প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ফলাফল
আটলান্টিক ও প্রশান্ত মহাসাগরের সীমানা ছাড়িয়ে ভারত মহাসাগর পর্যন্ত এসে আছড়ে পড়েছিল উত্তাল প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ধ্বংসলীলা ও হত্যাযজ্ঞের ঢেউ। ১৯১৪-১৯১৮ মাত্র চারটি বছরের যুদ্ধ, কেড়ে নেয় প্রায় ১ কোটি ৬০ লাখ মানুষের প্রাণ । নেভাল অপারেশন ইন দার্দানেলিস, ব্যাটেল অব ভার্দুন, নিভেলি অফেন্সিব, ব্যাটল অব সোমে, ব্যাটল অব ভিমি রিজ, ব্যাটল অব জুটল্যান্ড, ব্যাটল অব ককেশাস, আর্মেনিয়ার হত্যাকাণ্ড, ফিলিস্তিন ও সিনাই উপত্যকা অভিযান, কুত অবরোধ, জেরুজালেম ও ম্যাগিদোর যুদ্ধ শেষে মিত্রবাহিনীর বিজয় সম্ভব হয়। জার্মানিকে বাধ্যতামূলক অস্ত্রবিরতিতে পাঠানোর পর বসে প্যারিস শান্তি সম্মেলন। এরপর ট্রায়ানন, সেভার্স, লাউসেন, কিংবা অপমানজনক ভার্সাই চুক্তির মধ্য দিয়ে অনেক পেছন থেকে ‘ছুরিকাঘাত' করা হয় জার্মানিকে।
যুদ্ধের প্রধান কিছু ফলাফল হিসেবে বলা যেতে পারে-
১. সীমাহীন প্রাণহানি : বিস্তৃত অঞ্চলজুড়ে হওয়া যুদ্ধে নিহত সৈন্যসংখ্যা ছিল ৯০ লাখের কাছাকাছি। তেমনি একে বেসামরিক মানুষ নিহত হয়েছিল ৭০ লাখের উপর। তবে এখানে সামরিক বলতে যেসব মানুষের হিসেব দেয়া হয়েছে তাদের অনেকেই ছিল বেসামরিক মানুষ। যুদ্ধ শুরু হলে বাধ্যতামূলক সামরিক প্রশিক্ষণ দিয়ে তাদের ঠেলে দেয়া হয়েছে নিশ্চিত মৃত্যুর মুখে। বিশেষ করে পশ্চিম রণাঙ্গনে লড়তে গিয়ে এমনিভাবে জীবন দিয়েছে লক্ষ লক্ষ মানুষ। এ যুদ্ধে রাশিয়ার ৩৭,০০,০০০; জার্মানি ২৫,৩৩,৭০০; অটোমান সাম্রাজ্য ২৪,৭৫,০০০; অস্ট্রো-হাঙ্গেরি ১৫,০০,০০০; ফ্রান্স ১৪,১৫,৮০০; ব্রিটেন ৭,৩৩,৬৩৩; রুমানিয়া ৬,১০,৭০৬; ইতালি ৬,৫০,০০০; এবং যুক্তরাষ্ট্রের ১,২৬,০০০ সৈন্য হতাহত হয় বলে অনুমান করা যায় ।
২. মনোদৈহিক প্রতিবন্ধকতা : বিশ্বযুদ্ধের ফলে লক্ষ লক্ষ যুবকের প্রাণহানির পাশাপাশি আহত হয়েছিল উল্লেখযোগ্য সংখ্যক। এ আহত জনগোষ্ঠী তাদের উন্নয়নের পথে অন্তরায় হয়ে দেখা দেয়। বিশেষ করে একটি যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশকে ঘুরে দাঁড়াতে গেলে যতটা সুস্থ জনগোষ্ঠী থাকা প্রয়োজন ইউরোপের বেশিরভাগ দেশের সে সক্ষমতা ছিল না। কারণ বাধ্যতামূলক সামরিক বাহিনীতে যোগদান ও যুদ্ধে অংশগ্রহণ তাদের হয়ত নিহত নয়ত আহত করেছিল। শেষ পর্যন্ত এ অবস্থান রাষ্ট্রগুলোর জন্য মহাবিপর্যয় ডেকে আনে ।
৩. রাজতন্ত্রের পতন : প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষ হলে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে বিদ্যমান রাজতন্ত্রের পতন ঘটে। উদাহরণ হিসেবে রাশিয়ার রোমানভ বংশীয় জার, জার্মানির হোহেনজোলার্ন বংশীয় কাইজার, তুরস্কের উসমানীয় খিলাফত এবং অস্ট্রিয়ার হ্যাপসবুর্গ রাজবংশের পতন ঘটে। রাশিয়ার শেষ জার দ্বিতীয় নিকোলাস পদত্যাগ করেন। জার্মানির কাইজার দ্বিতীয় উইলহেম দেশ থেকে পালিয়ে গিয়ে প্রাণরক্ষা করতে চেষ্টা করেন। এক্ষেত্রে নতুন করে গড়ে উঠতে দেখা যায় প্রজাতান্ত্রিক রাষ্ট্রকাঠামো।
৪. উপনিবেশবিরোধী আন্দোলন : প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষ হতে না হতেই বিশ্বের নানা দেশে উপনিবেশবিরোধী আন্দোলন শুরু করে। বিশ্বের বিভিন্ন স্থানের মানুষকে এতোদিন বিশ্বযুদ্ধের ভয় দেখিয়ে চুপ রাখা গিয়েছিল। এবার বিশ্বযুদ্ধ শেষ হতেই তারা ইউরোপের নানা দেশের ঔপনিবেশিক অঞ্চলগুলোয় আন্দোলন শুরু করে। এভাবে অনেকগুলো উপনিবেশ স্বাধীনও হয়ে গেছে।
৫. জাতীয় রাষ্ট্র গঠন : পবিত্র রোমান সাম্রাজ্যের অধীনে রাষ্ট্রচিন্তার যে বিকাশ ঘটেছিল এটা তার বিস্তৃত রূপ। প্রথম দিকের রাষ্ট্র ছিল ধারনাগত, আর এবারের রাষ্ট্র একটি বাহ্যিক কাঠামো লাভ করে। তবে জাতীয় রাষ্ট্র গঠনের প্রাথমিক পর্ব হিসেবে পিছিয়ে যেতে হয় আরো কয়েকশ বছর। এক্ষেত্রে জাতীয় রাষ্ট্র বিকাশের চূড়ান্ত স্তর হিসেব গণ্য করা যেতে পারে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী সময়কালকে ।
৬. ব্রিটিশ-ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলন : প্রথম বিশ্বযুদ্ধ এশিয়া ও আফ্রিকার মানুষের মধ্যে যে জাতীয়তাবাদী চেতনার জাগরণ ঘটাতে সক্ষম হয়েছিল তারই ফলাফল হিসেবে শুরু হয় ভারতের ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে স্বাধীনতা সংগ্রাম । কংগ্রেস ও মুসলিম লীগ এরপর থেকে দীর্ঘ আন্দোলন চালিয়ে স্বাধীন করে উপমহাদেশকে ।
৭. সামাজিক পরিবর্তন : প্রথম বিশ্বযুদ্ধ রাজনৈতিক কাঠামোর পাশাপাশি অর্থনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রেও বিস্তৃত পরিবর্তন ঘটাতে সক্ষম হয়েছিল। এসময় রাশিয়ায় শ্রমিক শ্রেণির নেতৃত্বে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা এর উল্লেখযোগ্য উদাহরণ ।
৮. জাতিপুঞ্জের উদ্ভব : প্রথম বিশ্বযুদ্ধে অগণিত মানুষের প্রাণহানি অনেককে বিচলিত করে। এসময় যুদ্ধের ভয়াবহতা এড়াতে প্রেসিডেন্ট উড্রো উইলসন পেশ করেছিলেন ১৪ দফা ঘোষণা। এর ওপর ভিত্তি করে পরে গড়ে ওঠে লীগ অব নেশন তথা জাতিপুঞ্জ ।
৯. একনায়কতন্ত্রের উত্থান : অপমানজনক ভার্সাই চুক্তি মেনে নেয়া কোনো বোধশক্তিসম্পন্ন জার্মান নাগরিকের পক্ষে সম্ভব ছিল না। বলতে গেলে এ চুক্তিই পরবর্তীকালে একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি বিশ্বকে আরেকটি মহাযুদ্ধের দিকে ঠেলে দেয়।
১০. জার্মানির অবরোধ : যুদ্ধে বিজয়ী শক্তিগুলো নানাদিক থেকে জার্মানির ওপর অবরোধ আরোপ করে তাকে কোণঠাসা করে রাখতে চাইছিল। ১৯১৮ সালের ১১ নভেম্বর যুদ্ধবিরতি কার্যকর হওয়ার পর থেকেই মিত্রবাহিনীর দেশগুলো এ চেষ্টায় লিপ্ত হয়।
১১. প্রতিশোধ গ্রহণ : ভার্সাই চুক্তির মাধ্যমে ফ্রান্স জার্মানির সাথে বহু বছর পূর্বে ঘটে যাওয়া ঐতিহাসিক অপমানের প্রতিশোধ গ্রহণ করে। পাশাপাশি এর মাধ্যমে এমন অনেকগুলো চুক্তি জার্মানির ওপর চাপিয়ে দেয়া হয় যা অনেকটাই বিদ্বেষমূলক ও অনৈতিক।
১২. মহামারী : প্রথম বিশ্বযুদ্ধে জয়লাভ করার জন্য বিভিন্ন স্থানে গ্যাসবোমা হামলা করে মিত্রবাহিনীর পাশাপাশি জার্মানরাও। বিষাক্ত গ্যাস নানা স্থানে ছড়িয়ে পরে সৃষ্টি করে নানা রোগের উপসর্গ। অনেক এলাকায় এসময় ক্লোরিনের বিষক্রিয়া নানা রোগের পাশাপাশি মহামারী আকারে ইনফ্লুয়েঞ্জা ছড়িয়ে পড়তে দেখা যায়।
১৩. খাদ্যসংকট : যুদ্ধ চলাকালীন বিভিন্ন স্থানে পরিখা খনন থেকে শুরু করে সৈন্য বাহিনী এগিয়ে নিতে গিয়ে বিনষ্ট করা হয় মাইলের পর মাইল শস্যক্ষেত। অন্যদিকে নানা স্থানের কৃষক কৃষিকাজ বাদ দিয়ে বাধ্যতামূলক যুদ্ধে যোগদান করে। তাদের বাদ পড়ায় কৃষি উৎপাদন অনেকাংশে কমে যায়। এর প্রভাবে যুদ্ধশেষে চরম খাদ্য সংকট দেখা দেয় বিশ্বের নানা দেশে।
0 মন্তব্য(গুলি):
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
Comment below if you have any questions