তড়িৎ কোষ আবিষ্কার হয় কিভাবে?
তড়িৎ কোষ (১৭৮৯) -লুইজি গ্যালভানি (১৭৩৭–১৭৯৮)
লুইজি গ্যালভানি সবার কাছে পরিচিত হয়েছিলেন ব্যাঙ নাচাননা অধ্যাপক নামে। সারাদিন মরা ব্যাঙের ঠ্যাঙের নাচন দেখে কাটিয়ে দিতেন তিনি। মরা ব্যাঙের ঠ্যাং নাচিয়ে যার সময়ে কেটে যায় লোকে তাকে পাগল ছাড়া আর কি ভাববে। কিন্তু কে কি ভাবল তা নিয়ে মাথাব্যথা ছিল না তাঁর। তাঁর এই নিরলস গবেষণা থেকেই পরবর্তীকালে এক অত্যাশ্চর্য আবিষ্কার হয়েছিল।
বাবা ছিলেন ধর্মযাজক, গ্যালিভানি ছোটেবেলা ভাবতেন তিনিও বাবার মত ধর্মযাজক হবেন। কিন্তু তার বাবা তা চাননি। তিনি চেয়েছিলেন ছেলে চিকিৎসাবিদ্যা নিয়ে পড়াশোনা করুক। এজন্য তিনি গ্যালভানিকে বোলোনা বিশ্ববিদ্যালয়ের চিকিৎসা বিভাগে ভর্তি করে দেন। ঐ বিশ্ববিদ্যালয়ে ডাক্তারি পাশ করে তিনি ওখানেই অধ্যাপনার কাজ পান। ঐ বিশ্ববিদ্যালয়েই ১৭৮০ সাল থেকে শারীরবিদ্যা বিষয়ে গবেষণা চালাচ্ছিলেন গ্যালভানি। বাড়ীতেও তৈরী করে নিয়েছিলেন একটি গবেষণাগার। তাঁর গবেষণার ব্যাপারে তাঁর স্ত্রী লুসিও তাঁকে সাহায্য করতেন।
১৭৮৯ সালে একদিন গ্যালভানি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের ব্যাঙের শরীরের গঠনপ্রণালী বোঝাবার জন্য একটি মরা ব্যাঙ ক্লাসে নিয়ে এলেন। ব্যাঙের গায়ের চামড়া ছাড়িয়ে একটি ধাতুর ট্রের ওপর রাখলেন। তারপর ব্যা ওটার শিরা, উপশিরা, স্নায়ু ইত্যাদির অবস্থান ছাত্রদের বোঝাবার জন্য একটি তব শলাকা দিয়ে ব্যাঙের গায়ে যেই স্পর্শ করলেন অমনি ব্যাঙটা লাফিয়ে উঠল। ছাত্ররা সঙ্গে সঙ্গে জিজ্ঞাসা করলো এরকম হওয়ার কারণ কি? কিন্তু গ্যালভানি তো নিজেই জানেন না কারণটা। ছাত্রদের কি বলবেন!
ব্যাঙের ঠ্যাঙ নেচে ওঠার কারণ জানতেই তিনি উঠে পড়ে লাগলেন। বাড়ীতে ফিৱে গবেষণাগারে তিনি একটি ব্যাঙ কেটে একটি তামার তারে বেঁধে লোহার রডে ঝুলিয়ে রাখলেন, তারপর হঠাৎ কি একটা কাজে তিনি বেরিয়েছেন। তাঁর স্ত্রী সে সময় গবেষণাগারে এলেন স্বামীর খোঁজ করতে। হঠাৎ তাঁর চোখে পড়ল মরা ব্যাঙের ঠ্যাঙটা একবার ঝুলে পড়ছে আবার লাফিয়ে উঠছে। তিনি ভাবলেন এরকম হওয়ার কারণ কি, কৌতূহল মেটাতে তিনি কাছে গিয়ে লক্ষ্য করে দেখলেন রডে ঝুলানো ব্যাঙের পায়ের ঠিক নীচে রয়েছে একটি তামার শলাকা। ব্যাঙের পাটা যেই সেই তামার শলাকাতে ঠেকেছে অমনি লাফিয়ে উঠছে। স্বামী বাড়ী ফিরতেই তিনি ঘটনাটা জানালেন। গ্যালভানি বুঝলেন লোহার রডে ঝোলানো ব্যাঙের ঠ্যাঙ তামার শলাকায় স্পর্শ করছে বলেই এই সংকোচনটা হচ্ছে, তাঁর মনে হল বিদ্যুতের জন্যই বুঝি এইসব হচ্ছে। প্রাণী দেহের মধ্যেই বুঝি থাকে এই বিদ্যুৎ, তাই তামার শলাকা দিয়ে ছুঁলে অঙ্গ প্রত্যঙ্গ কেঁপে ওঠে। এই বিদ্যুতের তিনি নাম দিলেন প্রাণীর দেহজাত বিদ্যুৎ।
কিন্তু পরবর্তীকালে বিদ্যুৎ সৃষ্টি প্রক্রিয়ার এই ব্যাখ্যা মেনে নিলেন না ইটালীর পাভিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিদ্যার অধ্যাপক আলেকজান্দ্রো ভোল্টা। ব্যাঙ নেচে ওঠার কারণ বিদ্যুৎ ঠিকই, তবে এই বিদ্যুৎ প্রাণীর দেহ থেকে নয়, রাসায়নিক প্রক্রিয়ার ফলে সৃষ্ট। দুটি ভিন্ন ধাতু নুন বা সোডিয়াম ক্লোরাইডের দ্রবণের সংস্পর্শে রাখলে যে রাসায়নিক বিক্রিয়া হয় তার ফলে বিদ্যুৎ উৎপন্ন হয়। ব্যাঙের স্নায়ুকোষের মধ্যে থাকে নুন জল। তাই লোহা ও তামার দুটি ভিন্ন ধাতু যখন ব্যাঙের শরীরে স্পর্শ করে তখনই বিদ্যুৎ উৎপন্ন হয় আর তার ফলেই ব্যাঙের ঠ্যাঙ লাফিয়ে ওঠে।
ভোল্টা তাঁর এই ব্যাখা প্রমাণের জন্য কতগুলি দস্তা ও তামার পাত। একটার পর একটা সাজিয়ে প্রতিটি দস্তা ও তামার পাতের মধ্যে সোডিয়াম ক্লোরাইডে ভেজানো ব্লটিং কাগজ বা কাপড় রেখে দেন। এই জিনিসটার নাম তিনি দেন তড়িৎ কোষ। এই কোষের সবচেয়ে ওপরে রাখেন দস্তার পাত। | আর নীচে রাখেন তামার পাত, এবার একটি তামার তার দিয়ে উপরের দস্তার পাত ও নীচে তামার পাত যুক্ত করে দেখান যে কোষটির ভিতর দিয়ে | বিদ্যুৎ প্রবাহিত হচ্ছে। এই তড়িৎ-কোষটিকে তাঁর নামানুসারে নাম দেওয়া হয় ভোল্টা-সেল। এই কোষ বা সেল থেকেই পরবর্তীকালে বৈদ্যুতিক ব্যাটারীর সৃষ্টি হয়েছে।
0 মন্তব্য(গুলি):
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
Comment below if you have any questions