বিজ্ঞানে মুসলিম মনীষীদের অবদান
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি এক নয়। উভয়ের মাঝে পার্থক্য রয়েছে। আমাদের চার পাশে যা কিছু ঘটছে তা কেন, কীভাবে ঘটছে তার জবাব অনুসন্ধানই হল বিজ্ঞান। এজন্যই বিজ্ঞানীরা নানা পরীক্ষা, নিরীক্ষা, গবেষণা, গণনা, পর্যবেক্ষণ করে থাকেন। অন্যদিকে প্রযুক্তি হচ্ছে “বিজ্ঞানের উপাদেয় আবিষ্কার গুলোকে মানুষের প্রয়োজনে ব্যবহার করা। বিজ্ঞান দেয় জ্ঞান আর প্রযুক্তি দেয় এর প্রয়োগের কলা কৌশল ।”
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উন্নয়নে মুসলিম জাতির অবদান অসামান্য। মুসলিম বিজ্ঞানীগণের বিভিন্ন যন্ত্রপাতি আবিস্কার ও তার প্রয়োগ বিশ্ব সভ্যতাকে এগিয়ে নিয়ে যায়। মুসলমানদের ইবাদত চন্দ্র-সূর্য পরিক্রমণ হওয়ার কারণে জ্যোতির্বিজ্ঞানের দিকে দৃষ্টি দিতে হয় । বিজ্ঞানী আল ফাজারী প্রথম সমুদ্রে সূর্য ও নক্ষত্রসমূহের উচ্চতা নির্ণয়ের জন্য Astrolabe আস্তারলব নির্মাণ করেন। এই যন্ত্র তৈরি ছাড়া ও তিনি অঙ্কশাস্ত্রের অন্যান্য প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি নির্মাণ করেন। কর্ডোভার বিজ্ঞানী আল জারকালী (১০২৯-১০৮৭) টলেডোর রাজপ্রাসাদের বাগানে দুই চৌবাচ্চা নিয়ে একটি জলঘড়ি নির্মাণ করেন। চন্দ্রকলার হ্রাস বৃদ্ধি অনুযায়ী এই দুইটি চৌবাচ্চার পানি নিয়ন্ত্রিত হতো ।
বিখ্যাত জ্যোতির্বিজ্ঞানী নাসির উদ্দিন আল তূসী (১২০১-১২৭৪) মান মন্দিরে নিরন্তর গবেষণা চালিয়ে প্রয়োজনীয় সূক্ষ্ম যন্ত্রপাতি তৈরির ব্যবস্থা করেন। এতে উদ্ভাবিত যন্ত্রগুলো যে শুধু বৈজ্ঞানিক মানসম্মত তা নয়, এর সূক্ষ্ম কারুকাজ অতীব বিস্ময়কর। যন্ত্রপাতির নির্মাণ এবং প্রয়োগ বিধি বর্ণনা করে একটি গ্রন্থ রচনা করেন। এতে এগারটি যন্ত্রের বিবরণ পাওয়া যায়।
গ্রহ, নক্ষত্র, চন্দ্র ও পৃথিবীর বিভিন্ন পরিমাপের জন্য মুসলিম প্রযুক্তিবিদগণ নানা ধরনের স্কেল উদ্ভাবন করেন। তার মধ্যে ডায়াগোনাল স্কেল, আকাশ ফলক, বলয় ও ফলক আলিদাদ ও রুলার ও সংযোগ ফলক ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।
মুসলমানরা যে রাসায়নিক জ্ঞান অর্জন করেন তার ভিত্তিতে তারা নিম্নোক্ত বেশ কয়েকটি ক্ষেত্রে বিশাল উন্নয়ন ও প্রযুক্তি জ্ঞান কাজে লাগায়। মধ্যে :
1. Pharmaceutical or Medicinal Preparation.
2. Paper Making.
3. Glass Enamel and pottery Glassing.
4. Chemicals Prepared on the basis of acquired Knowledge for Various applications- অন্যতম।
পানি ঠান্ডা করার প্রযুক্তি প্রথমে মুসলমানরা আবিষ্কার করেন। গ্যাস ঘনীভূতকরণ, ঠান্ডা পানি দিয়ে স্পঞ্জ কাপড় ইত্যাদি আর্দ্র করতে এ যন্ত্র ব্যবহৃত হত। খনিজ তেল উত্তোলন ও পরিশোধন প্রক্রিয়ায় মুসলমানরা সাফল্য লাভ করে। কীভাবে অপরিশোধিত তেলকে শোধন করা হতো তার প্রক্রিয়া বর্ণনা করেছেন আল রাজী তাঁর গ্রন্থ Book of the secret of secret.
সুগন্ধি ও তৈল উৎপাদন প্রক্রিয়ার প্রযুক্তিও মুসলিম বিজ্ঞানীরাই তৈরি করেন। এ শিল্পের গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র ছিল দামেশক । এখান থেকে উৎপাদিত পণ্য সুদূর ভারত বর্ষ ও চীনে রপ্তানি হতো।
৭১২ খ্রিস্টাব্দে মুসলমান কর্তৃক সমরকন্দ বিজয় করার পর চীনাদের কাছ থেকে কাগজ তৈরির পদ্ধতি আয়ত্ত্বে আনে। মুসলমানদের প্রথম কাগজ তৈরির কারখানা স্থাপিত হয় বাগদাদে ৭৯৪ খ্রিস্টাব্দে। কাগজ শিল্পে মুসলমানদের অবদানের মধ্যে বাঁশের ছাঁচ আবিষ্কর, কাগজ উৎপাদনে তিসি, লিনেন এবং সূতি কাগজের খন্ডাংশের ব্যবহার, প্রক্রিয়াজাতকরণ, কাগজকলে পানিবাহিত চাকার সাহায্যে হাতুড়ি চালানো ইত্যাদি অন্যতম ।
বাঁশের ছাঁচ আবিষ্কারের ফলে মুসলমান বিজ্ঞানীগণ কাগজ তৈরির প্রযুক্তিকে বহুদূর এগিয়ে নিয়েছিলেন। কাগজ তৈরির জন্য নেয়া এটিই সত্যিকার প্রথম পদক্ষেপ, কারণ কারিগররা একই ছাঁচ থেকে একহারা লম্বা সীট তৈরি করতে পারতেন। পশম, লিনেন, তুলা, রেশম প্রভৃতি ছিল মুসলিম বস্ত্রশিল্পের প্রধান কাঁচামাল। ভেড়ার লোম, মোহাইর নামক এঙ্গোরা ছাগলের পশম দিয়ে তৈরি হতো সুন্দর সুন্দর পশমী কাপড়, শাল ও কোট। স্পেনের আসবেলিয়া শহরে ১৫১ হিজরিতে ১৬ হাজার কারখানায় বস্ত্র উৎপাদিত হতো। মারিরা ও খিরা শহরে ৬ হাজার কারখানা শুধু রেশমী, সার্টিং ও পশমী কাপড় তৈরি হতো। তাছাড়া কার্পেট শিল্পে ও মুসলমান বিজ্ঞানীরা অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। একাদশ শতাব্দীর মুসলিম কারিগরদের হাতে চামড়া তৈরির প্রযুক্তির উন্নতি সাধিত হয়। এ শিল্পটি প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যে বিপুল প্রভাব বিস্তার করে। লেদার প্রযুক্তিতে মুসলিম প্রবর্তিত রীতিই বিশ্বে উনিশ শতক পর্যন্ত চালু ছিল।
যন্ত্রকৌশল, বই বাঁধাই ও সিরামিক শিল্প, কাঁচ শিল্প, সাবান শিল্প, ধাতব শিল্প, কালি ও রঞ্জক পদার্থ তৈরী প্রভৃতি শিল্পে প্রযুক্তিগত দিক থেকে মুসলমানগণ অগ্রগামী ছিলেন।
0 মন্তব্য(গুলি):
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
Comment below if you have any questions