ভাষার কাজ কি
ভাষাকে প্রায়শ এমন একটি নগরের সাথে তুলনা করা হয়; যে নগরটি নির্মাণে প্রত্যেকটি মানুষ একটি করে ইটের যোগান দিয়েছে। ভাষার ওপর সর্বজনীন অধিকার প্রসঙ্গে এ তুলনাটি তাৎপর্যপূর্ণ। ভাষার সঙ্গে মানুষের সম্পর্কের নিবিড়তা বোঝাতে খ্যাতিমান নাট্যকার বেন জনসন বলেছিলেন, ভাষার মধ্য দিয়ে একটি মানুষের সঙ্গে আর একটি মানুষের প্রকৃত পরিচয়ের সূত্রটি গড়ে ওঠে। তাঁর কথায়, একটি মানুষের সঙ্গে যখন আলাপ করি তখনই কেবল তাকে চিনতে পাই ।
ভাষা ও সভ্যতা এ দুটি একে অপরের গায়ে-পিঠে লেগে আছে। বস্তুত ভাষার দর্পণেই সভ্যতার প্রকৃত স্বরূপটি বিম্বিত হয়। ভাষার অগ্রসর পথেই সভ্যতার ভিত নির্মিত হয়। বস্তুত মানবীয় আচরণের মূল সূত্রটি গ্রথিত ভাষার মধ্যেই এবং ভাষাই মানবীয় আচরণের বিচিত্রিত প্রকাশের কার্যকর মাধ্যম হিসেবে কাজ করে।
ভাষা পরিবর্তনশীল। দেশ ও কালান্তরে এ পরিবর্তন অব্যাহত রয়েছে। ভাষাতত্ত্ব তথা ভাষার বিবর্তনের নিয়মগুলো তখন সামাজিকভাবে তাৎপর্যবহ হয়ে ওঠে যখন তা মানুষ ও তার সভ্যতার সঙ্গে সম্পর্ক সূত্র তৈরি করতে পারে। ভাষা মানুষের মুখেই ফেরে এবং মানুষের মুখেই তার প্রকৃত জীবনীশক্তি পেয়ে থাকে। কাজেই ভাষার নিয়মগুলো তৈরি করতে গেলে মানুষের জীবনাচরণকেই সবার আগে বিবেচনা করতে হয়।
ভাষা একান্তভাবেই গণতান্ত্রিক। কারণ তা মানুষের মুখে মুখে ফেরে এবং তার গমনাগমনের পথ অবারিত। অপরদিকে, সাহিত্য আভিজাতিক, কারণ তা সর্বোত্তম মনীষাকে ধারণ করে। সাহিত্য অগুণতি মানুষের মধ্যে কিছু মানুষের কাজ যারা বুদ্ধি ও মননে অগ্রসর। জনপ্রিয় সাহিত্য অনামিক হলেও তা বারোয়ারী নয়। এ ক্ষেত্রে নামটি অজানা থাকলেও স্রষ্টার অস্তিত্বকে অস্বীকার করা যায় না। সেই স্রষ্টা কেবল তার চারপাশের মানুষের ভাব-ভাবনারই উচ্চারণ করেছেন। ভাষা সকলেরই অধিকারের বস্তু। কারণ তাদের মুখেই ভাষার জগৎ বিস্তৃত। মা-বাবা তার সন্তানসন্ততিকে, শিক্ষক তাঁর ছাত্রদের, নেতা তাঁর অনুসারীদের— মোট কথা, সামাজিক মানুষেরা নিয়তই একে অপরকে ভাষার সবক দিয়ে যাচ্ছেন। মানুষের পারস্পরিক সহযোগিতার সবচেয়ে উর্বর ক্ষেত্রটি হচ্ছে ভাষা ।
ভাষা মানবীয় জ্ঞানের অপরিহার্য মাধ্যম ও বাহন হিসেবে কাজ করে। মৌখিক ও লৈখিক ভাষাই এ দুটি কাজ করে চলেছে। মানবীয় জ্ঞানের পুঁজি ব্যক্তি, দেশ ও কালকে অতিক্রম করবার শক্তি ধারণ করে ভাষার মধ্য দিয়েই। এমন কি, আমাদের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের উপাদান হিসেবে শিল্পকলা, ভাস্কর্য, সংগীত এসবও ভাষার সাহায্যেই বোধগম্য হয়ে ওঠে। লিওনার্দোর মোনালিসা রহস্যময়ী হয়ে ওঠে বাচনিক প্রকাশের মহিমায়, জয়নুলের গুণটানা মাল্লারা জীবন-যোদ্ধা হয়ে ওঠে যখন কথার মালায় ওদের বুঝতে ও বোঝাতে চাই। অন্য কথায়, মহৎ শিল্পকর্মও হয়ে ওঠে ভাষানির্ভর।
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অগ্রযাত্রা মানব জাতির জীবনব্যবস্থার উৎকর্ষগত যে বিশাল সম্ভাবনাকে আভাসিত করেছে তার পশ্চাতে রয়েছে দুই বা বহু মানুষের পরস্পর সহযোগী কুশলী হাত ও সৃষ্টিশীল প্রজ্ঞা। ভাষাই এ ক্ষেত্রে মানুষকে পরস্পর সহযোগী করে তোলে। সেই কবেকার খ্রিষ্টের জন্মেরও আগের দক্ষ কর্মী ও বিজ্ঞানীরা যাদি ভাষার মাধ্যমে নিজেদের মধ্যে চিন্তার বিনিময় না ঘটাতে পারতেন তাহলে মিশরের পিরামিড চিরকালের বিস্ময় হয়ে আবির্ভূত হত না। বস্তুত ভাষা মাধ্যম হিসেবে কাজ না করলে মানবীয় প্রজ্ঞা ও কুশলতার স্থানান্তর, কালান্তর ও উৎকর্ষ কোনটিই সম্ভব ছিল না এবং এখানেই মানুষ ও প্রাণীর মধ্যে মৌল ব্যবধান রচিত হয়েছে।
ভাষার আশ্চর্য জাদুবলেই সেই আদিকাল থেকে আজকের দিন পর্যন্ত মানুষ নানা কর্মযজ্ঞে নিজেকে ব্যাপৃত রেখেছে। জীবন চলার একটি বড় শক্তি হিসেবে কাজ করেছে ভাষা। আমরা যখন কোন ভিন্ন ভাষাভাষীদের মধ্যে পড়ে যাই- তাদের ভাষা বুঝি না এবং নিজেদেরও বোঝাতে পারি না তখন নিজেদের কেমন অসহায় মনে হয়।
ভাষা সর্বপরিব্যাপক। মানবীয় বিদ্যা, সাহিত্য ও দর্শন, ভৌত বিজ্ঞান, পদার্থ বিজ্ঞান, নৃতত্ত্ব এদের বিশেষ কোন একটির পরিসরে ভাষার পদচারণা সীমিত নয়। জ্ঞানের মাধ্যম হিসেবে ভাষা সর্ববিদ্যারই অধিষ্ঠাতা। ভাষাবিজ্ঞানী মেরিও পেই ভাষার অসাধারণ শক্তির কথা বলেছেন এভাবে—
It is the conveyor, interpreter and shaper of mans social doings. It enters into influences, and is in turn, influenced by every form of human activity without exception. Its functions are as numerous as the field in which human ingenuity operates.
আমরা যা কিছু করি বা ভাবি ভাষার ওপর তার প্রভাব পড়ে। এটা সত্য যে, কোন ব্যক্তি যখন তার বক্তব্যে পরিবর্তিত বিষয়বস্তু বা প্রসঙ্গের অবতারণা করে তখন তার মুখভঙ্গি, অঙ্গচালনা এবং এমন কি রসবোধেরও পরিবর্তন ঘটে। আমরা জাগতিক বা আধ্যাত্মিক, খুব সাধারণ বা মহৎ যে কোন কাজে আমরা ব্যাপৃত হই না কেন তার মধ্য দিয়ে আমাদের ভাব ভাবনারও পরিবর্তন ঘটে। ফলে সেই ভাব ভাবনার বিনিময় করতে গিয়ে শব্দ নির্বাচন, বাক্য গ্রন্থনা এসবও ক্রমাগত পরিবর্তিত হয়ে যায়।
পরিবার এবং বৃহত্তর সমাজ পরিমণ্ডলে আমাদের পারস্পরিক সম্পর্কসূত্র ও চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য নিরূপণে ভাষা আশ্চর্য শক্তিধর হাতিয়ার হিসেবে কাজ করে। পরিবার জীবনে নিতান্ত ঘরোয়া পরিবেশে যে ভাষা ব্যবহৃত হয় আনুষ্ঠানিক পরিবেশের ভাষার সঙ্গে তার মিল খুঁজতে যাওয়া বিড়ম্বনা মাত্র। পরিবারিক সম্পর্কসূত্রেও ভাষা বৈচিত্র্য লক্ষণীয়। একই বিষয়ে বা প্রসঙ্গে পিতা- পুত্রের আলাপের ভাষা, দু বোন বা দু ভাইয়ের আলাপের ভাষায় বিভিন্নতা থাকে। পিতার কণ্ঠের সঙ্গে ব্যবহৃত শব্দাবলিও পিতাকে এবং ভাই বা বন্ধুর শব্দাবলি ও দেহভঙ্গি সহজেই পিতা, ভাই বা বন্ধুকে চিনিয়ে দেয়। ভাষা এ ক্ষেত্রে সম্পর্কসূত্র ও চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য নির্ণয়ে কার্যকর ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়। অপরদিকে, পরিবেশ ভেদে ব্যক্তি তার ভাববলয় সৃষ্টিতে ভাষাকেই হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে। প্রিয়জনের সান্নিধ্যে আকাঙ্খিত পরিবেশ সৃষ্টিতে ভাষার কাজই সর্বাধিক গুরুত্ব পেয়ে যায়। আবার একই ব্যক্তির সঙ্গে অফিসকক্ষে ভাষার যে পরিপাট্য, ক্যাফেতে বসে ভাষার সে আটসাঁট বাঁধন শিথিল হয়ে যায়।
বিশেষ বিশেষ শব্দ, ব্যক্তি, বস্তু বা স্থানের নাম অনেক সময় ইতিহাসের পুরনো অধ্যায়কে আমাদের দৃষ্টিতে উন্মেষিত করে। প্রবাদ-প্রবচনও ইতিহাসকে হারিয়ে যেতে দেয় না। বাংলায় ডাক ও খনার বচনে রয়েছে বহুকালের অভিজ্ঞতার সঞ্চয়। ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ বলেছেন, “ছিড়েয় বসে পেঁড়োর খবর”- এই প্রবাদ বাক্যটি সেই সময়ের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়, যখন পান্ডুয়া বঙ্গের রাজধানী ছিল। চর্যাপদের ‘আপনা মাসে হরিনা বৈরী (ভুসুক), ভারতচন্দ্রের ‘নগর পুড়িয়ে দেবালয় কি এড়ায়?, ‘বড়রপিরীতি বালির বাঁধ/ক্ষণে হাতে দড়ি ক্ষণে কে চাঁদ' (অন্নদান ) এসব এখন প্রবচন যা নানা পরিস্থিতি ও প্রসঙ্গে আমরা বলে থাকি 1
বিশ্বের বেশির ভাগ ভাষারই প্রাচীনতম নিদর্শন হচ্ছে ধর্ম বা অধ্যাত্ম-সাধনা বিষয়ক গ্রন্থাবলি। অনেকে মনে করে, লেখ্যরীতির আবির্ভাব ঘটেছে ধর্মীয় বিধানকে স্থায়ীরূপ দেওয়ার প্রচেষ্টা থেকে। ভাষা অনেক ক্ষেত্রে ধর্মীয় বিশ্বাস ও সংস্কৃতির প্রতীক হয়েছে। রোমান ক্যাথলিকদের ল্যাটিন, মুসলমানদের আরবি, বৌদ্ধদের পালি-প্রাকৃত, ইহুদিদের হিব্রু ধর্মীয় বিধান ও সংস্কৃতির বাহন হয়েছে। বিশ্বের অনেক সমৃদ্ধ ভাষার কৃতঋণ শব্দাবলি এসেছে ধর্মীয় গ্রন্থ ও বিধি বিধান থেকে। অনেক ক্ষেত্রে এগুলোর অর্থ বৈচিত্র্য ঘটেছে। আরবি নিয়ত, ফরজ, কায়েম, বরাত, ইমান ইত্যাদি শব্দ আমাদের প্রতিদিনের কাজে নানা প্রসঙ্গে ব্যবহৃত হচ্ছে। ইংরেজি Disciple, Dean Syllabus, Lecture এসব শব্দ ধর্মের গণ্ডি ছাড়িয়ে শিক্ষা প্রসঙ্গে ব্যবহৃত হচ্ছে।
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয়ক বিশাল শব্দভাণ্ডার এখন আন্তর্জাতিক। ভাষার ব্যবধান কমিয়ে এ শব্দগুলো আমাদের সময় ও শ্রমকে বহুলাংশে লাঘব করেছে। সাম্প্রতিক কালের কম্পিউটার, ইন্টারনেট, ই-মেইল, মোডেম, ডিস্ক এখন বিশ্বজনীন শব্দাবলি। বিজ্ঞানী, প্রযুক্তিবিদ, প্রকৌশলী ও চিকিৎসাবিজ্ঞানীরা এ ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন।
শিক্ষার বিশাল অঙ্গনে ভাষার প্রতাপ দৌর্দণ্ড। সব শিক্ষকই ভাষা শিক্ষক- এ বচন এখন প্রবচনের শক্তি অর্জন করেছে। শিক্ষার কাজ পুরোপুরিই মৌখিক ও লিখিত ভাষা নির্ভর। শেখা শেখানোর সব পর্যায়েই ভাষার আধিপত্য একচ্ছত্র। প্রস্তুতি, উপস্থাপনা ও মূল্যায়ন এ সব কয়টি শিক্ষক- শিক্ষার্থী মৌখিক ও লিখিত ভাষা-কৌশল প্রয়োগ করেন। ভাষা কেবল ভাষা শিক্ষকের অধিকারের জগৎ নয়, গণিত, বিজ্ঞান, সমাজ বিজ্ঞান ইত্যাদি সব বিষয় জ্ঞানের পরিবেশনা ও অনুশীলনে ভাষার ব্যবহার অপরিহার্য।
0 মন্তব্য(গুলি):
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
Comment below if you have any questions