Home » » ফাতেমি খিলাফতের পতনের কারণ

ফাতেমি খিলাফতের পতনের কারণ

ফাতেমি খিলাফতের পতনের কারণ

৯০৯ সালে ফাতিমি বংশ প্রতিষ্ঠার পর পরবর্তী প্রায় এক শতাব্দী ধরে গৌরবের সাথে এর যাত্রা অব্যাহত থাকে। কিন্তু যে উৎসাহ, অনুপ্রেরণা ও উদ্দেশ্য নিয়ে ফাতিমি খিলাফত প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল তা শেষ পর্যন্ত বজায় থাকেনি। একটি শিয়া মতাবলম্বী খিলাফত হিসেবে প্রতিনিয়ত অভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক প্রতিকূলতার মোকাবিলা করে টিকে থাকার জন্য যে শক্তি ও সামর্থ্যের প্রয়োজন ছিল তা শেষ দিকের শাসকদের, বিশেষ করে আল-হাকিমের পরবর্তী দুর্বল খলিফাদের ছিলনা। ফলে ফাতিমি খিলাফতের পতন অবশ্যম্ভাবী হয়ে উঠেছিল। 

১১৭১ সালে সর্বশেষ খলিফা আল-আদিদের মৃত্যুর পর সালাহউদ্দিন আইয়ুবীর ক্ষমতা দখলের মধ্য দিয়ে ফাতিমি বংশের পতন হয়। কিন্তু তাদের পতনের প্রেক্ষাপট আগে থেকেই তৈরী হয়েছিল। 


ফাতিমিদের পতনের কারণগুলো নিম্নরূপ: 

খলিফাদের দুর্বলতা : 

ফাতিমিদের শেষদিকের খলিফাগণ বিশেষ করে আল-হাকিমের পরবর্তী খলিফাগণ ছিলেন অযোগ্য, অদক্ষ, অকর্মণ্য এবং তাদের অধিকাংশই ছিল নাবালক। আল-হাকিমের মৃত্যুর পর প্রকৃত ক্ষমতা উযিরদের হাতে চলে যায় এবং নাবালক উত্তরাধিকারীগণ তাদের হাতের পুতুলে পরিণত হন। এসব উযিরদের মধ্যে বদর আল-জামালী (১০৭৩-৯৪) , আল-আফজাল (১০৯৪-১১২১), আবু আলী আহমদ ছিলেন উল্লেখযোগ্য। তারা খলিফাদের উপর প্রাধান্য বিস্তার করে নিজেদের হাতে ক্ষমতা নিয়ে নেন। 


সুন্নীদের বিরোধিতা

ফাতিমি খিলাফতের চারদিকে সুন্নী খিলাফত প্রতিষ্ঠিত ছিল। এশিয়া ও আফ্রিকা জুড়ে সুন্নী আব্বাসীয়দের শাসন চলে। ইউরোপের স্পেনে সুন্নী উমাইয়ারা স্বাধীনভাবে শাসন করছিল। ফলে গোটা মুসলিম জাহানে সুন্নীদের প্রবল বিরোধিতার মোকাবিলা করেই শিয়া ফাতিমিদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে হয়। এ সময় শিয়া মতবাদপুষ্ট উগ্রপন্থী কারামাতিয় সম্প্রদায় কাবা আক্রমণ করে হজ্বরে আস্ওয়া লুণ্ঠন করায় সুন্নী ও মধ্যপন্থী শিয়ারা তাদের প্রতি ক্ষুব্ধ ছিল। এই ঘটনা বিশেষ করে সুন্নীদের জন্য মারাত্মক ক্ষতের সৃষ্টি করে এবং শিয়াদের প্রতি প্রতিশোধের বাসনা বংশ পরম্পরায় চলে আসতে থাকে।


শিয়া মতবাদ প্রচার বিঘ্নিত 

ফাতিমিদের প্রথমদিকের খলিফাগণ রাজ্য শাসনের সাথে সাথে শিয়া মতবাদ প্রচারে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। কিন্তু পরবর্তীকালে এই প্রচারে ভাটা পড়ে। ফলে জনগণের মন-মানসিকতা শিয়ামত থেকে অন্যদিকে ধাবিত হয় এবং এর বহুধা বিভক্তি ঘটে। ফাতিমি রাজ্যে ঈসমাইলীয়, নিজারীয়, তাইয়েবীয়, দারাজী, কারামাতিয় প্রভৃতি দল-উপদলগুলি মিসর, সিরিয়া, ইয়ামেন, উত্তর আফ্রিকা প্রভৃতি অঞ্চলে স্বতন্ত্র পরিচয়-পতাকা নিয়ে প্রচার-কার্যের ফলে শিয়া মতবাদের খুবই ক্ষতি হয়। 


খাদ্যাভাবের প্রভাব : 

বারংবার দুর্ভিক্ষ, খাদ্যাভাব ও রাজস্ব ঘাটতি মিসরকে দারুণভাবে দুর্বল করে দেয়। এছাড়া রাজকোষ অর্থশূণ্য হয়ে যাবার কারণে সময় সময় বাইরের শত্রু শক্তির কাছে নিতান্ত হীন স্বার্থে সাহায্য চাইতে হত। এর প্রভাবে অভ্যন্তরীণ ঐক্য ও রাষ্ট্রের সংহতি বিনষ্ট হত। রাজস্বের ঘাটতি মোকাবিলা করতে গিয়ে রাজদরবারের সঞ্চিত সম্পদ, রত্ন ও অলংকারেও টান পড়ে। 


সামরিক ক্ষমতা হ্রাস : 

মধ্যযুগে যে সময় শক্তির উৎস হিসেবে সামরিক বাহিনীর রণকুশলতা, দক্ষতা ও সাহসিকতা অপরিহার্য সে সময় অর্থাৎ ফাতিমি শাসনের শেষ দিকে সামরিক বাহিনী আত্মঘাতী গোষ্ঠীকলহে লিপ্ত হয়ে পড়ে। জনগণের নিরাপত্তার রক্ষাকর্তা হিসেবে সেনাবাহিনীর প্রতি জনগণের যখন শ্রদ্ধা ও ভক্তি থাকার কথা, তখন তারা জনগণের জানমাল ও ইজ্জতের হরণকারীরূপেই পরিচিত হয়ে ওঠে। সেনাবাহিনীর প্রতি অবহেলা এবং খলিফাদের পক্ষে বিশাল সেনাবাহিনীর ভরণপোষণের অক্ষমতা তাদের সামরিক শক্তিকে হ্রাস করে যা তাদের পতন ত্বরান্বিত করে। 


ক্রুসেডের প্রভাব : 

১০৯৭ সালে ক্রুসেডার বা খ্রিস্টান ধর্মযোদ্ধারা জেরুজালেম উদ্ধারের জন্য এশিয়াতে উপস্থিত হলে ফাতিমিরা তুর্কী শক্তিকে ধ্বংস করার জন্য ধর্মযোদ্ধাদের স্বাগত জানায়। ফল ক্রুসেডারদের পক্ষে প্রাচ্যে অনুপ্রবেশ আরও সহজতর হয়। তারা জেরুজালেম, এডেসা, এন্টিওক ও সিরিয়ার বেশ কিছু অংশ দখল করে নিজেদের শক্তভাবে প্রতিষ্ঠিত করে। এমনকি যখন সেলজুক তুর্কীরা মিসরের উপকণ্ঠে তখনও তারা তাদের প্রতিহত করার জন্য বিরাট অংকের ধনরত্ন। ক্রুসেডারদের প্রদানে সম্মত হয়। তাদের এই অদূরদর্শী ও আত্মবিনাশী ভাবনা তাদের পতনের কারণ হয়েছিল। 


সুন্নী নিপীড়ন : 

ফাতিমি খলিফাগণ বিশেষ করে খলিফা আল-হাকিম ছিলেন সুন্নী-বিদ্বেষী। আল-হাকিম সুন্নী সম্প্রদায়ের উপর নির্যাতন-নিপীড়ন চালাতে থাকেন। এছাড়া তিনি মসজিদের ইমাম-মুয়াজ্জিনদের উপহার প্রদান বন্ধ করে দেন। মালিকী মাদ্রাসাও বন্ধ করে দেন। ফলে সুন্নীগণ ফাতিমি খিলাফতের বিরুদ্ধে ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। 


অমুসলিম নির্যাতন : 

অমুসলিমদের উপর নির্যাতন ফাতিমি বংশের পতনের জন্য বিশেষভাবে দায়ী। ফাতিমি খলিফা আলহাকিম সম্পর্কে বলা হয় যে, তিনি অমুসলিমদের প্রতি নির্যাতনমূলক নীতি গ্রহণ করেছিলেন। তিনি অমুসলিমদেরকে তাঁর তৈরিকৃত বিভিন্ন আইন মেনে চলতে বাধ্য করেন। তাঁর রাজত্বে ইহুদি ও খ্রিস্টানদেরকে বিশেষ ধরনের পোশাক পরিধান এবং গলায় ক্রুশ ও ঘন্টা পরতে হত। ফলে ইহুদি ও খ্রিস্টানগণ ফাতিমি খিলাফতের প্রতি ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে।


অর্থনৈতিক অবক্ষয় : 

ফাতিমি খিলাফতের শেষ দিকে অযোগ্য খলিফারা উযিরদের হাতে রাজ্যের সকল ক্ষমতা ছেড়ে দিয়ে হারেমে বিলাসী জীবন-যাপন করে প্রচুর অর্থ অপচয় করতেন। অন্যদিকে উযিররাও শাসনকার্যে প্রভূত প্রভাব বিস্তার করে বিপুল অর্থের অপচয় করত। এছাড়া ভূমধ্যসাগর ও লোহিত সাগর হাতছাড়া হয়ে যাওয়া এবং জেরুজালেমে ক্রুসেডারদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হওয়ায় বহি:বাণিজ্যে প্রভূত ক্ষতি সাধিত হয়। ফলে রাজকোষ শূণ্য হয়ে পড়ে এবং অর্থের অভাবে ফাতিমি অবকাঠামোগুলো ভেঙ্গে পড়ে। অর্থনৈতিক অবক্ষয়ের ফলে তাদের পতন অবশ্যম্ভাবী হয়ে ওঠে। 


সালাহউদ্দিন আইয়ুবীর আগমন ও ফাতিমিদের পতন : 

ফাতিমি উঠির সাওয়ার তুর্কীদের সাহায্যে উযির পদ লাভ করলেও পরবর্তীতে ফ্রাঙ্কদের সাহায্যে তুর্কিদের সিরিয়ায় তাড়িয়ে দেন। তুর্কীরা যখন মিসরের উপকণ্ঠে তখন তাদের প্রতিহত করার জন্য বিরাট অংকের অর্থের বিনিময়ে তিনি ফ্রাঙ্কদের মিসরে আহ্বান জানান। কিন্তু শেষ রক্ষা হলনা। স্বয়ং খলিফা ও নগরের অভিজাত রমণীদের আমন্ত্রণে সিরিয়ার নুরুদ্দীন জঙ্গি তার সেনাপতি শিরকুহ এবং সালাহউদ্দিনকে ফ্রাঙ্কদের বিতাড়নের জন্য প্রেরণ করেন। মিসরে তুর্কী সেনারা বিজয়ীবেশে প্রবেশ করল। সালাহউদ্দীন এবং শির্কুহের। গতি রোধ করা তাদের পক্ষে সম্ভব হয়নি। শিরকুহকে উযিরের পদে নিয়োগ করা হয়। ২ মাস পরে শিকুহ মৃতমূখে পতিত হলে সালাহ্উদ্দিন উযির পদ গ্রহণ করেন। ১৯৭১ সালে সর্বশেষ খলিফা আল-আদিদের মৃত্যু হলে সালাহ্উদ্দিন আব্বাসীয়দের অনুকূলে আইয়ুবী বংশ প্রতিষ্ঠা করেন। খুব্বায় আব্বাসীয় খলিফার নাম পাঠ করা হয়। আর এভাবেই পরিসমাপ্তি ঘটে ২৬২ বছরের ফাতিমি শাসনের।

উর্পযুক্ত নানা কারণে ফাতিমিদের অধঃপতনের ধারা সূচিত হয় এবং এই বংশের শক্তি এতটাই কমে যায় যে তাদের কখনও সেলজুক তুর্কীদের, কখনও ফ্রাঙ্ক ক্রুসেডারদের আবার কখনওবা সিরিয়ার জঙ্গি তুর্কিদের সাহায্যের উপর নির্ভর করতে হয়। এমনকি সালাহ্উদ্দিন আইয়ূবীর আইয়ুবী বংশ প্রতিষ্ঠার পর ফাতিমি বংশের পক্ষে কেউ কোন দাবী উপস্থাপন করেনি বা করার সাহস দেখায়নি। ফলে ফাতিমিদের ধ্বংসস্তুপের উপর আইয়ুবী বংশ প্রতিষ্ঠিত হয় এবং ইসলামী বিশ্বের একমাত্র শিয়া তথা ফাতিমি খিলাফতের চির অবসান ঘটে।


পরিশেষে বলা যায়, ৯০৯ সালে প্রতিষ্ঠিত ফাতিমি বংশের ১১৭১ সালে পতন ঘটে। ফাতিমিদের শেষ দিকের খলিফাগণ বিশেষ করে আলহাকিমের পরবর্তী খলিফাগণ ছিলেন অযোগ্য, অদক্ষ, অকর্মণ্য এবং তাদের অধিকাংশই ছিলেন নাবালক। এ সময় প্রকৃত ক্ষমতা উরিদের হাতে চলে যায়। বিভিন্ন ধর্মীয় সম্প্রদায়ের উপর নির্যাতন, দুর্ভিক্ষ, খাদ্যাভাব, রাজস্ব ঘাটতি অর্থনৈতিক অবক্ষয় ইত্যাদি নানা কারণে তাদের পতন অবশ্যম্ভাবী হয়ে ওঠে। ১৯৭১ সালে সর্বশেষ খলিফা আলআদিদের মৃত্যু হলে সালাহ্উদ্দিন আইয়ুবী আব্বাসীয়দের অনুকূলে আইয়ূবী বংশ প্রতিষ্ঠা করেন। আর এভাবেই। পরিসমাপ্তি ঘটে ২৬২ বছরের ফাতিমি শাসনের।

0 মন্তব্য(গুলি):

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Comment below if you have any questions

অফিস/বেসিক কম্পিউটার কোর্স

এম.এস. ওয়ার্ড
এম.এস. এক্সেল
এম.এস. পাওয়ার পয়েন্ট
বাংলা টাইপিং, ইংরেজি টাইপিং
ই-মেইল ও ইন্টারনেট

মেয়াদ: ২ মাস (সপ্তাহে ৪দিন)
রবি+সোম+মঙ্গল+বুধবার

কোর্স ফি: ৪,০০০/-

গ্রাফিক ডিজাইন কোর্স

এডোব ফটোশপ
এডোব ইলাস্ট্রেটর

মেয়াদ: ৩ মাস (সপ্তাহে ২দিন)
শুক্র+শনিবার

কোর্স ফি: ৮,৫০০/-

ওয়েব ডিজাইন কোর্স

এইচটিএমএল ৫
সিএসএস ৩

মেয়াদ: ৩ মাস (সপ্তাহে ২দিন)
শুক্র+শনিবার

কোর্স ফি: ৮,৫০০/-

ভিডিও এডিটিং কোর্স

এডোব প্রিমিয়ার প্রো

মেয়াদ: ৩ মাস (সপ্তাহে ২দিন)
শুক্র+শনিবার

কোর্স ফি: ৯,৫০০/-

ডিজিটাল মার্কেটিং কোর্স

ফেসবুক, ইউটিউব, ইনস্টাগ্রাম, এসইও, গুগল এডস, ইমেইল মার্কেটিং

মেয়াদ: ৩ মাস (সপ্তাহে ২দিন)
শুক্র+শনিবার

কোর্স ফি: ১২,৫০০/-

অ্যাডভান্সড এক্সেল

ভি-লুকআপ, এইচ-লুকআপ, অ্যাডভান্সড ফাংশনসহ অনেক কিছু...

মেয়াদ: ২ মাস (সপ্তাহে ২দিন)
শুক্র+শনিবার

কোর্স ফি: ৬,৫০০/-

ক্লাস টাইম

সকাল থেকে দুপুর

১ম ব্যাচ: সকাল ০৮:০০-০৯:৩০

২য় ব্যাচ: সকাল ০৯:৩০-১১:০০

৩য় ব্যাচ: সকাল ১১:০০-১২:৩০

৪র্থ ব্যাচ: দুপুর ১২:৩০-০২:০০

বিকাল থেকে রাত

৫ম ব্যাচ: বিকাল ০৪:০০-০৫:৩০

৬ষ্ঠ ব্যাচ: বিকাল ০৫:৩০-০৭:০০

৭ম ব্যাচ: সন্ধ্যা ০৭:০০-০৮:৩০

৮ম ব্যাচ: রাত ০৮:৩০-১০:০০

যোগাযোগ:

আলআমিন কম্পিউটার প্রশিক্ষণ কেন্দ্র

৭৯৬, পশ্চিম কাজীপাড়া বাসস্ট্যান্ড,

[মেট্রোরেলের ২৮৮ নং পিলারের পশ্চিম পাশে]

কাজীপাড়া, মিরপুর, ঢাকা-১২১৬

মোবাইল: 01785 474 006

ইমেইল: alamincomputer1216@gmail.com

ফেসবুক: facebook.com/ac01785474006

ব্লগ: alamincomputertc.blogspot.com

Contact form

নাম

ইমেল *

বার্তা *