সাক্ষাৎকার পদ্ধতি
সাক্ষাৎকার পদ্ধতিসমূহ (Interviewing Methods)
কর্মী নির্বাচনে সাক্ষাৎকার বিভিন্ন প্রকার হতে পারে। তবে কোন প্রকার সাক্ষাৎকার গ্রহণ করা হবে তা নির্ভর করে সাক্ষাৎকার গ্রহণকারী ও প্রার্থীর সম্পর্ক, চাকরির প্রকৃতি ও পর্যায়, সাক্ষাৎকার গ্রহণকারীর পছন্দ, প্রার্থী সম্বন্ধে অনুসন্ধানের ধরন এবং চাকরিদাতা কর্তৃক প্রার্থীর মনের উপর চাপ সৃষ্টির ইচ্ছা প্রভৃতির উপর।
সাক্ষাৎকার পদ্ধতিকে সাত ভাগে ভাগ করা যায়। নিচে এর বর্ণনা দেয়া হলোঃ
১। পরিকল্পিত সাক্ষাৎকার (Planned Interview): পরিকল্পনা একটি অভীক্ষেপিত কর্মসূচি। কোন কার্য কিভাবে সম্পাদন করা হবে তা স্থির করাই পরিকল্পনার প্রধান উদ্দেশ্য। পরিকল্পিত সাক্ষাৎকারে সাক্ষাৎ গ্রহীতা বোর্ড বসার পূর্বে সাক্ষাৎকারের উদ্দেশ্য, এর মাধ্যমে অর্জিত লক্ষ্য, প্রার্থীদের নিকট হতে প্রার্থিত তথ্যের প্রকৃতি, প্রার্থীদেরকে জ্ঞাতব্য বিষয়সমূহ, সাক্ষাৎকার পরিচালনার ধরন এবং এ কাজের জন্য ব্যয় করার মত সময়কাল প্রভৃতি সম্বন্ধে মনস্থির করে নেয়। সাক্ষাৎকারে অনেক সময় হয়ত পরিকল্পনা হতে বিচ্যুতি দেখা দিতে পারে। এর মাধ্যমে প্রার্থীর সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ, তথ্য মূল্যায়ন এবং প্রার্থীর সামনে প্রতিষ্ঠানের সামগ্রীক অবস্থা তুলে ধরা হয়।
২। ছাঁচে ঢালা সাক্ষাৎকার (Patterned Interview) : এটিও পরিকল্পিত সাক্ষাৎকারের একটি বিশেষ রূপ। এতে বিশেষ ধরনের চাকরির জন্য বিশেষ প্রশ্ন কাঠামো ব্যবহার করা হয়। প্রশ্নগুলো তিনটি উৎসের উপর নির্ভর করে প্রস্তুত করা হয়। প্রথমত, কার্য বর্ণনা, পদ ও কর্মী নির্দেশিকাকে প্রশ্ন তৈরির ভিত্তি হিসেবে গণ্য করা হয়। দ্বিতীয়ত, প্রার্থীর আবেদনপত্রে প্রদত্ত তথ্যাবলি ও রেফারেন্স প্রশ্নের সূত্র হিসেবে কাজ করে। তৃতীয়ত, সাক্ষাৎকার গ্রহীতাদের অতীত অভিজ্ঞতাও তাদের পথ প্রদর্শক হিসেবে কাজ করে। এ পদ্ধতিতে এমনভাবে প্রশ্ন নির্ধারণ করা হয় যাতে প্রার্থীর জ্ঞান, দক্ষতা ও গুণাবলি সম্বন্ধে একটি সঠিক চিত্র তাদের সামনে ফুটে উঠে। ফলে প্রার্থীর বর্তমান কর্মক্ষমতা এবং ভবিষ্যতে সে কি কাজ করতে পারবে তা সহজেই বুঝা যায়। একটি রেটিং শিটে চাকরি প্রার্থীদের সাক্ষাৎকার ফলাফল লিখে রাখা হয়। সাক্ষাৎকার সমাপ্তির পর বোর্ডের সকল সদস্যদের দেয়া নম্বরগুলোকে একত্রিত ও সারণিবদ্ধ করে বিশ্লেষণের মাধ্যমে কর্মী নির্বাচনের ফলাফল দেয়া হয়। গবেষণা হতে দেখা যায়, এ পদ্ধতিতে কর্মী নির্বাচনের আংশিক হতে উঁচু পর্যায়ের সঠিক ফলাফল পাওয়া যায়। তবে এতে সাক্ষাৎকার গ্রহীতাদেরকে দক্ষ ও প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত হতে হয়। তাদেরকে অসাধারণ জ্ঞান ও বিশ্লেষণ দক্ষতাসম্পন্ন হতে হবে। তাছাড়া এতে সাক্ষাৎকারের শুরু হতে শেষ পর্যন্ত একটি নির্ধারিত মানের পদ্ধতি অবলম্বন করা আবশ্যক ।
৩। ডেপ্থ সাক্ষাৎকার (Depth Interview): ডেপ্থ সাক্ষাৎকার ছাঁচে ঢালা সাক্ষাৎকার অপেক্ষা কম আনুষ্ঠানিকতাপূর্ণ। এতে সাক্ষাৎকার গ্রহীতা প্রশ্নের মাধ্যমে প্রার্থীর কার্য সম্বন্ধে সামগ্রিক দক্ষতা ও অভিজ্ঞতা মূল্যায়ন করে। প্রার্থীদেরকে অবশ্য প্রশ্নের উত্তরে বক্তব্য বলার যথেষ্ট সুযোগ প্রদান করা হয়। এর পশ্চাতে সাক্ষাৎকার গ্রহীতাদের প্রধান যুক্তি হলো সঠিক কর্মী বাছাই প্রার্থীদের অতীত ইতিহাস ও বর্তমান চিন্তাশক্তির সুষ্ঠু মূল্যায়ন করা। মার্টিন এম ক্রচ (Martin in Bruce) ডেথ সাক্ষাৎকারের একটি কাঠামো তৈরি করেন। তিনি এর মধ্যে ৩৭টি প্রশ্ন অন্তভুক্ত করেছিলেন। এ সমস্ত প্রশ্নাবলির মাধ্যমে কর্মীর শিক্ষা, অভিজ্ঞতা, সামাজিক সম্পর্ক, অর্থনৈতিক অবস্থা, কার্য সম্বন্ধে জ্ঞান ও ব্যক্তিত্ব সম্বন্ধে ধারণা নেয়া সম্ভব হয়। ডেপ্থ সাক্ষাৎকারে প্রশ্ন এরূপ হতে পারে- আপনার অতীত জীবন ও চাকরি সম্বন্ধে কিছু বলবেন কি? আপনি কিভাবে চাকরি পেয়েছিলেন? কি ধরনের কাজ করতেন এবং কেনই বা তা ছেড়ে আসতে চান? আপনার চাকরিতে কি কি ধরনের গুরুত্বপূর্ন কাজ করতে হত? ছাত্রজীবনে কি ধরনের কাজে সবচেয়ে বেশি আনন্দ পেতেন? দশ বৎসর পর আপনি কি ধরনের পদে আসীন হতে চান? প্রার্থীত চাকরি পাওয়ার আপনার কি কি গুণাবলি আছে বলে মনে করেন-ইত্যাদি।
৪। নির্দেশমূলক সাক্ষাৎকার (Directive Interview) : এ ধরনের সাক্ষাৎকার সাধারণত অদক্ষ কর্মী নির্বাচনের ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। অদক্ষ কর্মীদের জ্ঞান ও ধ্যান-ধারনা খুবই সীমিত। কার্য সম্পাদনে বাস্তব অভিজ্ঞতা নেই বলে প্রার্থীদের সীমিত সংখ্যক তথ্য ভিত্তিক প্রশ্ন করা হয়। প্রশ্নকারীকে উত্তরদাতার কোন সমালোচনা করা থেকে বিরত থাকতে হয়। প্রশ্নকারী উত্তর শুনে প্রার্থীর কার্য ক্ষমতা, আচার-ব্যবহার, বাস্তবদৃষ্টি ভঙ্গি ইত্যাদি সম্পর্কে ধারণা লাভ করতে পারে। যে সমস্ত প্রতিষ্ঠানে সীমিত সংখ্যক অদক্ষ কর্মীর প্রয়োজন হয় তারাই এধরনের সাক্ষাৎকার পদ্ধতি ব্যবহার করে।
৫। অনির্দেশমূলক সাক্ষাৎকার (Non-directive Interview) : অনির্দেশমূলক সাক্ষাৎকার প্রার্থীকেন্দ্রিক। অধুনা অনির্দেশমূলক সাক্ষাৎকার পদ্ধতি বেশি জনপ্রিয়তা লাভ করেছে। এ ব্যবস্থায় সাক্ষাৎকার গ্রহীতা পরিকল্পিত, ছাঁচে ঢালা বা সরাসরিভাবে কোন প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করে না। অত্যন্ত সযত্নে সাক্ষাৎকার গ্রহীতা কোন প্রকার মন্তব্য প্রকাশে নিজেকে বিরত রাখে। সে শুধু শুরুতে হয়ত বলে থাকে আপনার অতীত জীবন ও চাকরি সম্বন্ধে কিছু বলবেন? অতঃপর কোন প্রকার বাধা না দিয়ে মনোযোগ সহকারে প্রার্থীর বক্তব্য শুনতে থাকে। সে এমন একটি পরিবেশ সৃষ্টি করে, যেখানে চাকরি প্রার্থী নির্বিঘ্নে ও স্বাধীনভাবে তার বক্তব্যগুলো প্রকাশ করতে পারে। শুধুমাত্র তার মনোযোগ আছে তা বুঝানোর জন্য অতঃপর কি হয়েছে তা তখন কি ধরনের পরিবেশ ছিল প্রভৃতি প্রশ্নাবলি উচ্চারণ করে। এ পদ্ধতিতে সাক্ষাৎকার গ্রহণকর্তা প্রার্থীর কথাবার্তায় কোন প্রকার বাধা প্রদান না করে মনোযোগ সহকারে তার বক্তব্য শুনতে থাকে।
অনির্দেশমূলক সাক্ষাৎকার হতে প্রার্থীর আচরণ মনোভাব, প্রকাশভঙ্গি, প্রেষণা, সাফল্য প্রভৃতি সম্বন্ধে তথ্য পাওয়া যায়। তবে এ ব্যবস্থায় সাক্ষাৎকার গ্রহণকারীকে অনেক বেশি দক্ষতা সম্পন্ন হতে হয়।
৬। দলগত সাক্ষাৎকার (Group Interview) : সাধারণত চাকরিদাতা নির্বাচনে উপরিউক্ত পদ্ধতিগুলোই ব্যবহার করে থাকেন। তবে কোন বিশেষ উদ্দেশ্য সাধনের নিমিত্তে নির্বাহীরা আরও একটি পদ্ধতি ব্যবহার করে থাকে যা দলগত সাক্ষাৎকার পদ্ধতি নামে পরিচিত। এ পদ্ধতিতে প্রার্থীদেরকে দলগত আলোচনায় বসিয়ে দেয়া হয়। আলোচনায় একজন নেতা থাকতে পারে। এতে নির্বাহীর কাজ হবে পেছনে বা পাশে বসে প্রার্থীর আলাপ আলোচনা পর্যবেক্ষণ ও মূল্যায়ন করা। এ ব্যবস্থার সঠিক প্রয়োগ শুধু যে নির্বাহীদের সময় বাঁচাতে সাহায্য করে তাই নয়, বরং সুষ্ঠু নির্বাচন সিদ্ধান্তে সহায়তা করে। তাছাড়া গোল টেবিল বৈঠকে প্রার্থীদের আলাপ আলোচনার সময় একের প্রতি অন্যের প্রতিক্রিয়ার ধরন ফুটে উঠে। দলগত সাক্ষাৎকার যখন কর্মী নির্বাচনের অন্যান্য পদ্ধতির সাতে ব্যবহার করা হয় তখন প্রার্থীদের উদ্যোগ, আবেগের ভারসাম্য, নতুন পরিস্থিতিতে খাপ খাওয়ানোর দক্ষতা, বুদ্ধিমত্তা, বিচক্ষণতা, অন্যদের সাথে মিলেমিশে থাকার ক্ষমতা প্রভৃতি সম্বন্ধে তথ্যভিত্তিক ধারণা পাওয়া সহজ হয়।
৭। চাপ বা পিড়নমূলক সাক্ষাৎকার Stress interview) : এটি এক ধরনের সাক্ষাৎকার পদ্ধতি যাতে এমন ভাবে প্রার্থীকে প্রশ্নের পর প্রশ্ন করা হয় যেন উপস্থিত বুদ্ধির মাধ্যমে তাকে উত্তর দিতে হয়। কোন প্রকার বিশ্রাম চিন্তার সময় না দিয়ে ক্রমাগত প্রশ্ন করার ফলে প্রার্থীর অবস্থা অনেকটা কিংকর্তব্য বিমুঢ় হয়। এক্ষেত্রে প্রার্থীর উপর ক্রমাগত প্রশ্নের চাপ সৃষ্টি করা হয় বলে একে স্ট্রেস সাক্ষাৎকার বা শ্রেষ্ঠ সাক্ষাৎকার পদ্ধতি বলা হয়। এ পদ্ধতিতে প্রার্থীর দ্রুত সিদ্ধান্ত ক্ষমতা যাচাই করা হয়।
0 মন্তব্য(গুলি):
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
Comment below if you have any questions