উন্নয়ন পরিকল্পনার গুরুত্ব
অর্থনৈতিক উন্নয়নে পরিকল্পনার গুরুত্ব
আধুনিককালে বিশ্বের সর্বত্র অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য পরিকল্পিত উন্নয়ন কর্মসূচির সার্বজনীন স্বীকৃতি রয়েছে। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনের পথে যেসব সমস্যা থাকে সেগুলোর সমাধানের জন্য যে প্রাতিষ্ঠানিক ও সাংগঠনিক প্রক্রিয়া দরকার তা কেবল পরিকল্পনার মাধ্যমেই লাভ করা যায়। বাংলাদেশের মত উন্নয়নশীল দেশে অর্থনৈতিক সমস্যাবলির সমাধান এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে পরিকল্পনার গুরুত্ব অপরিসীম।
নিচে বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে পরিকল্পনার গুরুত্ব আলোচনা করা হল:
১। প্রাকৃতিক ও মানব সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহার: দেশের উৎপাদন ও আয় বাড়ানোর জন্য প্রাকৃতিক ও মানব সম্পদের দক্ষ ব্যবহার অপরিহার্য। এ সম্পদের একদিকে অবচয় রোধ এবং অন্যদিক সুষ্ঠু ও সর্বাধিক ব্যবহারের জন্য অর্থনৈতিক পরিকল্পনা আবশ্যক পড়ে ।
২। কৃষি ও শিল্পের উন্নয়ন: সীমাবদ্ধ সম্পদের সাহায্যে স্বল্প সময়ে দেশের কৃষি ও শিল্প খাতের উন্নয়নের জন্য পরিকল্পিত উন্নয়ন প্রক্রিয়া প্রয়োজন। বাংলাদেশে পরিকল্পনার মাধ্যমে এ দুটি গুরুত্বপূর্ণ খাতের উন্নতি ঘটলে জাতীয় উৎপাদন বাড়বে এবং অর্থনৈতিক উন্নয়ন ত্বরান্বিত হবে।
৩। জনসংখ্যা সমস্যার সমাধান: জনসংখ্যা বিস্ফোরণের দরুন যে বিভিন্ন আর্থ-সামাজিক সমস্যা সৃষ্টি হয় সেগুলো উন্নয়নের পথে বাধা সৃষ্টি করে। এজন্য জনসংখ্যাজনিত উদ্ভুত সমস্যাগুলো সমাধানে পরিকল্পিত প্রচেষ্টা প্রয়োজন। একমাত্র সুষ্ঠু ও দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা গ্রহণ ছাড়া জনসংখ্যাজনিত সমস্যাগুলো সমাধান সম্ভব নয়। বাংলাদেশে উন্নয়ন পরিকল্পনার মাধ্যমে অর্থনৈতিক উন্নয়ন ঘটলে অতিরিক্ত জনসংখ্যার কারণে বিভিন্ন ধরনের সমস্যার সমাধান সম্ভব হবে।
৪। বেকার সমস্যার সমাধান: বাংলাদেশসহ অন্যান্য কয়েকটি উন্নয়নশীল দেশে প্রকট বেকার সমস্যা বিদ্যমান। বেকারত্ব উন্নয়নের পথে একটি বিরাট অন্তরায়। বিনিয়োগের স্বল্পতাই বেকারত্বের মূল কারণ। এ অবস্থায় দেশে পরিকল্পিতভাবে বিনিয়োগ বাড়ালে বেকার সমস্যার সমাধান পাওয়া সম্ভব হবে।
৫। মূলধন গঠন ও বিনিয়োগ বৃদ্ধি: উন্নয়নশীল দেশগুলোতে উন্নয়নের জন্য প্রয়োজনীয় মূলধনের স্বল্পতা বিদ্যমান। অর্থনৈতিক পরিকল্পনার মাধ্যমে ভোগ কমিয়ে ও সঞ্চয় বাড়িয়ে মূলধন গঠন ত্বরান্বিত করা যায়। তাছাড়া দেশের সীমিত মূলধন যথাযোগ্যভাবে বিনিয়োগ করতে হলেও পরিকল্পনার প্রয়োজন।
৬। আর্থ-সামাজিক অবকাঠামো নির্মাণ: রাস্তাঘাট, সেতু, টেলিফোন, বিদ্যুতায়ন, পানি সরবরাহ, স্কুল কলেজ, হাসপাতাল, পার্ক ইত্যাদি অবকাঠামো ব্যক্তিগত উদ্যোগে গড়ে ওঠে না। কারণ এগুলোর নির্মাণ ব্যয়বহুল, সময়সাপেক্ষে ও এগুলো থেকে মুনাফা তেমন আসে না। অথচ এগুলোর অস্তিত্ব অর্থনৈতিক উন্নয়নের পূর্বশর্ত। দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনার মাধ্যমে সরকারি উদ্যোগে এগুলো নির্মাণ করা সম্ভব ।
৭। আয়ের বৈষম্য গ্রাস: অর্থনৈতিক কল্যাণ বাড়ানোর জন্য অর্থনৈতিক বৈষম্য কমানো প্রয়োজন। এজন্য আয় ও সম্পদের সুষম বন্টন দরকার। মুষ্টিমেয় লোকের হাতে সম্পদের কেন্দ্রীভবন বোধ করে জনসাধারণের মধ্যে বা কাঙ্খিতভাবে বন্টনের জন্য সম্পদের বন্টন ব্যবস্থার পুনর্বিন্যাস প্রয়োজন। সুসমন্বিত অর্থনৈতিক পরিকল্পনা গ্রহণের মাধ্যমেই এ উদ্দেশ্য অর্জন করা সম্ভব।
৮। সুষম উন্নয়ন: অর্থনৈতিক উন্নয়নের সুফল দেশের সকল অঞ্চলের লোকদের কাছে পৌছে দেয়া একান্ত প্রয়োজন । এজন্য দেশের প্রায় সব অঞ্চলেরই উন্নয়ন অর্থাৎ সুষম উন্নয়ন ঘটানো দরকার। একমাত্র একটি সুষ্ঠু অর্থনৈতিক পরিকল্পনা বাস্তবায়নের মাধ্যমেই দেশে সুষম অর্থনৈতিক উন্নয়ন সম্ভব।
৯। লেনদেনের ভারসাম্যের প্রতিকূলতা দূর: রপ্তানির তুলনায় আমদানি অনেক বেশি হলে বৈদেশিক বাণিজ্য অব্যাহত প্রতিকূলতা বা ঘাটতি দেখা দেয়। এর ফলে বিদেশের কাছে দেশের ঋণ বাড়ে। কেবল পরিকল্পিত উপায়েই রপ্তানি বাড়িয়ে ও আমদানি কমিয়ে লেনদেনের ভারসাম্যের প্রতিকূলতা দূর করা সম্ভব।
১০। মুদ্রাস্ফীতির চাপ হ্রাস: অন্যান্য উন্নয়নশীল দেশের মত বাংলাদেশেও মুদ্রাস্ফীতি বিদ্যমান। মূলত চাহিদার তুলনায় দ্রব্য ও সেবাদির ঘাটতিই এ অবস্থার জন্য দায়ী। এ অবস্থায় একটি দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনার আওতায় কৃষিক্ষেত্রে ও কলকারখানায় উৎপাদন বৃদ্ধি এবং জনসম্পদ উন্নয়নের মাধ্যমে সেবার পরিমাণ বাড়ানো সম্ভব।
১১। একচেটিয়া কারবার নিয়ন্ত্রণ: অপরিকল্পিত অর্থনীতিতে একচেটিয়া কারবার দ্রুত গড়ে ওঠে। একচেটিয়া কারবারী বেশি দামে দ্রব্যসামগ্রী বিক্রি করে বাধাহীনভাবে জনসাধারণকে শোষণ করে। কেবল পরিকল্পিত অর্থনীতিতেই একচেটিয়া কারবারের উদ্ভব রোধ এবং তার কার্যকলাপ নিয়ন্ত্রণ করে ভোক্তাসাধারণের স্বার্থ সংরক্ষণ করা সম্ভব হয়।
১২। মিশ্র অর্থনীতির বিকাশ: বাংলাদেশসহ অন্যান্য উন্নয়নশীল দেশের অর্থনীতিতে সরকারি ও বেসরকারি খাতের সহঅবস্থান বিদ্যমান। অর্থনৈতিক পরিকল্পনার মাধ্যমে এ দুই খাতের ভারসাম্য উন্নয়ন ঘটলে সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহার নিশ্চিত হবে, অপচয় রোধ করা যাবে এবং দেশে মিশ্র অর্থনীতির বিকাশ ঘটবে।
১৩। বৈদেশিক সাহায্যের ওপর নির্ভলশীলতা হ্রাস: বিশ্বের অনেক দরিদ্র ও উন্নয়নশীল দেশ অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য বৈদেশিক সাহায্যের ওপর অতি মাত্রায় নির্ভলশীল। এ অবস্থা জাতীয় স্বার্থের পরিপন্থী। সুষ্ঠু পরিকল্পনার মাধ্যমে অভ্যন্তরীণ সম্পদের সমাবেশ ঘটালে ক্রমন্বয়ে বৈদেশিক সাহায্যের ওপর নির্ভরশীলতা কমে আসবে।
১৪। অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা অর্জন: দ্রুত ও অব্যাহতভাবে উন্নয়নের স্বার্থে দেশের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা রক্ষ অর্থাৎ, দ্রব্য ও সেবার পরিমাণ বাড়ানো ও দামস্তরের মৃদু বৃদ্ধি দরকার। কেবল পরিকল্পিত কার্যক্রমের মাধ্যমে উৎপাদনজনিত ও মুদ্রাজনিত সমস্যা এড়িয়ে দেশে অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা রক্ষা করা সম্ভব হয়।
ওপরের আলোচনা থেকে বোঝা যায়, দ্রুত অর্থনৈতিক উন্নয়ন অর্জনে সচেষ্ট প্রতিটি দেশের অর্থনীতিতে পরিকল্পনার যথেষ্ট গুরুত্ব রয়েছে। এসব দেশে কেবল সুষ্ঠু ও কার্যকর অর্থনৈতিক পরিকল্পনা গ্রহণের মাধ্যমেই স্বল্পতম সময়ে দেশীয় ও বৈদেশিক সম্পদের যথাযথ বন্টন ও ব্যবহারের মাধ্যমে কাঙ্খিত অর্থনৈতিক উন্নয়ন সম্ভব।
0 মন্তব্য(গুলি):
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
Comment below if you have any questions