Home » » আইয়ামে জাহেলিয়া

আইয়ামে জাহেলিয়া

আইয়ামে জাহেলিয়া

ইসলামের আবির্ভাব তথা মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর আগমন মানব সভ্যতার ইতিহাসে এক অবিস্মরণীয় ঘটনা। এ সময় আরবসহ সমগ্র বিশ্ব ছিল মূর্খতার ঘোর অন্ধকারে তমসাচ্ছন্ন। এ যুগে আইন-কানুন, নীতি নৈতিকতা, শিক্ষাসংস্কৃতি, জ্ঞানবুদ্ধিবৃত্তি, মানবতাবোধ, ধার্মিকতা, শুদ্ধতা এবং আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক ব্যবস্থায় কোনো সুষ্ঠুতা ছিল না; বরং সর্বক্ষেত্রেই সর্বগ্রাসী বিশৃঙ্খলা ও নৈরাজ্য বিরাজ করছিল। ইসলামের আবির্ভাবে এ অমানিশার অবসান ঘটে এবং সত্যিকার সুন্দর প্রভাতের আলোকচ্ছটায় আরবসহ সমগ্র বিশ্ব সমুদ্ভাসিত হয়ে ওঠে। 

আইয়ামে জাহিলিয়ার পরিচয়

আইয়ামে জাহিলিয়া দুটি আরবী শব্দের সমষ্টি হলো- ১. আইয়াম ও ২. জাহিলিয়া। আইয়াম শব্দটি আরবি ইয়াওমুন শব্দের বহুবন। অর্থ হলো- দিন, যা লাইলুন বা রাতের বিপরীত অর্থে ব্যবহার হয়। তবে ইয়াওমুন শব্দের ব্যবহার সময়, কাল, যুগ, time, period, age ইত্যাদি অর্থেও হয়ে থাকে। যেমন আল্লাহ তায়ালা কুরআন মাজীদে ঘোষণা করেন- আমি মানুষের পরস্পর উন্নতি ও অবনতির যুগ পরিবর্তন করে থাকি। এখানে আইয়াম দিয়ে যুগ বুঝানো হয়েছে। আর জাহিলিয়া শব্দটি আরবি জাহলুন শব্দ থেকে উৎলিত। অর্থ হলো- বর্বরতা, অজ্ঞতা, কুসংস্কার, তমসা বা অন্ধকার, Ignorace, darkness. তাই আইয়ামে জাহিলিয়া অর্থ তমসা বা অন্ধকার যুগ। ইংরেজিতে বলা হয় The age of Ignorance. ইসলামের ইতিহাসে এ শব্দটি নবী করীম (সা.)-এর আবির্ভাবের পূর্বেকার আরবদের অবস্থা সম্পর্কে ব্যবহার হয়। কেননা এ যুগে আরবরা সাধারণত স্বভাব-চরিত্রের দিক থেকে অজ্ঞতা ও মূর্খতার চরম অন্ধকারে নিমজ্জিত ছিল। যদিও কোনো ঐতিহাসিক আইয়ামে জাহিলিয়া’ বলতে হযরত ঈসা (আ.) এবং নবী করীম (সা.)-এর মধ্যকার ‘ফাতরাতে অহী' তথা অহী মুলতবির সময়কে উদ্দেশ্য করেছেন, কিন্তু ঐতিহাসিকদের অধিকাংশের মতে, হযরত ঈসা (আ.)-এর পরবর্তী কালের কোনো উল্লেখ নেই। কেননা হযরত ইবরাহীম ও হযরত ইসমাঈল (আ.)-এর পর থেকেই ক্রমান্বয়ে সমগ্র আরবে মূর্খতাজনিত অন্ধকার ও পথভ্রষ্টতার অজ্ঞতা বিস্তার লাভ করতে থাকে, যা পরবর্তীকালে শেষ নবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর আবির্ভাবকাল পর্যন্ত চূড়ান্ত পর্যায়ে উপনীত হয়।

আইয়ামে জাহিলিয়ার সময় ও ব্যাপ্তি 

আইয়ামে জাহিলিয়ার সময়সীমা নিয়ে ঐতিহাসিকদের মধ্যে নানাবিধ মতভেদ পরিলক্ষিত হয়। বহুলালোচিত সেসব মতভেদ হচ্ছে:

ক. অধিকাংশ মুসলিম ঐতিহাসিকের মতে, হযরত আদম (আ) থেকে শুরু করে হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর নবুয়তপ্রাপ্তির পূর্ব পর্যন্ত সময়কে আইয়ামে জাহিলিয়া বলা হয়, কিন্তু এ মতবাদ গ্রহণযোগ্য নয়। কেননা এর অন্তর্বর্তীকালে মানুষকে হেদায়াত করার জন্য পৃথিবীতে অসংখ্য নবী রাসূলের আগমন ঘটেছিল। তাছাড়া পবিত্র কুরআনুল কারীমে ২৫ জন নবীর নাম স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে।

খ. কোনো কোনো ঐতিহাসিকের মতে, “হযরত ঈসা (আ.) ও হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর মধ্যবর্তী সময়কালই আইয়ামে জাহিলিয়া।”

গ. ঐতিহাসিক ড. নিকোলসন ইসলামের আবির্ভাবের পূর্ববর্তী এক শতাব্দীকালকে আইয়ামে জাহিলিয়া বলে অভিহিত করেছেন। পি.কে.হিট্টি এ মত সমর্থন করেছেন। 

ঘ. প্রফেসর পি.কে.হিট্টি তাঁর প্রণীত ‘হিস্ট্রি অব দা আরবস' গ্রন্থে আইয়ামে জাহিলিয়ার পরিচয় দিতে গিয়ে বলেন- The term Jahiliyah, usually rendered time of ignorance or barbarism in reality means the period in which Arabia had no dispensation, no inspired prophet, no revealed book. 

ঙ. ঐতিহাসিক মুইর বলেন, “হযরত ঈসা (আ.) ও হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর মধ্যবর্তী সময়কেই আইয়ামে জাহিলিয়া বলে।” 

চ. ড. এস এম ইমামুদ্দিনের মতে, “হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর জন্মের পূর্বে ৬১০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত এক শতাব্দীকালকে আইয়ামে জাহিলিয়া বলে বোঝানো হয়েছে।” 

ছ. কুরআন মাজীদে ইসলামের আবির্ভাবের পূর্ববর্তী সময়কে জাহিলিয়া যুগ বলে অভিহিত করা হয়েছে। মহান আল্লাহর বাণী-হে নারী সম্প্রদায়! তোমরা জাহিলী যুগের ন্যায় ইসলামের আগমনের পরও বাইরে অবাধে বের হয়ো না। 

জ. পবিত্র হাদীসে নববীর ভাষ্যমতে, মহানবী (সা.)-এর অহীপ্রাপ্তির পূর্ববর্তী সময়কেই আইয়ামে জাহিলিয়া হিসেবে বোঝানো হয়েছে। নবী করীম (সা.) এক হাদীসে হযরত আবু যর (রা)-কে লক্ষ্য করে ইরশাদ করেন- হে আবু যর! তুমি এমন ব্যক্তি যার মধ্যে জাহিলিয়া রয়ে গেছে।

অতএব আইয়ামে জাহিলিয়া বলতে আরবের অন্ধকার যুগকে বোঝানো হয়েছে, যা ইসলাম আবির্ভাবের পূর্বে অতিবাহিত হয়ে গেছে। উপরিউক্ত আলোচনায় আইয়ামে জাহিলিয়ার যে চিত্রাঙ্কন করা হয়েছে, সে সম্পর্কে ইতিহাস বিশ্লেষকগণ ভিন্ন।  মত পােষণ করেন। তারা বলেন, যে সময়কে অন্ধকারাচ্ছন্ন বা অজ্ঞতার যুগ বলা হয়, সে সময় দক্ষিণ আরব জ্ঞানগরিমায় উন্নত এবং আরববাসী সাহিত্য সংস্কৃতি, ঐতিহ্য চেতনাসহ নানা সৎ গুণাবলিতে ভূষিত ছিল। তাই জাহিলী যুগের প্রকৃত  অর্থ হচ্ছে, যে যুগে কোনো নবী রাসূল, ঐশী কিতাব না থাকায় আরববাসী নানা প্রকার অন্যায়-অনাচার, সামাজিক বিশৃংখলা, কুসংস্কার, ব্যভিচার ও মানবতাবোধের অধঃপতন, সর্বোপরি ধর্মীয় অবক্ষয়ের চরম সীমায় উপনীত হয়। জাহিলিয়া যুগে সমগ্র পৃথিবীই অন্ধকারে নিমজ্জিত ছিল। পৃথিবীর সর্বত্র মানব সমাজ ছিল পথভ্রষ্ট। কোনো জাতিই আল্লাহর একত্ববাদে বিশ্বাসী ছিল না। তারা নবী-রাসূলদের প্রদর্শিত পথ ও শিক্ষা থেকে দূরে সরে গিয়েছিল। স্রষ্টার পরিবর্তে সৃষ্টিরই তারা উপাসনা করতো। 

প্রায় সকল সমাজেই দাসপ্রথা বিদ্যমান ছিল। দাস-দাসীকে পণ্য দ্রব্যের ন্যয় হাট বাজারে বেচা-কেনা করা হতো। তাদের রাজনৈতিক অবস্থাও ছিল শোচনীয়। শাসকরা প্রজাদের মৌলিক অধিকার হরণ করতো। শাসক কর্তৃক প্রজাদের ওপর নির্যাতন চালানো হতো। উত্তর-দিকে প্রশান্ত মহাসাগর থেকে মধ্য ইউরোপ পর্যন্ত তাতারীদের দাপট ছিল। তারা ভারত, ইরান ও ইউরোপে লুটতরাজ করতো। পারস্য ও রোম সাম্রাজ্যের মধ্যে যুদ্ধ-সংঘাত লেগে থাকত। কোনো দেশেই শান্তি শৃঙ্খলা বিরাজমান ছিল না।

আইয়ামে জাহিলিয়া ও বর্তমান সমাজ

এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, জাহিলী যুগের সমাজ দর্শন, রাজনৈতিক চিন্তন, ধর্মীয় বিশ্বাস ও সাংস্কৃতিক অবকাঠামো সর্বোতভাবেই মানব জাতির স্বাভাবিক চেতনা ও বুদ্ধিবৃত্তির বিপরীত পথে চলছিল। শুধু আরব নয়; সমগ্র বিশ্ব ব্যবস্থাই মানবাধিকারের ব্যাপক অবমূল্যায়ন পরিলক্ষিত হচ্ছিল। এমতবস্থায় শান্তির বার্তা নিয়ে ইসলামের আবির্ভাব ছিল অনিবার্য। কিন্তু দুখের বিষয় হচ্ছে, জাহিলী সমাজের বিচিত্র ঘৃণিত প্রথা ও কর্মসমূহ আধুনিক সমাজে আবারো দেখা দিচ্ছে। জীবিত কন্যা সন্তানের হত্যার ধরণ পাল্টেছে মাত্র। আল্টাসনোগ্রাফির মাধ্যমে কন্যা সন্তানের জ্বণ নিশ্চিত হয়ে প্রতিনিয়ত। কন্যা সন্তানকে হত্যা করা হচ্ছে। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে জাহিলী সমাজের চেয়েও ঘৃন্য কায়দায় প্রকাশ্যে দিবালোকে হত্যা করা হচ্ছে। খুন, জখম, গুম যেন নতুন বর্বর সংস্কৃতিতে পরিণত হতে যাচ্ছে। দারুন নদওয়া যেখানে আরব সমাজের সর্বদলীয় সংসদ ছিল, সেরকম কোন ধারণা এ সভ্য সমাজে খুজে পাওয়া যাবে কী? নারীকে পণ্যের মডেল বানিয়ে ভোগের  বস্তুতে পরিণত করার এক জাহিলী উম্মাদনায় বিশ্ব আজ সয়লাব।

পরিশেষে বলা যায়, এশিয়া, ইউরোপ ও আফ্রিকা মহাদেশের সংযোগস্থলে অবস্থিত আরব দেশ সেমেটিক সভ্যতার কেন্দ্রভূমি। আরবের মক্কা নগরীতে অবস্থিত কাবা ঘরের বদৌলতে আরব-বিশ্ব মানবতার মিলন কেন্দ্রে পরিণত হয়। জীবন্ত কন্যা সন্তানের হত্যা, খুন, যুদ্ধ-সংঘাত প্রভৃতি নিত্য-নৈমত্তিক ব্যাপার হয়ে দাড়িয়েছিল। সমকালীন রোমান-পারস্য সাম্রাজ্য শোষণের যন্ত্রে | পরিণত হয়। এ অঞ্চলে চরম অরাজকতা চলতে থাকে। ঐক্যবদ্ধ রাষ্ট্র ব্যবস্থাপনার পরিবর্তে ব্যক্তিতন্ত্র মানুষের টুটি চেপে ধরেছিল। মোট কথা মহানবী (সা:) এর জন্মের পূর্বে আরব তথা সমগ্র বিশ্বব্যবস্থায় এক অস্থিরতা বিরাজ করতে। থাকে।

0 মন্তব্য(গুলি):

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Comment below if you have any questions

Contact form

নাম

ইমেল *

বার্তা *