পানিপথের প্রথম যুদ্ধ
পানিপথের প্রথম যুদ্ধ, ১৫২৬ খ্রিস্টাব্দ
বাবর বুঝেছিলেন পানিপথের প্রান্তরের যুদ্ধে জয় লাভ করলে তার দিল্লির সিংহাসনে বসার পথ সহজ হয়ে যাবে। তাই তিনি দিল্লির নিকটবর্তী পানিপথ প্রান্তরে দিল্লির লোদী বংশের শেষ সুলতান ইব্রাহিম লোদীর সাথে যুদ্ধে জড়িয়ে পরেন। তারিখটি ছিল ১৫২৬ খ্রিস্টাব্দে ১২ এপ্রিল। বাবরের আত্মজীবনী তুযুক-ই-বাবরী থেকে জানা যায়, এ সময়ে তার সাথে বার হাজার সৈন্য ছিল। তাছাড়া পাঞ্জাব জয়ের পর কিছু সংখ্যক অতিরিক্ত সৈন্যও তাঁর সাথে যোগদান করে। তার জ্যৈষ্ঠপুত্র হুমায়ুনও তাঁর সাথে যোগ দিয়েছিলেন। অপরদিকে ইব্রাহিম লোদীর সৈন্য সংখ্যা ছিল এক লক্ষ। পানিপথ প্রান্তরে বাবর ভিন্ন রকম যুদ্ধ কৌশল গ্রহণ করেছিলেন। প্রতিরক্ষা হিসেবে পরিখা খনন করেন। আর ভারতবর্ষে প্রথমবারের মতো কামান ও গোলন্দাজ বাহিনী ব্যবহার করেন। শেষ পর্যন্ত যুদ্ধে ইব্রাহিম লোদী পরাজিত ও নিহত হন।
যুদ্ধে বাবরের সাফল্যের কারণ
প্রথম পানিপথের যুদ্ধে বাবরের বিজয়ের মূল কারণগুলো নিম্নরুপ:
১. বাবরের সৈন্য ইব্রাহিম লোদীর সৈন্য অপেক্ষা অধিক সুশৃঙ্খল ও সুশিক্ষিত ছিল।
২. ইব্রাহিম লোদীর অস্ত্রশস্ত্র অপেক্ষা বাবরের অস্ত্রশস্ত্র ছিল অধিক উন্নতমানের।
৩. বাবর ছিলেন একজন দক্ষ সেনানায়ক। তিনি ইব্রাহিম লোদীর বিশাল বাহিনীর বিরুদ্ধে দক্ষতার সাথে এবং উন্নত যুদ্ধ কৌশল গ্রহণ করে জয় লাভ করেন। তাছাড়া যুদ্ধ পরিচালনায় ইব্রাহিম লোদী অপেক্ষা বাবর অধিক অভিজ্ঞ ছিলেন।
৪. ইব্রাহিম লোদীর আত্মীয় স্বজনের ষড়যন্ত্র তাঁকে যেমন দুর্বল ও শক্তিহীন করে ফেলেছিল বিপরীত দিকে এই পরিস্থিতি বাবরকে যুদ্ধে অনুপ্রাণিত করেছিল।
৫. বাবর প্রথম ভারতবর্ষে যুদ্ধ ক্ষেত্রে আগ্নেয়াস্ত্র কামান ব্যবহার করেন। তাঁর গোলন্দাজ বাহিনী সুশৃঙ্খল ও দক্ষ ছিল।
৬. বাবর উজবেগী ও তুর্কীদের নিকট থেকে নতুন রণকৌশল শিখেছিলেন। এ কৌশলকে বলা হত ‘তুলঘুমা’ যুদ্ধরীতি। এ রীতি মোতাবেক তিনি যুদ্ধে পরিখা খনন, সৈন্যদের মাঝে ব্যুহ রচনা, আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার ও অশ্বারোহী দ্বারা আক্রমণ পরিচালনা করেন।
পানিপথের যুদ্ধের ফলাফল
পানিপথের প্রথম যুদ্ধ ভারতবর্ষের ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। এ যুদ্ধে বাবরের বিজয়ের ফলে ভারতের তুর্কী আফগান দীর্ঘ শাসনের (১২০৩-১৫২৬ খ্রি.) অবসান ঘটে। এ যুদ্ধের ফলে বাবর দিল্লি ও আগ্রা অধিকার করে লোদী সাম্রাজ্যের পতন ঘটিয়ে মোগল বংশের ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করেন। পানিপথের যুদ্ধের ফল হিসেবে ভারতের প্রভুত্ব সম্পূর্ণরূপে না হলেও আংশিকভাবে বাবরের হাতে চলে যায়। পানিপথের যুদ্ধে বিজয়ী হওয়ার পর বাবর মোগল বাহিনীর অঙ্গ হিসাবে ভারতবর্ষে গোলন্দাজ বাহিনী প্রবর্তন করেন। এ যুদ্ধে বাবরের সামরিক শ্রেষ্ঠত্ব নিঃসন্দেহে প্রমাণিত হয়। রাব্রুক উইলিয়ামস বলেছেন যে, “পানিপথের জয় দ্বারা সাম্রাজ্য স্থাপনের প্রথম পদক্ষেপ ঘটে; তখনও আফগান উপজাতিসমূহের বিরোধিতা ছিল প্রধান বাধা”। পানিপথের যুদ্ধ জয়ের পর বাবর দিল্লি ও আগ্রায় বহু ধনরত্ন হস্তগত করেন এবং এ সম্পদ বিতরণ করে তিনি সহযোগীদের সমর্থন আদায় করেন। তাছাড়া পানিপথের জয়ের পর বাবর ভারতবর্ষে স্থায়ীভাবে রাজত্ব প্রতিষ্ঠার সঙ্কল্প গ্রহণ করেন। এ যুদ্ধে জয়ের ফলে উত্তর ভারতের বিস্তীর্ণ অঞ্চল বাবরের অধিকারে আসে। বহু আফগান সর্দার তাঁর বশ্যতা স্বীকার করেন। সুতরাং বলা যায় পানিপথের এই যুদ্ধের ফলাফলের মধ্য দিয়ে ভারতবর্ষে দীর্ঘস্থায়ী মোগল সাম্রাজ্যের সূচনা পর্ব শুরু হয়।
0 মন্তব্য(গুলি):
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
Comment below if you have any questions