লাহোর প্রস্তাব কি
উপমহাদেশের মসুলমানদের রাজনৈতিক ইতিহাসে লাহোর প্রস্তাব অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। ১৯৪০ খ্রিস্টাব্দের মার্চ মাসে মুসলিম লীগের লাহোর অধিবেশনে ভারতের উত্তর-পশ্চিম ও উত্তর-পূর্বাঞ্চলে মুসলিম অধ্যুষিত অঞ্চলসমূহে একাধিক স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার দাবি উঠে। লাহোর প্রস্তাবের মধ্যদিয়েই এই দাবি স্পষ্ট হয়ে ওঠে। এ প্রস্তাবের ফল হয়েছিল সুদূরপ্রসারী।
লাহোর প্রস্তাবের পটভূমি
ঔপনিবেশিক ভারতে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা চালু করার ক্ষেত্রে স্বতন্ত্রভাবে ভোট দিয়ে নিজস্ব প্রতিনিধি নির্বাচন করার অধিকারের দাবি মুসলমানদের বহুদিনের। লক্ষৌচুক্তিতে কংগ্রেস মুসলমান সম্প্রদায়ের এ অধিকার মেনে নিলেও পরে আবার অস্বীকার করে। বহুদিন পর্যন্ত ভারতীয় রাজনীতিতে হিন্দু মুসলিম বিরােধের ক্ষেত্রে এটা ছিল একটা জটিল বিষয়। এ কারণে শাসনতান্ত্রিক সমস্যা সমাধানের কতগুলো উদ্যোগ ব্যর্থ হয়ে যায়। ১৯৩৫ খ্রিস্টাব্দের ভারত শাসন আইনের অধীনে প্রস্তাবিত প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন ব্যবস্থা ১৯৩৭ খ্রিস্টাব্দে কার্যকর করা হয়। ভারতের বিভিন্ন প্রাদেশিক নির্বাচনে অধিকাংশ প্রদেশেই কংগ্রেস সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। তাছাড়া মুসলিম লীগের সাথে কোনো প্রকার আলাপ-আলোচনা ছাড়াই কংগ্রেস মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রদেশগুলোতে মন্ত্রীসভা গঠন করে। কংগ্রেসের সভাপতি পণ্ডিত জওহরলাল নেহেরু এ সময় দাবি করেন যে, ভারতে দুটি শক্তির অস্তিত্ব লক্ষণীয় একটি সরকার, অপরটি কংগ্রেস। অন্যকোনো দলের অস্তিত্ব তিনি স্বীকার করতে নারাজ। তাঁর এ মন্তব্য মুসলমান নেতাদের মধ্যে প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। জিন্নাহ এতদিন পর্যন্ত যিনি রাজনীতিতে হিন্দু মুসলিম মিলনের প্রবক্তা ছিলেন, তিনিও এতে ব্যথিত হন। ১৯৩৮ খ্রিস্টাব্দে সিন্ধু প্রাদেশিক মুসলিম লীগের সভায় তিনি হিন্দু ও মুসলমানদেরকে দুটি পৃথক জাতি বলে আখ্যায়িত করেন। বস্তুত ১৯৪০ খ্রিস্টাব্দের লাহোর প্রস্তাবের পূর্বেই অনেক মুসলমান নেতাদের মধ্যে ভারত বিভাগ এবং হিন্দু ও মুসলমানদের জন্য স্বতন্ত্র রাষ্ট্র গঠনের চিন্তাধারা প্রবল হয়ে উঠে। লীগ সভাপতি জিন্নাহ্ও একে হিন্দু-মুসলিম প্রশ্নের ও শাসনতান্ত্রিক সমস্যা সমাধানের একমাত্র উপায় বলে স্থির করেন।
১৯৪০ খ্রিস্টাব্দের লাহোর প্রস্তাবের পেছনে রাজনৈতিক ধারার একটা পটভূমি রয়েছে। এ প্রস্তাবে যে স্বাধীন মুসলিম আবাসভূমির দাবি করা হয়েছে অনুরূপ একটা প্রস্তাব ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দে কবি ইকবাল তার একটি ভাষণে উল্লেখ করেন। তিন বছর পর ১৯৩৩ খ্রিস্টাব্দে কেম্ব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র চৌধুরী রহমত আলী ভারতের উত্তর পশ্চিমাঞ্চলের সংখ্যা গরিষ্ঠ মুসলিম এলাকাগুলোর জন্য পাকিস্তান' নামের উদ্ভাবন করেন।
কিন্তু ১৯৩৭-৩৮ সাল পর্যন্ত মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ্ মুসলমানদের জন্য পৃথক কোনো রাষ্ট্রের কথা ভাবেন নি। কংগ্রেস নেতাদের দম্ভোক্তি তাঁকে আহত করে এবং রাজনীতির নতুন কৌশল তিনি অবলম্বন করেন। যদিও কখনও তিনি কোন সাম্প্রদায়িক ব্যক্তি ছিলেন না। ১৯৩৭ খ্রিস্টাব্দের নির্বাচনের পর যেসব প্রদেশে কংগ্রেসের মন্ত্রীসভা গঠিত হয়েছিল, সেখানে তাদের কার্যকলাপ মুসলমানদেরকে যথেষ্টভাবে আহত করে। তারা বুঝেছিল সংখ্যালঘু হিসেবে তাদের আশা-আকাঙ্ক্ষা হিন্দুদের শাসনাধীনে কখনো বাস্তব রূপ নেবে না। এ ধরণের পরিস্থিতিতে ১৯৩৯ খ্রিস্টাব্দে জিন্নাহ তাঁর “দ্বি-জাতিতত্ত্ব” ঘোষণা করেন। পরবর্তী বছর লাহোরে মুসলিম লীগের ঘোষণায় এরই প্রতিধ্বনি পুনর্ব্যক্ত হয়েছে।
লাহোর প্রস্তাব
১৯৪০ খ্রিস্টাব্দের ২৩ মার্চ লাহোরে অনুষ্ঠিত মুসলিম লীগের অধিবেশনের সভাপতি ছিলেন মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ্। এ অধিবেশনেই বাংলার নেতা ও প্রধানমন্ত্রী এ.কে. ফজলুল হক বিখ্যাত লাহোর প্রস্তাব উত্থাপন করেন। এতে বলা হয় যে, কোনো শাসনতান্ত্রিক পরিকল্পনা এদেশে কার্যকর বা মুসলমানদের কাছে গ্রহণযোগ্য হবে না যদি একটি নিম্নবর্ণিত মূলনীতির উপর প্রতিষ্ঠিত না হয়।
লাহোর প্রস্তাবের মূলনীতিগুলো হলো:
ক. ভৌগোলিক দিক থেকে সংলগ্ন এলাকাগুলোকে প্রয়োজনীয় রদবদলের মাধ্যমে পৃথক অঞ্চল হিসেবে চিহ্নিত করতে হবে;
খ. ভারতের উত্তর-পশ্চিম ও পূর্বাঞ্চলে এ ধরনের মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ | এলাকাসমূহে স্বাধীন রাষ্ট্র ব্যবস্থা গঠন করতে হবে এবং
গ. এভাবে গঠিত স্বাধীন রাষ্ট্রসমূহের অঙ্গরাজ্যগুলো থাকবে স্ব-শাসিত ও সার্বভৌম।
লাহোর প্রস্তাবে আরও বলা হয় যে, সর্বক্ষেত্রে সংখ্যালঘুদের বিভিন্ন স্বার্থ ও অধিকার রক্ষাকল্পে সংবিধানে প্রয়োজনীয় রক্ষাকবচ রাখতে হবে। প্রকৃত পক্ষে আঞ্চলিক স্বাধিকার আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার ও সার্বভৌমত্ব অর্জনই ছিল লাহোর প্রস্তাবের মূল বক্তব্য।
লাহোর প্রস্তাবের ব্যাখ্যা
লাহোর প্রস্তাবের ব্যাখ্যা নিয়ে কিছুটা মতভেদ আছে। কারও কারও মতে লাহোর প্রস্তাবে দুটি স্বাধীন রাষ্ট্র গঠনের কথা বলা হয়েছে। একটি উত্তর পশ্চিমে এবং অন্যটি পূর্বে। অন্যমত হলো লাহোর প্রস্তাবে একটি রাষ্ট্রের কথাই বলা হয়েছে, যার ইউনিটগুলো হবে স্ব-শাসিত। ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দের এপ্রিল মাসে দিল্লীতে মুসলিম লীগ দলীয় আইন সভার সদস্যদের অধিবেশনে লাহোর প্রস্তাব সংশোধন করে এক রাষ্ট্রের দাবি রাখা হয়। এর ফলে ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে ভারত বিভাগের সময় মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চলসমূহ নিয়ে একটিমাত্র মুসলিম রাষ্ট্র পাকিস্তান’ গঠিত হয়।
লাহোর প্রস্তাবের প্রতি হিন্দু ও কংগ্রেস নেতাদের প্রতিক্রিয়া ছিল তীব্র। পণ্ডিত নেহেরু এ প্রস্তাবের তীব্র নিন্দা করেন এবং মুসলমানদের স্বতন্ত্র ও স্বাধীন আবাসভূমি গঠন অবান্তর বলে আখ্যায়িত করেন। মহাত্মা গান্ধীও তাঁর লেখায় এর সমালোচনা করেন এবং ভারত বিভাগ করাকে পাপের সমতুল্য বলে মন্তব্য করেন। বর্ণ হিন্দুরা এ প্রস্তাব অনুযায়ী ভারত বিভক্তি পছন্দ না করলেও ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে বাংলা ও পাঞ্জাব ভাগ করার দাবি তোলে। এটা অনস্বীকার্য যে, ভারতের | রাজনৈতিক ইতিহাসে লাহোর প্রস্তাবের প্রভাব অপরিসীম।
শেষে বলা যায় যে, ‘লাহোর প্রস্তাব' ভারতের মুসলমানদের রাজনৈতিক ইতিহাসে নি:সন্দেহে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি ঘটনা। ১৯৪০ খ্রিস্টাব্দের মার্চে মুসলিম লীগের লাহোর অধিবেশনে বাংলার নেতা শেরে বাংলা এ.কে. ফজলুল হক এ প্রস্তাব উত্থাপন করেন। এতে ভারতের উত্তর পশ্চিম ও পূর্বাঞ্চলে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চলে একাধিক স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব করা হয়। কংগ্রেস নেতৃবৃন্দ এ প্রস্তাবের তীব্র নিন্দা জানান এবং একে অবান্তর দাবি বলে মন্তব্য করেন।
0 মন্তব্য(গুলি):
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
Comment below if you have any questions