করতে হয় যে, এর কাজ-কারবার আমানতকারীদের স্বার্থের প্রতিকুলে পরিচালিত হবে না।
0 মন্তব্য(গুলি):
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
Comment below if you have any questions