ভাষাবিজ্ঞান কি
গ্রীক Logos শব্দ থেকে ইংরেজি Language শব্দের উৎপত্তি। গ্রীসে Logos দ্বারা বিদ্যাশক্তি বোঝানো হতো। সংস্কৃতে কথা বলা অর্থে ‘ভাম্' ধাতু থেকে ভাষা শব্দটি এসেছে। সুতরাং দেখা যাচ্ছে, ভাষা প্রপঞ্চটির সাথে চিন্তা ও প্রকাশের গভীর সম্পর্ক রয়েছে। ভাষার সাহায্যেই মানুষ তার চিন্তা, ধ্যান ধারণা, মনের ভাব প্রকাশ করে। চালর্স এফ, হকেটের মতে, ভাষা হচ্ছে মানুষের এমন এক অনন্যসুলভ বৈশিষ্ট্য (Differentia) যা অন্য প্রাণী থেকে মানুষকে স্বাতন্ত্র্য দান করেছে। মানুষ তার এ মহৎ বৈশিষ্ট্যটি হাজার হাজার বছরের ক্রমবিকাশের ধারায় অর্জন করেছে। অনুমান করা হয় প্রায় পাঁচ লক্ষ বৎসর আগে থেকে মানুষ তার জীবন যাপনে পারস্পরিক যোগাযোগের ক্ষেত্রে সুশৃঙ্খল ভাষা ব্যবহার করে আসছে।
ভাষা নামক যোগাযোগ মাধ্যমটির উৎপত্তি প্রাগৈতিহাসিক কালের হলেও ভাষাজিজ্ঞাসার সূত্রপাত হয়েছে অনেক পরে। প্রাচীনকালে প্রায় সকল মানবগোষ্ঠীই বিশ্বাস করত ভাষা ঈশ্বরের দান। মিসরীয়দের বিশ্বাস ছিল ভাষা সৃষ্টি করেছেন ‘থত দেবতা’ বেবিলীয়ানরা বিশ্বাস করে ‘নাবু দেবতা' আর ভারতীয়রা বলে ভাষা দান করেছেন বাক্দেবী সরস্বতী।
জ্ঞানতাত্ত্বিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে ভাষাজিজ্ঞাসার সূত্রপাত গ্রীসে। হেরোডোটাসের রচনায় তার পরিচয় পাওয়া যায়। প্রাচীন ভারতে পাণিনি, যাঙ্ক, পতঞ্জলি ভাষাচিন্তার ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য নাম। তবে, ভাষাকে বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ ও ভঙ্গি থেকে বিশ্লেষণের সূত্রপাত ঊনিশ শতকে। ভাষাজিজ্ঞাসা জ্ঞানের একটি বিশেষায়িত শাখা হচ্ছে ভাষাবিজ্ঞান (Linguistics)।
ভাষাবিজ্ঞান কি
ভাষাবিজ্ঞান (Linguistics) হল ভাষার বিজ্ঞান (Science of Language)। ভাষা সম্পর্কে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে আলোচনাই ভাষাবিজ্ঞানের কাজ। ভাষা সম্পর্কিত যাবতীয় তথ্য উদঘাটন এবং বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে পঠন-পাঠন ও বিশ্লেষণই ভাষাবিজ্ঞানের আলোচ্য বিষয়। ভাষাবিজ্ঞান ভাষার অঙ্গ ব্যবচ্ছেদ, ভাষার অবয়ব সংস্থানের শৃঙ্খলা আবিষ্কার ও তার ব্যবহার প্রণালী বর্ণনা করে।
ভাষাবিজ্ঞানের পদ্ধতি
আলোচনার শুরুতে আমরা ভাষার বিশ্লেষণে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি বলতে কী বোঝায় তা জানব। বিজ্ঞানের অন্যান্য শাখার মতো ভাষাবিজ্ঞানেরও আলোচ্য বিষয়টি সুনির্দিষ্ট। দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গি ও বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যে একটি মৌল পার্থক্য এই যে, দর্শন সমগ্র জগৎ প্রক্রিয়াকে অখণ্ডরূপে গ্রহণ করে তা মূলীভূত রহস্য অনুসন্ধান করে। আর বিজ্ঞান জাগতিক প্রক্রিয়াকে অখণ্ডরূপে গ্রহণ না করে তার এক একটি দিককে স্বতন্ত্রভাবে বিশ্লেষণ ও আলোচনা করে। এ কারণে প্রাণিবিজ্ঞান ও উদ্ভিদ বিজ্ঞানের আলোচ্য বিষয় এক নয়। অনুরূপভাবে, ভাষাবিজ্ঞানেরও আলোচ্য বিষয় সুনির্দিষ্ট: মানুষের ভাষা। ভাষাবিজ্ঞানে ভাষা হল মানুষের বাগ্যন্ত্রের সাহায্যে উচ্চারিত যথেচ্ছ নির্বাচিত (Arbitrary) বাক্য মধ্যে বিধিবদ্ধভাবে বিন্যস্ত এমন কতকগুলি অর্থবহ ধ্বনিগত প্রতীক যার সাহায্যে বিশেষ বিশেষ জাতি বা জনগোষ্ঠীর লোকেরা পরস্পরের মধ্যে ভাব বিনিময় করে। এ ভাষাই হচ্ছে ভাষাবিজ্ঞানের আলোচ্য বিষয়।
বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে ভাষা সম্পর্কে আলোচনার প্রথম ধাপটি হচ্ছে ভাষা সম্পর্কে উপাত্ত সংগ্রহ করে তাকে নথিভুক্ত করা। প্রয়োজন অনুসারে কথ্য ও লেখ্য উভয় প্রকার ভাষা থেকেই তথ্য সংগ্রহ করা হয়। তবে এক্ষেত্রে আধুনিক ভাষাবিজ্ঞানের কথ্য রীতির দিকেই ঝোঁক বেশী। ভাষাবিজ্ঞানী কানে শুনে এবং কিছুটা স্মৃতির সাহায্যে উপাত্ত সংগ্রহ করে রাখতে পারেন। অধিকাংশ ক্ষেত্রে এই উপাত্ত আন্তর্জাতিক ধ্বনিমূলক বর্ণমালার (International Phonetic Alphabet) সাহায্যে লিপিবদ্ধ করে রাখা হয়। টেপরেকর্ডারেও তা সংরক্ষণ করা হয়। প্রাচীন ভাষা সম্পর্কে আলোচনা করতে হলে ঐ ভাষায় লিখিত তথ্যাবলি ( Written Record) যেমন- প্রাচীন প্রত্নলিপি (Inscriptions) প্রাচীন গ্রন্থ ও পুঁথি ইত্যাদি কাজে লাগানো হয়। ভাষার ধ্বনিসমূহের রেখাচিত্র, উচ্চারণ প্রক্রিয়া ইত্যাদি বিভিন্ন দিক সম্বন্ধেও প্রয়োজনীয় তথ্য সংগ্রহ করা হয় কাইমোগ্রাফ (Kimograph) কৃত্রিম তালু (Artificial Palate) এক্সরে ফটোগ্রাফ (X-ray Photograph) প্রভৃতির সাহায্যে। এভাবে ভাষার নানা দিকের উপাত্ত সংগ্রহ করে ভাষাবিজ্ঞানের দ্বিতীয় ধাপে সেগুলির যথাযথ বর্ণনা দেওয়া হয় এবং সেগুলোকে বিশ্লেষণ করা হয়। ভাষার ধ্বনিতাত্ত্বিক দিকটির বর্ণনা ও বিশ্লেষণ আধুনিককালে অসিলোগ্রাফ (Oscillograph), স্পেক্টেগ্রাফ (Spectrograph) প্রভৃতি যন্ত্রের সাহায্য নেওয়া হয়। ভাষার অন্যান্য দিক যেমন শব্দগঠন, শব্দরূপ, বাক্যবিন্যাস ইত্যাদি বিষয়েও ভাষা বিজ্ঞানী পর্যবেক্ষণ, তথ্যবিন্যাস (Processing) ও বিশ্লেষণ (Analysis) করেন। এভাবে ভাষার উপাদানগুলি বিশে-যণ করে যখন দেখা যায় যে একই রকমের কারণ (Cause) থাকলে বারবার একই রকমের ফল (Effect) অথবা একই রকমের পরিস্থিতিতে একই রকমের প্রতিক্রিয়া দেখা যাচ্ছে তখন পরবর্তী ধাপে সে ব্যাপারটিকে সাধারণীকরণ (Generalisation) করা হয়। উদাহরণস্বরূপ আমরা দেখতে পাই যে, সংস্কৃত ‘কর্ম’ পালিতে ‘কম্ম’, ‘ভক্ত’ পালিতে 'ভত্ত' হয়। এ ক্ষেত্রে আমরা এ সাধারণ সিদ্ধান্তে আসতে পারি যে, বিষমব্যঞ্জন নিয়ে গঠিত সংস্কৃত যুক্তব্যঞ্জনগুলি (র, ক্ত) পালি ভাষায় সমব্যঞ্জনে গঠিত সংযুক্ত ব্যঞ্জনে (র্+ম্ হয়েছে ম্+ম্, ক্+ত হয়েছে ত্+ত্) পরিণত হয়। এ সাধারণ সিদ্ধান্তে আসার পরে আমরা অনুমান (Hypothesis) করতে পারি যে, অনুরূপ যোগাযোগের ক্ষেত্রে পালি ভাষায় তার একই পরিণতি হবে। পরবর্তী ধাপে এই অনুমান যাচাই করার পালা। ধর্ম, শক্ত, রক্ত ইত্যাদি সংস্কৃত শব্দ পালিতে ধম্ম, শত্ত, রত্ত হলে সাধারণ সিদ্ধান্তটিকে ভাষাতাত্ত্বিক সূত্র (Linguistic Law) হিসেবে গৃহীত হবে। এভাবে ভাষাবিজ্ঞানী বিশেষ থেকে সাধারণ নিয়মে উপনীত হয়।
ভাষা বিজ্ঞান হল বিজ্ঞানের অন্যান্য শাখার মতই অগ্রসরমান। বিজ্ঞানের অন্যান্য শাখার মতোই ভাষাবিজ্ঞান ক্রমাগত নতুন তথ্য আবিষ্কার করছে এবং নতুন তথ্যের আলোকে পুরনো সিদ্ধান্ত ও নিয়মের পরিমার্জন করছে। ভাষার জ্ঞান আরোহী— অনুসারী। কারণ তা কতকগুলি বিশেষ দৃষ্টান্তকে পর্যবেক্ষণ করে তা থেকে একটি সাধারণ সূত্র আবিষ্কার করে। এ সাধারণ সূত্রগুলো ভাষার বিভিন্ন উপাদান হিসেবে ধ্বনি, শব্দ, বাক্য ইত্যাদি কিভাবে সৃষ্ঠ হয়, কিভাবে কাজ করে তা ব্যাখ্যা করে। ভাষাবিজ্ঞানের জিজ্ঞাসা বিশেষ দৃষ্টান্ত থেকে শুরু হয় এবং তা সাধারণ সূত্রের দিকে এগিয়ে যায় ।
ভাষাবিজ্ঞানের আলোচ্য বিষয়
ভাষার এক একটি অংশকে আলোচ্য বিষয়রূপে গ্রহণ করে ভাষাবিজ্ঞানের পৃথক পৃথক বিভাগ গড়ে উঠেছে। ভাষাকে বিশ্লেষণ করলে আমরা তার নানা স্তর পাই এবং নানা স্তরে নানা উপাদান পাই । আমরা প্রথমেই দেখি যে, আমাদের ভাষা কতকগুলো বাক্যের সমষ্টি। বাক্যপ্রবাহকে বিশ্লেষণ করতে গিয়ে প্রথম যে এক একটি অর্থপূর্ণ একক (Unit) পাই তা হল বাক্য। এই বাক্যকে আবার ক্ষুদ্রতর অংশে বিশ্লেষণ করলে আমরা কতকগুলো শব্দ পাই। আবার শব্দকেও ক্ষুদ্রতর অংশে বিশিষ্ট করে কতকগুলি ধ্বনি পেয়ে যাই। ধ্বনিকে আমরা আর তারচেয়ে কোনো ক্ষুদ্রতর উপাদানে ভাগ করতে পারিনা। ভাষা বিজ্ঞানীরা অবশ্য প্রত্যেকটি ধ্বনিকে কতকগুলি ধ্বনি বৈশিষ্ট্যের (Features) সমষ্টি বলে থাকেন, কিন্তু সাধারণত এত সূক্ষ্ম বিশ্লেষণ করা হয় না। মোটামুটিভাবে ধরে নিতে পারি যে, ভাষা বিশ্লেষণের শেষ ধাপ হল ধ্বনি, এই ধ্বনি হল ভাষার ক্ষুদ্রতম উপাদান, তার মূল উপাদান। ধ্বনি হচ্ছে ভাষার প্রথম স্তর। তারপরে কয়েকটি ধ্বনি সাজিয়ে (অথবা কখনো কখনো একটি মাত্র ধ্বনিতেই) ভাষার যে অর্থপূর্ণ ক্ষুদ্রতম একক পাই তাকে আমরা বলি শব্দ (Word), কিন্তু ভাষাবিজ্ঞানের পরিভাষায় তাকে শব্দ না বলে রূপমূল বলা হয়। ধ্বনির পরের স্তর রূপমূলের স্তর। এর পরের স্তরে আমরা দেখি কতকগুলি রূপমূল এবং শব্দ মিলে এক একটি বাক্য (Sentence) গঠিত হয়। সাধারণত এই স্তর পর্যন্তই ভাষা বিজ্ঞানে ভাষা সম্পর্কে আলোচনা হয়। এর পরের স্তরে কয়েকটি বাক্য নিয়ে এক একটি অনুচ্ছেদ রচিত হয়, কবিতা হলে স্তবক। অনেকগুলো অনুচ্ছেদ বা স্তবক নিয়ে একটি বক্তৃতা বা সাহিত্যকর্ম গড়ে ওঠে। এসব সৃষ্টির বিশ্লেষণ ও গঠনভঙ্গি ব্যাখ্যা নিয়ে সাধারণত বক্তৃতাবিজ্ঞান, অলংকার শাস্ত্র (Rhetoric) প্রভৃতি স্বতন্ত্র শাস্ত্র গড়ে উঠেছে। ভাষা বিজ্ঞানের ক্ষেত্র ক্রমশ প্রসারিত হচ্ছে। আধুনিক কালে শৈলীবিজ্ঞান (Stylistics) নামে ভাষাবিজ্ঞানের যে নতুন শাখাটি গড়ে উঠেছে তাতে এসব বিষয় আলোচিত হচ্ছে। তা ছাড়া ছন্দোবিজ্ঞান (Prosody) ভাষাবিজ্ঞানের অঙ্গ হিসেবে অনেক আগেই প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে।
ভাষার তিনটি প্রধান স্তর হচ্ছে ধ্বনি, রূপমূল এবং বাক্য। এ তিনটি বিভাগের প্রচলিত নাম হচ্ছে যথাক্রমে ধ্বনিতত্ত্ব (Phonology), রূপমূলতত্ত্ব (Morphology) এবং বাক্যতত্ত্ব (Syntax)। পরবর্তী পাঠসমূহে আমরা এ বিষয়গুলো সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে পারব।
0 মন্তব্য(গুলি):
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
Comment below if you have any questions