সাম্প্রদায়িক রোয়েদাদ কি
১৯১৯ খ্রিস্টাব্দের ভারত শাসন আইনের কার্যকারিতা নিরূপণ এবং শাসনতান্ত্রিক সংস্কারের ক্ষেত্রে পরবর্তী করণীয় নির্ধারণের উদ্দেশ্যে ১৯২৭ খ্রিস্টাব্দে বৃটিশ সরকার সাইমন কমিশন নিয়োগ করে। কিন্তু ভারতের সব রাজনৈতিক দল একে বয়কট করায় কমিশনের রিপোর্ট গ্রহণ করতেও তারা অস্বীকার করে। বৃটিশ সরকার এ সময়ে ভারতীয় নেতৃবৃন্দের সঙ্গে আলোচনার জন্য লন্ডনে এক গোল টেবিল বৈঠকের আয়োজন করে। ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দে গোল টেবিল বৈঠকের প্রথম অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়। কিন্তু সাম্প্রদায়িক প্রতিনিধিত্বের দাবির ক্ষেত্রে সমঝোতার অভাবে এবং কংগ্রেস এ অধিবেশনে যোগ না দেয়ায় উক্ত অধিবেশন ব্যর্থ হয়। পরের বছর অনুষ্ঠিত গোল টেবিল বৈঠকের দ্বিতীয় অধিবেশনের শেষ দিকে বৃটিশ প্রধানমন্ত্রী রামজে ম্যাকডোনাল্ড অতি স্পষ্ট ভাষায় উচ্চারণ করেন যে, ভারতের বিভিন্ন সম্প্রদায় নিজেরা নিজেদের গ্রহণযোগ্য ফর্মুলা বের করতে না পারলে বৃটিশ সরকার এককভাবে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত দিতে বাধ্য হবেন। দ্বিতীয় গোল টেবিল বৈঠকেও সংখ্যালঘু সমস্যা সম্পর্কে ভারতীয় নেতাদের মধ্যে কোনো মতৈক্য হয় নি। ফলে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের নেতৃবৃন্দ বৃটিশ প্রধানমন্ত্রীর উপর চাপ প্রয়োগ করেন এ সমস্যার সমাধানের জন্যে। তিনি উদ্ভুত পরিস্থিতিতে স্বীয় উদ্যোগে এ রোয়েদাদ ঘোষণা করেন। এটাই ‘সাম্প্রদায়িক রোয়েদাদ’ বা ‘সাম্প্রদায়িক বাটোয়ারা' নামে অভিহিত। ১৯৩২ খ্রিস্টাব্দের ১৬ আগস্ট এ রোয়েদাদ ঘোষণা করা হয়।
সাম্প্রদায়িক রোয়েদাদ ভারতবর্ষের সাম্প্রদায়িক সমস্যার সমাধানের লক্ষ্যে নিম্নের সিদ্ধান্তসমূহ আরোপ করে:
১. প্রদেশগুলোর আইন সভায় বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে আসন বণ্টন করা হয়।
২. রোয়েদাদে মুসলমান, শিখ, ভারতীয় খ্রিস্টান, এ্যাংলো-ইন্ডিয়ান ও নারী সম্প্রদায়ের দাবি মেনে নিয়ে পৃথক নির্বাচনের ব্যবস্থা করা হয়। অর্থাৎ এসব সম্প্রদায়ের জন্য সংরক্ষিত আসনে কেবল সে সম্প্রদায়ের লোকরাই ভোট দেবে। এরা একই সঙ্গে আবার সাধারণ নির্বাচনী এলাকায়ও ভোট দিতে পারবে। শ্রমিক ও বণিক সংগঠন, জমিদার এবং বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকেও নির্দিষ্ট আসন এবং পৃথক নির্বাচনী এলাকা প্রদান করা হয়।
৪. সাম্প্রদায়িক রোয়েদাদে হরিজনদের সংখ্যালঘু হিসেবে ঘোষণা করা হয় এবং এসব অনুন্নত শ্রেণির হিন্দুদের জন্য পৃথক আসন নির্ধারিত হয়। তাদেরকে একাধারে পৃথক নির্বাচনী এলাকা এবং সাধারণ নির্বাচনী এলাকায় ভোট দানের সুযোগ দেয়া হয়।
৫. হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রদেশে মুসলমানদের বিশেষ সুবিধা দান করে এ রোয়েদাদ।
৬. পাঞ্জাবে শিখ ও বাংলা প্রদেশে ইউরোপিয়ানদেরকে তাদের জনসংখ্যার হারের চেয়ে অধিক আসন বরাদ্দ করা হয়। বোম্বে প্রদেশে মারাঠীদের জন্য সংরক্ষিত হয় ৭টি আসন। এছাড়া নারীদেরকেও সম্প্রদায়গত ভিত্তিতে আসন প্রদান করা হয়।
৮. নির্বাচনী এলাকার সীমানা নির্ধারনের সুবিধার্থে বিভিন্ন সম্প্রদায়কে দেয়া আসনের সামান্য রদবদল হতে পারে বলে রোয়েদাদে ঘোষণা করা হয়।
সাম্প্রদায়িক রোয়েদাদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন সম্প্রদায় ও রাজনৈতিক দল তীব্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে। হরিজন সম্প্রদায়কে স্বতন্ত্র নির্বাচনের সুবিধা দেয়ায় হিন্দুদের পক্ষ থেকে প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। শিখ সম্প্রদায়ও এর বিরোধিতা করে। কংগ্রেসের পক্ষ থেকে রোয়েদাদের বিরুদ্ধে তীব্র নিন্দা করা হয়। কংগ্রেস নেতৃবৃন্দ অভিযোগ করেন যে, মুসলমানরা অনেক প্রদেশে সংখ্যা লঘু হওয়া সত্ত্বেও জনসংখ্যার তুলনায় তাদেরকে বেশি আসন দেয়া হয়েছে। আবার পাঞ্জাব প্রদেশে শিখদের জনসংখ্যার তুলনায় অধিক প্রতিনিধিত্ব দেয়ায় সেখানে হিন্দুদের আসন কমে যায়।
হরিজনদের পৃথক নির্বাচন প্রদানের মাধ্যমে হিন্দু সম্প্রদায়কে বিভক্ত করার প্রতিবাদে গান্ধী পুনা কারাগারে আমরন অনশন শুরু করেন। তাঁর অনশন ধর্মঘট ভারতের সর্বত্র গভীর প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। শেষ পর্যন্ত গান্ধীর জীবন বাঁচাবার উদ্দেশ্যে হরিজন সম্প্রদায়ের নেতা ড: আম্বেদকারসহ অন্যারা তাদের জন্য পৃথক নির্বাচনের সুবিধা ত্যাগ করতে রাজী হন। তাঁরা পুনাতে গান্ধীর সঙ্গে এক চুক্তিতে আবদ্ধ হন। এটাই পুনা চুক্তি নামে পরিচিত। এ চুক্তির মাধ্যমে স্থির হয় যে, হরিজনদের জন্য কিছুসংখ্যক আসন নির্দিষ্ট থাকবে। তবে তারা সাধারণ হিন্দুদের ভোটে নির্বাচিত হবেন। কংগ্রেস ও অন্যান্য হিন্দু নেতৃবৃন্দ সাম্প্রদায়িক রোয়েদাদে হরিজনদের জন্য পৃথক নির্বাচন ব্যবস্থাকে ‘জাতির রাজনৈতিক সংহতি বিনাসের চক্রান্ত বলে আখ্যায়িত করেন।
এ দিকে মুসলিম লীগও সাম্প্রদায়িক রোয়েদাদে সম্পূর্ণ সন্তুষ্ট হতে পারে নি। কারণ তাতে মুসলমানদের আসন সংরক্ষণ সম্পর্কিত দাবি পরিপূর্ণভাবে মানা হয় নি। তাছাড়া কেন্দ্রীয় আইনসভার ব্যাপারেও বৃটিশ প্রধানমন্ত্রীর প্রস্তাবে কিছুই উল্লেখ ছিল না। পাঞ্জাব প্রদেশের ব্যাপারে মুসলমানদের আপত্তি ছিল সবচেয়ে বেশি। তবু তারা সাম্প্রদায়িক রোয়েদাদ মেনে নেয়। ১৯৩৩ খ্রিস্টাব্দে মুসলিম লীগের অধিবেশনে বলা হয় যে, যদিও এ সিদ্ধান্ত মুসলিম দাবির তুলনায় অপ্রতুল, তবুও দেশের বৃহত্তর স্বার্থে মুসলমানরা এটা মেনে নিচ্ছে।
শেষে বলা যায়, সাইমন কমিশনের রিপোর্ট কংগ্রেস ও মুসলিম লীগ প্রত্যাখ্যান করে। এরপর বৃটিশ সরকার ভারতীয় নেতৃবৃন্দকে লন্ডনে এক গোলটেবিল বৈঠকে আহবান করেন। দুটি গোল টেবিল বৈঠক শেষেও আইন সভায় বিভিন্ন সম্প্রদায়ের আসন সংরক্ষণের দাবির বিষয়ে কোন ঐক্যমত হয়নি। তখন বৃটিশ প্রধানমন্ত্রী রামজে ম্যাকডোনাল্ড এ বিষয়ে সমস্যার সমাধানকল্পে স্বীয় উদ্যেগে এক ‘সাম্প্রদায়িক রোয়েদাদ ঘোষণা করেন। সেখানে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের জন্য কিছু আসন সংরক্ষণের ব্যবস্থাসহ পৃথক নির্বাচনের সুযোগ দেয়া হয়। কিন্তু এর বিরুদ্ধে বিভিন্ন সম্প্রদায় ও দলের পক্ষ থেকে তীব্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করা হয়। মুসলমানরা অবশ্য প্রতিবাদ সত্ত্বেও সাম্প্রদায়িক রোয়েদাদ গ্রহণ করার সিদ্ধান্ত নেয়।
0 মন্তব্য(গুলি):
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
Comment below if you have any questions