সমাজবিজ্ঞান ও অর্থনীতির মধ্যে সম্পর্ক
সমাজস্থ মানুষের নানামুখী ক্রিয়ার মধ্যে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড অন্যতম। মানব জীবনের যেসব কার্যক্রম উৎপাদন, বন্টন ও ভোগের সঙ্গে জড়িত সেটিই তার অর্থনৈতিক দিক। অর্থনীতি মানুষের জীবনযাত্রার অর্থনৈতিক দিক নিয়েই আলোচনা করে। সমাজবিজ্ঞানীরা সমাজকে জানতে গিয়ে মানুষের অর্থনৈতিক কার্যকলাপকে বিশ্লেষণের উপর বিশেষ গুরুত্বারোপ করে থাকেন। মানুষের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড মূলত সমাজের পারিপার্শ্বিকতা, সামাজিক কাঠামো, মূল্যবোধ প্রভৃতির উপর বহুলাংশে নির্ভরশীল। তাই মানুষের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডকে সমাজ থেকে পৃথক করে বিশ্লেষণ করা সম্ভব নয়।
এখানে সমাজবিজ্ঞান ও অর্থনীতির মধ্যেকার সম্পর্ক আলোচনা করা হলো:
প্রথমত: অর্থনীতির আলোচ্য বিষয় হচ্ছে মানুষের অর্থনৈতিক আচরণ। আর সমাজবিজ্ঞান সমাজের সাথে সম্পর্কিত হবার ফলে অর্থনৈতিক ক্রিয়াকলাপের উপর প্রতিষ্ঠিত বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান, উৎপাদন প্রক্রিয়া, উৎপাদন সম্পর্ক ইত্যাদি বিষয়ে আলোচনা করে। এদিক থেকে অর্থনীতি ও সমাজবিজ্ঞান খুবই ঘনিষ্ঠ সম্পর্কে আবদ্ধ।
দ্বিতীয়ত: অধিকাংশ অর্থনীতিবিদ মনে করেন যে, অন্যান্য আচরণমূলক বিজ্ঞান (behavioural science) এর ভিত্তি হচ্ছে। মানুষের বিভিন্ন আচরণমূলক কর্মকাণ্ড। মানুষের অর্থনৈতিক চিন্তা-ভাবনা ও কর্মকাণ্ড সবকিছুই মূলত সামাজিক কাঠামো, সামাজিক পরিবেশ ও মূল্যবোধের উপর নির্ভর করে। ফলে অর্থনীতি ও সমাজ পরস্পর বিচ্ছিন্ন কোনো বিষয় নয়।
তৃতীয়ত: সমাজজীবন দ্বারা অর্থনৈতিক প্রক্রিয়া যেমন প্রভাবিত তেমনি অর্থনৈতিক প্রক্রিয়া দ্বারা সমাজজীবন প্রভাবিত। দারিদ্র কিংবা অর্থনৈতিক উন্নতি মানুষের সামাজিক জীবন, সম্পর্ক, ক্ষমতা ও শ্রেণি কাঠামো ইত্যাদিকে প্রভাবিত করে। ফলে কার্যকর সমাজতাত্ত্বিক অধ্যয়নে মানুষের উৎপাদন ব্যবস্থা, পেশা, জীবিকা, খাদ্যাভ্যাস ইত্যাদি বিশেষভাবে গুরুত্ব পায়। অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি সামাজিক ও মানবিক উন্নয়ন সূচককে ত্বরান্বিত করে।
চতুর্থত: কোনো দেশের অর্থনৈতিক অবস্থাকে জানতে হলে সবার আগে সেদেশের সামাজিক অবস্থাকে পরিপূর্ণভাবে বোঝা প্রয়োজন। মানুষের সংস্কৃতি, মূল্যবোধ, রীতিনীতি ইত্যাদি অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে প্রভাবিত করে।
পঞ্চমত: মানুষের সামাজিক পারিপার্শ্বিকতাকে অবহেলা করে অর্থনৈতিক আলোচনা এবং পরিকল্পনা গ্রহণ করা অর্থহীন ও অবাস্তব হতে বাধ্য। যেহেতু সমাজের অর্থনৈতিক কর্মকান্ড সমাজস্থ মানুষকে ঘিরেই আবর্তিত হয় সেহেতু সমাজ ও এর কাঠামো সুষ্ঠুভাবে অনুধাবন করা ছাড়া অর্থনেতিক আলোচনা বাস্তবতা বিবর্জিত।
ষষ্ঠত: বহু অর্থনৈতিক প্রশ্নের সামাজিক দিক আছে। যেমন: কর-নীতি, জাতীয় বাজেট, ভূমিব্যবস্থা, ভূমিবন্টন, মূল্যহাস, মুদ্রাস্ফীতি ইত্যাদির যে সামাজিক তাৎপর্য রয়েছে কোনো অর্থনীতিবিদের পক্ষে তা উপেক্ষা করা কঠিন।
সপ্তমত: সমাজবিজ্ঞানের বিজ্ঞানভিত্তিক গবেষণা ও বিশ্লেষণ অর্থনৈতিক আচরণকে বুঝতে বিশেষভাবে সাহায্য করে।
অষ্টমত: সমাজের মানুষের জীবনযাত্রার মান সংশ্লিষ্ট সমাজের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির উপর বিশেষভাবে নির্ভর করে। কারণ মানুষের জীবনধারা অর্থনৈতিক গতি দ্বারা নানাভাবে প্রভাবিত।
উপরের আলোচনা থেকে আমরা বলতে পারি যে, সমাজবিজ্ঞানের জ্ঞান ছাড়া অর্থনীতির আলোচনা যেমন অসম্পূর্ণ, তেমনি অর্থনৈতিক ধারণা ব্যতীত সমাজবিজ্ঞানের আলোচনাও পরিপূর্ণ হয় না। তাই বলা যায় যে, সমাজবিজ্ঞান ও অর্থনীতি সামাজিক বিজ্ঞানের দু'টি পৃথক শাখা হওয়া সত্বেও উভয়ের মধ্যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বিদ্যমান। অর্থনীতি ও সমাজবিজ্ঞান মূলত একে অপরের পরিপূরক। কারণ সমাজবিজ্ঞানের জ্ঞান ছাড়া যেমন অর্থনীতিকে জানা যায় না, তেমনি অর্থনৈতিক জ্ঞান ছাড়া সমাজবিজ্ঞানকেও পরিপূর্ণরূপে উপলব্ধি করা সম্ভব না।
0 মন্তব্য(গুলি):
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
Comment below if you have any questions