১৯৩৫ ভারত শাসন আইন
১৯৩৫ খ্রিস্টাব্দের ভারত শাসন আইনটি ছিল একটি সুবৃহৎ দলিল। ভারতের শাসনতান্ত্রিক ইতিহাসে এটি এক। গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে রয়েছে। ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে ভারত বিভক্তির সময়ও এ আইন কার্যকরী ছিল। স্বাধীন রাষ্ট্র ভারত ও পাকিস্তানের নিজস্ব সংবিধান তৈরি না হওয়া পর্যন্ত এ আইন সংশােধিত আকারে বলবৎ থাকে।
১৯২৭ খ্রিস্টাব্দে গঠিত সাইমন কমিশনের রিপোর্ট ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত হয়। কিন্তু ভারতীয় রাজনৈতিক দলগুলো একে প্রত্যাখ্যান করে। আপনারা পূর্ববর্তী পাঠে জেনেছেন বৃটিশ সরকার সংবিধান বিষয়ে ভারতীয় নেতৃবৃন্দের মতামত জানার জন্য লন্ডনে গোলটেবিল বৈঠকের আয়োজন করেছিল। তিনটি গোল টেবিল বৈঠকে আলোচনা করেও শাসনতান্ত্রিক সমস্যার কোনো সমাধান হয় নি। ইতোমধ্যে বৃটিশ প্রধানমন্ত্রী রামজে ম্যাকডোনাল্ড আইন সভায় বিভিন্ন সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিত্বের প্রশ্নে স্বীয় সিদ্ধান্তে এক সাম্প্রদায়িক রোয়েদাদ ঘোষণা করেন। কংগ্রেসসহ বিভিন্ন দল ও সম্প্রদায় এর তীব্র নিন্দা জ্ঞাপন করে। তিনটি গোলটেবিল বৈঠকের আলোচনা সম্বলিত একটি শ্বেতপত্র বৃটিশ সরকার প্রকাশ করে ১৯৩৩ খ্রিস্টাব্দে। সাইমন কমিশনের রিপোর্ট এবং উক্ত শ্বেতপত্রের আলোকে পরের বছর ভারতের জন্য একটা নতুন সংবিধানের খসড়া প্রকাশিত হয়। এ খসড়ার ভিত্তিতেই ১৯৩৫ খ্রিস্টাব্দে বৃটিশ পার্লামেন্টের উভয় হাউসে ভারতের শাসনকার্যের জন্য একটা নতুন শাসনতন্ত্র গৃহীত হয়। এটাই ১৯৩৫ খ্রিস্টাব্দের বিখ্যাত ভারত শাসন আইন।
ভারত শাসন আইনের প্রধান বৈশিষ্ট্যসমূহ ভারত শাসনে যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকার পদ্ধতি এবং প্রদেশে স্বায়ত্তশাসন প্রবর্তন ছিল ১৯৩৫ খ্রিস্টাব্দের ভারত শাসন আইনের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। এ আইনে স্থির হয় যে, বৃটিশ ভারতের প্রদেশসমূহ ও দেশীয় রাজ্যগুলোকে নিয়ে একটা যুক্তরাষ্ট্র গঠিত হবে। যুক্তরাষ্ট্রের শাসনভার গভর্নর জেনারেল ও তার মন্ত্রীসভার হাতে ন্যস্ত থাকবে। মন্ত্রীগণ আইন সভার মধ্য থেকে গভর্নর জেনারেল কর্তৃক নিয়োজিত হবেন এবং তাঁরা আইন সভার নিকট দায়ী থাকবেন।
কেন্দ্রীয় সরকারের শাসনকার্য সংরক্ষিত ও হস্তান্তরিত-এ দুভাগে বিভক্ত হবে। সংরক্ষিত বিষয়গুলোর যেমন দেশরক্ষা, বৈদেশিক সম্পর্ক, ধর্ম ও উপজাতি সম্পৰ্কীয় বিষয় ইত্যাদি পরিচালনার দায়িত্ব গভর্নর জেনারেল ও তিনজন উপদেষ্টার হাতে ন্যস্ত থাকবে। হস্তান্তরিত বিষয়গুলো যথা শিক্ষা, স্বাস্থ্য, আইন-শৃংখলা ইত্যাদি গভর্নর জেনারেল কর্তৃক মন্ত্রী পরিষদের পরামর্শ অনুসারে পরিচালিত হবে। ক্ষমতার এ বণ্টন দ্বারা কেন্দ্রে দ্বৈতশাসন প্রবর্তনের পরিকল্পনা করা হয়। এ আইনে গভর্নর জেনারেলকে স্বেচ্ছাধীন ক্ষমতাও দেয়া হয়। তিনি ইচ্ছা করলে আইন সভার পরামর্শ না নিয়েই মন্ত্রীসভা ভেঙ্গে দিতে পারবেন। যুক্তরাষ্ট্রে দেশীয় রাজ্যগুলোর যোগদান স্বেচ্ছামূলক করা হয়। আইনে এটাও বলা হয় যে ফেডারেল আইনসভার উচ্চ পরিষদের মোট আসন সংখ্যার অর্ধেক দেশীয় রাজ্যগুলো দ্বারা পূর্ণ না হওয়া পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্র গঠিত হবে না।
১৯৩৫ খ্রিস্টাব্দের আইনে কেন্দ্রে একটা দ্বি-কক্ষ বিশিষ্ট আইনসভা গঠনের ব্যবস্থা ছিল। উচ্চ কক্ষটি রাষ্ট্রসভা এবং নিম্নকক্ষ ফেডারেল পরিষদ নামে অভিহিত হবে স্থির হয়। মোট এগারটি গভর্নর শাসিত প্রদেশের মধ্যে ছয়টিতে দ্বি-কক্ষ বিশিষ্ট আইন সভা এবং অবশিষ্ট পাঁচটিতে এক কক্ষ বিশিষ্ট আইনসভা প্রবর্তিত হয়। ১৯৩২ খ্রিস্টাব্দের সাম্প্রদায়িক রোয়েদাদ অনুযায়ী কেন্দ্রের ন্যায় বিভিন্ন প্রদেশেও মুসলিম ও অনুন্নত শ্রেণির জন্য পৃথক নির্বাচন ব্যবস্থা চালু করা হয়।
এ আইনে প্রদেশগুলোতে দ্বৈত শাসনের পরিবর্তে স্বায়ত্তশাসনের ব্যবস্থা করা হয়। নতুন আইন অনুযায়ী প্রদেশের শাসন ব্যবস্থার প্রধান হবেন একজন গভর্নর। জনগণের নির্বাচনে গঠিত হবে একটি আইন সভা। ঐ আইন সভার সদস্যদের মধ্য থেকে গভর্নরকে পরামর্শ দান ও সাহায্যের জন্য একটি মন্ত্রীসভা গঠিত হবে। আইন-শৃংখলা প্রভৃতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় গভর্নরের এখতিয়ারে থাকবে। মন্ত্রীগণ তাদের কাজের জন্য দায়ী থাকবেন প্রাদেশিক আইন সভার নিকট। গভর্নরকে বিশেষ ক্ষমতাও দেয়া হয়। সে ক্ষমতা বলে তিনি ইচ্ছা করলে আইনসভা ও মন্ত্রীসভা ভেঙ্গে দিতে পারবেন। তাছাড়া যেকোন অর্ডিন্যান্স বা জরুরী আইন প্রণয়নের ক্ষমতাও তাঁর ছিল।
ভারত সচিবের কাউন্সিল এ আইনের বলে বিলুপ্ত হয়। বার্মাকে ভারত থেকে আলাদা করা হয়। সিন্ধু ও উড়িষ্যা নামে দুটি নতুন প্রদেশ গঠিত হয়। যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার পরিপূরকরূপে এ আইনে একটি যুক্তরাষ্ট্রীয় আদালত প্রতিষ্ঠা করার ব্যবস্থা নেয়া হয়।
ভারতশাসন আইনের প্রতিক্রিয়া
১৯৩৫ খ্রিস্টাব্দের ভারত শাসন আইন দ্বারা সর্বভারতীয় যুক্তরাষ্ট্র গঠনের যে পরিকল্পনা করা হয়েছিল, তা কার্যকর করা হয় নি। ভারতে কোন রাজনৈতিক দল এ আইনে সন্তুষ্ট হতে পারে নি। কংগ্রেস এ আইনের তীব্র নিন্দা করে। জওহরলাল একে ‘দাসত্বের এক নতুন অধ্যায় বলে অভিহিত করেন। কংগ্রেস সভাপতি রাজেন্দ্র প্রসাদ অভিযোগ করেন যে, এ আইনে স্বায়ত্ত শাসনের স্বাভাবিক অগ্রগতির কোনো লক্ষণ নেই। হিন্দু মহাসভাও এ আইন সমর্থন করে নি। মুসলিম লীগ নেতা মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ এ আইনে প্রস্তাবিত যুক্তরাষ্ট্রীয় পদ্ধতির সমালোচনা করেন। তবে তিনি প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনের বিধানগুলো সমর্থন করেন। অবশ্য সে আইনে প্রাদেশিক গভর্নরকে এত ক্ষমতা দেয়া হয়েছিল যে এর ফলে প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন ব্যবস্থাকে প্রকৃত দায়িত্বশীল বলা যায় না।
পরিশেষে বলা যায় যে, ১৯৩৫ খ্রিস্টাব্দের ভারত শাসন আইন এ দেশের শাসনতান্ত্রিক ইতিহাসে যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। ভারতে যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকার পদ্ধতি এবং প্রদেশে স্বায়ত্তশাসন প্রবর্তনের প্রয়াস এ আইনের অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য। কিন্তু শেষ পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা প্রবর্তন সম্ভব হয় নি। অবশ্য প্রদেশ সমূহে এক ধরনের স্বায়ত্তশাসন চালু হয়। কিন্তু প্রদেশের প্রধান নির্বাহীকর্তা গভর্নরের হাতে কতগুলো বিশেষ ক্ষমতা থাকায় সে ব্যবস্থাকে পরিপূর্ণ দায়িত্বশীল সরকার বলা যায় না। তথাপি ভারতবর্ষের শাসনতান্ত্রিক ইতিহাসে ১৯৩৫ খ্রিস্টাব্দের আইন যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ।
0 মন্তব্য(গুলি):
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
Comment below if you have any questions