নেহেরু রিপোর্ট কি
উপমহাদেশের শাসনতান্ত্রিক বিকাশের ইতিহাসে নেহেরু রিপোর্ট এক মূল্যবান ও গুরুত্বপূর্ণ দলিল। ১৯২৮ খ্রিস্টাব্দে বেসরকারী উদ্যোগে ভারতের জন্য সংবিধানের খসড়া রচনার ভার পণ্ডিত মতিলাল নেহেরুর নেতৃত্বে একটি কমিটির উপর অর্পিত হয়। উক্ত কমিটির সুপারিশ ভিত্তিক দলিল নেহেরু রিপোর্ট' নামে ইতিহাসে প্রসিদ্ধ। ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দে মন্টেগু চেমসফোর্ড সংস্কার আইন ভারতের শাসনতান্ত্রিক সমস্যা সমাধানে ব্যর্থ হয়। এ বিষয়ে পুনরায় ব্যবস্থা গ্রহণের উদ্দেশ্যে ১৯২৭ খ্রিস্টাব্দে ভাইসরয় লর্ড আরউইন জন সাইমনের নেতৃত্বে একটি পার্লামেন্টারি কমিশন।
নিয়োগ করেন। কিন্তু সাইমন কমিশনে কোনো ভারতীয় প্রতিনিধিত্ব না থাকায় কংগ্রেস ও মুসলিম লীগ একে মেনে নিতে অস্বীকার করে। এ কমিশনকে বর্জন করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় এবং যেদিন উক্ত কমিশনের সদস্যরা ভারতে পদার্পণ করেন সেদিন হরতাল আহবান করা হয় এবং সাইমন ফিরে যাও’ ধ্বনি উত্থিত হয়। ইত্যবসরে খিলাফত ও অসহযোগ আন্দোলন-পরবর্তী সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার কারণে হিন্দু-মুসলিম সম্পর্কের উন্নতি বিধানে কংগ্রেস ও মুসলিম লীগ নেতৃবৃন্দ একের পর এক প্রয়াস চালিয়ে যান। ১৯২৭ খ্রিস্টাব্দে কংগ্রেসের বার্ষিক অধিবেশনে হিন্দু-মুসলিম সমস্যা সমাধানের জন্য অন্যান্য দলের সাথে মত বিনিময় করে একটি ‘স্বরাজ শাসনতন্ত্র’-এর খসড়া প্রণয়নের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। অন্যদিকে মুসলিম লীগও একটি সাব কমিটি গঠন করে প্রস্তাবিত শাসনতন্ত্রের খসড়ায় নিজেদের দাবি দাওয়া যাতে অন্তর্ভুক্ত করা যায় তার ব্যবস্থা করে। পরে সব দলের নিকট গ্রহণযোগ্য একটি শাসনতন্ত্র প্রণয়নের জন্য কংগ্রেস একটি সর্বদলীয় সভা ডাকে। ইতোমধ্যে ভারত সচিব লর্ড বার্কেহেড ভারতীয়দের সর্বসম্মত একটি শাসনতন্ত্র রচনার চ্যালেঞ্জ প্রদান করেন। এ লক্ষ্যে ১৯২৮ খ্রিস্টাব্দের ফেব্রুয়ারিতে এলাহাবাদে সর্বদলীয় কনফারেন্স অনুষ্ঠিত হয়। কিন্তু সাম্প্রদায়িক প্রতিনিধিত্বের প্রশ্নে বিরোধের কারণে কোন সর্বসম্মত সিদ্ধান্তে পৌঁছা সম্ভব হয় না। ১৯ মে তৃতীয় বারের মতো সর্বদলীয় সম্মেলন বসে বোম্বেতে। উক্ত সম্মেলনে সংবিধানের খসড়া প্রণয়নের জন্য একটি কমিটি গঠনের সিদ্ধান্ত হয়। এ কমিটিতে হিন্দু মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের নেতারা ছিলেন এবং কমিটির নেতৃত্ব দেন পণ্ডিত মতিলাল নেহেরু। কমিটির প্রস্তাবে ভারতীয়দের পক্ষ থেকে কতগুলো দাবি চূড়ান্ত করা হয়।
নেহেরু রিপোর্ট
১৯২৮ খ্রিস্টাব্দের নেহেরু রিপোর্টে ভারতের জন্য পূর্ণ ডোমিনিয়নের মর্যাদা দাবি করা হয়। দায়িত্বশীল সরকার গঠনের উদ্দেশ্যে জনগণের দ্বারা নির্বাচিত দ্বি-কক্ষ বিশিষ্ট একটি আইন সভা গঠনের প্রস্তাব করা হয়। প্রস্তাবিত আইন সভার ক্ষমতা হবে সর্বোচ্চ এবং শাসন বিভাগের উপর আইন সভার পূর্ণ ক্ষমতা প্রতিষ্ঠিত হবে। প্রদেশগুলোর ক্ষেত্রে ও দায়িত্বশীল সরকার প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব করা হয় এবং কেন্দ্র ও প্রাদেশিক সরকারের ক্ষমতা সুস্পষ্টভাবে পৃথক করে দেয়া হয়। প্রদেশগুলোতে এক কক্ষ বিশিষ্ট আইনসভা প্রতিষ্ঠিত হবে। কেন্দ্রীয় আইন পরিষদের নিম্নকক্ষ ও প্রাদেশিক আইন পরিষদগুলো জনগণের ভােটে সরাসরি নির্বাচিত হবে। আগেকার সমস্ত আইনে স্বতন্ত্র নির্বাচনের যে নীতি অনুসরণ করা হয়েছিল এ প্রস্তাবে তা প্রত্যাহার করে যৌথ নির্বাচন নীতি গ্রহণ করা হয়। মুসলমানদের জন্য স্বতন্ত্র নির্বাচনের কোন ব্যবস্থা রাখা হয় নি। তবে কেন্দ্র ও অমুসলমান প্রধান প্রদেশগুলোতে লোকসংখ্যার ভিত্তিতে মুসলমানদের জন্য আসন সংরক্ষণের নীতি গৃহীত হয়। কিন্তু পাঞ্জাব ও বাংলার ক্ষেত্রে মুসলমানদের জন্য কোনো আসন সংরক্ষিত রাখার ব্যবস্থা ছিল না। আপাতত দশ বছরের জন্য সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের স্বার্থে আসন সংরক্ষণ প্রথা চালু থাকবে। ডোমিনিয়ন মর্যাদা দানের পর সিন্ধু, বেলুচিস্তান ও উত্তর-পশ্চিম সীমান্তকে আলাদা প্রদেশরূপে স্বীকৃতি দিয়ে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রদেশের মর্যাদা প্রদান করা হবে। তবে সেখানে অমুসলিম সংখ্যালঘুদের জন্য আসন সংরক্ষণের ব্যবস্থা থাকবে। সংবিধানে জনগণের মৌলিক অধিকার স্বীকৃত থাকবে এবং সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ভাষা, ধর্ম ও সংস্কৃতির নিরাপত্তা বিধানের নিশ্চয়তার কথা বলা হয়।
নেহেরু রিপোর্ট প্রকাশিত হলে ভারতের রাজনৈতিক দলগুলো পৃথকভাবে এ রিপোর্টের বিচার বিবেচনা করে। ১৯২৮ খ্রিস্টাব্দের সেপ্টেম্বর মাসে কংগ্রেসের কার্য নির্বাহক সমিতি নেহেরু রিপোর্টের প্রস্তাবগুলোর প্রতি সমর্থন জ্ঞাপন করে। তবে জওহরলাল নেহেরু এ রিপোর্টে পূর্ণ স্বরাজের বদলে ডোমিনিয়ন মর্যাদা মেনে নেয়ার বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ জ্ঞাপন করেন | এবং কংগ্রেস সচিবের পদ থেকে ইস্তফা দেন।
কিছু শিখ নেতৃবৃন্দ রিপোর্টে প্রস্তাবিত সাম্প্রদায়িক ধারাগুলো গ্রহণে অসম্মত হন। সংখ্যালঘু হিসেবে তাদের বিশেষ অধিকারগুলো স্বীকৃত না হওয়ায় হরিজনেরা অসন্তুষ্ট হয়। নেহেরু রিপোর্ট সম্পর্কে আলোচনা এবং বিভিন্ন দলের মতামত গ্রহণের উদ্দেশ্যে ১৯২৮ খ্রিস্টাব্দের ডিসেম্বরে কলকাতায় যে সর্বদলীয় সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় সেখানে মুসলিম লীগের পক্ষে মােহাম্মদ আলী জিন্নাহ নেহেরু রিপোর্ট সংশোধনের জন্য কয়েকটি প্রস্তাব আনেন। এগুলো ছিল:
১. কেন্দ্রীয় আইনসভায় মুসলমানদের জন্য তিন ভাগের এক ভাগ আসন;
২. প্রাপ্ত বয়স্কদের ভােটাধিকার প্রবর্তন না হওয়া পর্যন্ত বাংলা ও পাঞ্জাবে মুসলমানদের জন্য আসন সংরক্ষণ;
৩. প্রদেশগুলোর জন্য রেসিচ্যুয়ারি ক্ষমতা;
৪. বোম্বে থেকে সিন্ধুর পৃথকীকরণ।
কিন্তু হিন্দু মহাসভা এসব দাবি মানতে কোনভাবেই রাজী ছিল না। কংগ্রেসও জিন্নাহর প্রস্তাবগুলোর বিরোধিতা করে। কোনো সমঝোতা না হওয়ায় মুসলিম লীগ নেহেরু রিপোর্ট গ্রহণ করতে অসম্মতি জ্ঞাপন করে। লীগ নেতৃবৃন্দ এ রিপোর্টকে তাদের স্বার্থের পরিপন্থী বিবেচনা করে একে প্রত্যাখ্যান করেন।
পরিশেষে বলা যায় যে, ভারতের শাসনতান্ত্রিক ইতিহাসে নেহেরু রিপোর্ট একটি গুরুত্বপূর্ণ দলিল। শাসনতান্ত্রিক বিষয়ে হিন্দু ও মুসলমানদের সমঝোতার লক্ষ্যে এবং ভারত সচিব বার্কেহেড-এর দেয়া চ্যালেঞ্জের প্রেক্ষিতে সংবিধানের খসড়া প্রণয়নের উদ্দেশ্যে গঠিত কমিটির দাবিনামা নেহেরু রিপোর্ট নামে পরিচিত। ভারতের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের জন্য পৃথক নির্বাচনের দাবি প্রত্যাখ্যাত হওয়ায় সম্মিলিত উদ্যোগ ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। ভারতের রাজনৈতিক ইতিহাসে এর প্রভাব হয়েছিল সুদূরপ্রসারী।
0 মন্তব্য(গুলি):
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
Comment below if you have any questions