Home » » উমর বিন হাফসুন

উমর বিন হাফসুন

উমর বিন হাফসুন

আমীর মুহম্মদের শাসনামলে (৮৫২-৮৬) স্পেনের দক্ষিণ-পূর্ব দিকে বোবাস্ট্র পর্বতের পাদদেশে উমর বিন হাসুন নামে এক বিদ্রোহী নেতার নাটকীয় উত্থান ঘটে। স্পেনের ইতিহাসে উমর বিন হাসুন একজন বিতর্কিত ব্যক্তি। মুসলিমদের নিকট তিনি একজন ধর্মদ্রোহী বিদ্রোহী নেতা হলেও স্বজাতির অনেকের নিকট তিনি জাতীয়তাবাদী নেতা হিসেবে বিবেচিত। মুহম্মদ, মুযির, আবদুল্লাহ্ ও তৃতীয় আব্দুর রহমান- এ চারজন আমীরের বিরুদ্ধে তিনি ক্রমাগতভাবে যুদ্ধ চালিয়ে যান। 


উমর বিন হানের পরিচয় ও বোবাস্ট্র দুর্গে আধিপত্য বিস্তার : 

উমর বিন হাসুন ৮৬০ সালে রোন্দার নিকটবর্তী ইজনাটে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম হাফ বিন উমর বিন জাফর আল-ইসলামী। হাসুন একজন সম্ভ্রান্ত বংশীয় লোক হলেও তাঁর পুত্র উমর ছিলেন উগ্র মেজাযী এবং দস্যু প্রকৃতির। ফলে তিনি পিতৃস্নেহ থেকে বঞ্চিত হন এবং পর্বতের পাদদেশে গহীন অরণ্যের মধ্যে দস্যুদের সাথে মিলিত হয়ে দস্যু জীবন শুরু করেন। উমর একবার একজন স্থানীয় সরকারী কর্মচারীকে হত্যা করে পিতার সাথে বোবা পর্বতের পাদদেশে অবস্থিত সেরেনিয়া ডে রোন্দায় পলায়ন করেন। তাঁর বিরুদ্ধে গ্রেফতারী পরওয়ানা জারী করা হলে তিনি উত্তর আফ্রিকায় পলায়ন করেন। ৮৮০ সালে তিনি বোবাস্ট্রতে ফিরে আসেন। চাচা মুজাহিরের সহযোগিতায় ৪০ জনের একটি ডাকাত দল গঠন করে বোবাস্ট্র দুর্গে বসবাস শুরু করেন। বহু মোযার ও নও-মুসলিম তার দলে যোগদান করে এবং তিনি তাদের নিয়ে একটি শক্তিশালী সেনাবাহিনী গঠনে আত্মনিয়োগ করেন। ধীরে ধীরে নগরের বিদ্রোহীরাও তার দলে যোগদান করে। তিনি বোবাঐ দুর্গের পার্শ্ববর্তী বিভিন্ন গ্রামের উপর আধিপত্য বিস্তার করতে থাকেন।


প্রথম মুহম্মদের সাথে সংঘর্ষ : 

প্রথম মুহম্মদ (৮৫২-৮৮৬) উমরের বিরুদ্ধে দুটি অভিযান প্রেরণ করেন এবং অভিযান দুটি উমর কর্তৃক পরাজিত হয়। এরপর মুহম্মদের প্রধানমন্ত্রী হাশিম তাঁকে শোচনীয়ভাবে পরাজিত করেন। তবে উমরের বীরত্বে মুগ্ধ হয়ে হাশিম তাকে ৮৮৩ সালে রাজকীয় সেনা অফিসার হিসেবে নিয়োগ দান করেন। সেনা অফিসার হিসেবে নিয়োগের পর তিনি একাধিক যুদ্ধে কৃতিত্বের পরিচয় দেন। সৈন্যদের জন্য অত্যন্ত নিম্নমানের খাবার সরবরাহ করার কারণে কর্ডোভার নগর-প্রধান মুহম্মদ বিন ওয়ালিদের সাথে তাঁর মনোমালিন্য হয় এবং প্রধানমন্ত্রী হাশিমের কাছে এ বিষয়ে তিনি অভিযোগ করেন। কিন্তু কোন প্রতিকার না পেয়ে রাগান্বিত হয়ে ৮৮৪ সালে মুহম্মদের সেনাবাহিনী ত্যাগ করেন এবং বোবাস্ট্রতে গিয়ে তার দুর্গ সুরক্ষিত করে প্রতিশোধ গ্রহণের জন্য মুহম্মদের বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণ করতে থাকেন। নওমুসলিমদের ভাগ্য পরিবর্তনের প্রতিশ্রুতি দিয়ে তার দলের লোকসংখ্যা বৃদ্ধি করতে থাকেন এবং জায়েন ও আশেপাশের অঞ্চলগুলিতে দস্যুবৃত্তি অব্যাহত রাখেন। আমীর তাঁর বিরুদ্ধে জায়িদ বিন কাসিমকে প্রেরণ করেন। উমর রাজকীয় বাহিনীকে মোকাবিলা না করে ক্ষমা প্রার্থনা করেন এবং করদানে স্বীকৃত হন। তাকে ক্ষমা প্রদর্শন করা হয়। কিন্তু বিশ্বাসঘাতকতা করে তিনি রাতে হঠাৎ রাজকীয় বাহিনীর উপর আক্রমণ করে সেনাপতি জায়িদকে হত্যা করেন। ৮৮৬ সালে যুবরাজ মুনযির আল-হামা দুর্গে উমরের এক সহযোগী বিদ্রোহীকে পরাজিত করে তার মস্তক রাজধানীতে প্রেরণ করেন। উমরও এ যুদ্ধে অংশ নেন এবং আহত অবস্থায় পলায়ন করেন। ঠিক এ সময়ে পিতার মৃত্যুর সংবাদ পেয়ে মুনযির রাজধানীতে প্রত্যাবর্তন করেন। মুনযিরের সাথে সংঘর্ষ : আমীর মুনযির (৮৮৬-৮৮) রাজধানীতে প্রত্যাবর্তন করলে উমর নিজের অবস্থা সুরক্ষিত করতে সময় ও সুযোগ পান। তিনি সারাগোসা, হিউয়েসকা ও টলেডােতে তাঁর রাজ্য বিস্তৃত করেন। মুনযির প্রথমে উমরের সহযোগী আর্চিদোনা দুর্গের অধিপতি নও-মুসলিম আইসুনের বিরুদ্ধে ৮৮৮ সালে অভিযান প্রেরণ করেন। আমীর সহজেই দুর্গটি দখল করেন। আর্চিদোনা দখলের পর তিনি বোবাস্ট্র দুর্গ অবরোধ করেন। উমর উপয়ান্তর না দেখে কয়েকটি শর্তে বশ্যতা স্বীকার করেন: ১. তিনি বোবাঐ ত্যাগ করে কর্ডোভাতে বসবাস করবেন, ২. রাজকীয় বাহিনীতে যোগ দেবেন, ৩, তাঁর পুত্রগণ আমীরের নিকট যামিন হিসেবে থাকবে এবং ৪. তাঁর আসবাবপত্র বহনের জন্য আমীর ১০০ খচ্চর প্রেরণ করবেন। আমীর তাঁর কথায় বিশ্বাস করে ১০০ খচ্চর বোবাস্ট্রতে প্রেরণ করেন। কিন্তু উমর রাতের অন্ধকারে আমীরের তাঁবু হতে পলায়ন করে নিজের আস্তানায় চলে আসেন এবং দলবল নিয়ে ১০০ খচ্চর হস্তগত করেন। মুযির প্রতিশোধ গ্রহণের জন্য যুদ্ধে অবতীর্ণ হন এবং বোবা দুর্গ অবরোধ করেন। কিন্তু ভাই আবদুল্লাহর প্ররোচনায় চিকিৎসকের বিষপ্রয়োগে তিনি নিহত হন। ফলে উমরকে পরাস্ত করা এবারও সম্ভব হয়নি।


আবদুল্লাহর সাথে সংঘর্ষ :

মুযিরের পর আবদুল্লাহর শাসনামলে (৮৮৮-৯১২) রাজ্যব্যাপী গোলযোগের সুযোগে উমর বোবাস্ট্রো দুর্গ সুরক্ষিত করে পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে প্রভাব বৃদ্ধি করতে থাকেন। তিনি উমরকে পরাস্ত করতে না পেরে তার সাথে একটি চুক্তি করেন। সেখানে উল্লেখ থাকে যে উমর তাঁর অধিকৃত এলাকায় আমীরের প্রতিনিধি হিসেবে শাসন করবেন। কিন্তু উমরের অনুচররা এই নিয়মতান্ত্রিক ও শান্তিপূর্ণ শাসনে বিশ্বাসী ছিলনা। কারণ তারা লুণ্ঠনবৃত্তিকে পেশা হিসেবে গ্রহন করেছিল এবং এজন্যই উমরের প্রতি তাদের আনুগত্য ছিল। এ সময় আমীর অভ্যন্তরীণ সংকট নিরসণে বিশেষ করে আরব নেতাদের দমনে উমরের সাহায্য কামনা করেন। ফলে উমর রাজকীয় বাহিনীতে যোগদান করেন। তাঁর উদ্দেশ্য ছিল নিজকে শক্তিশালী করা এবং রাজকীয় বাহিনীকে পঙ্গু করা। তিনি জায়েনের শাসনকর্তা ইবনে মুসতানার সাথে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হন এবং কর্ডোভার খ্রিস্টানদের সমর্থনে গোয়াদালকুইভার নদীর দক্ষিণ দিকে প্রভাব বৃদ্ধি করেন। এমনকি তাদের সহযোগিতায় তিনি কর্ডোভাতেও প্রভাব বিস্তার শুরু করেন। আমীর তাঁর সেনাপতি আব্দুল মালিককে উমরের বিরুদ্ধে প্রেরণ করেন এবং ৮৯১ সালে পােলির যুদ্ধে তাকে পরাজিত করেন। এরপর পােলি দখল করেন এবং বোবাস্ট্র অবরোধ করেন। কিন্তু রণক্লান্ত সৈন্যরা অধিককাল রণাঙ্গণে থাকতে সম্মত না হওয়ায় বোবাস্ট্র অধিকার সম্পন্ন না করেই রাজধানীতে প্রত্যাবর্তন করে। এরপর উমর পােলি, এছিজা, আর্চিদোনা, এলভিরা, গ্রানাডা ও জায়েন দখল করেন। ক্রমাগত যুদ্ধ সাফল্যে উমর গর্বিত হয়ে ওঠেন এবং ৮৯৯ সালে ইসলাম-ধর্ম ত্যাগ করে স্যামুয়েল নাম নিয়ে খ্রিস্টান ধর্ম গ্রহণ করেন। উদ্দেশ্য ছিল খ্রিস্টান নরপতিদের সাহায্য ও সমর্থন লাভ করা। কিন্তু খ্রিস্টানগণ তাঁকে বিশ্বাস করতে পারেনি। মুসলিমরাও তার পক্ষ ত্যাগ করে। ৯১০ সালে তিনি উত্তর আফ্রিকার ফাতিমিদের সাথে মিত্রতা স্থাপন করেন। 


তৃতীয় আব্দুর রহমানের সাথে সংঘর্ষ : 

উমর বিন হাফসুন খ্রিস্টান ধর্ম গ্রহণ করার ফলে তার জনপ্রিয়তা ব্যাপকভাবে হ্রাস পায় এবং তার পার্বত্য দুর্গ ধীরে ধীরে আব্দুর রহমানের হস্তগত হতে শুরু করে। ফাতিমিদের সাথে তার মিত্ৰতা তৃতীয় আব্দুর রহমানের (৯১২-৬১) রাজ্যে হুমকির সৃষ্টি করেছিল। আমীর গোয়দালকুইভার নদীর তীরে টোলক্স দুর্গে তাঁকে চূড়ান্তভাবে পরাজিত করেন এবং ৯১৭ সালে উমর মৃত্যুবরণ করেন। উমরের পুত্রগণ বোবাস্ট্রতে আরও কিছুকাল আধিপত্য বজায় রাখলেও ৯২৮ সালে চূড়ান্তভাবে এর পতন হয়।


জাতীয়তাবাদের অগ্রনায়ক : 

মুসলিমদের কাছে উমর বিন হাসুন বিদ্রোহী হলেও খ্রিস্টানদের অনেকের কাছে তিনি জাতীয়তাবাদের অগ্রনায়ক ছিলেন। খ্রিস্টান-ধর্ম গ্রহণ করার পর স্পেনবাসী খ্রিস্টানরা তাঁর নেতৃত্বে তাদের হারানো রাজ্য ও কর্তৃত্ব ফিরে পেতে চেয়েছিল। অনেক খ্রিস্টান জাতীয় চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে তাঁর দলে যোগদান করে। এ দিক থেকে বিচার করে অনেকে তাকে স্পেনের খ্রিস্টান জাতীয়তাবাদের অগ্রনায়ক বলতে চেয়েছেন। তবে সার্বিক বিচারে তাকে জাতীয়তাবাদী বলা যায়না। উমর বিন হাসুন ধর্মান্তরিত হবার কারণে তাঁর মধ্যে সঠিক কোন জাতীয়তাবোধ ছিল না। প্রথমত তিনি ছিলেন মুসলিম। তাই মুসলিম হয়ে মুসলিম রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে জাতীয়তাবাদী হবার প্রশ্ন অবান্তর। পরে তিনি খ্রিস্টান ধর্ম গ্রহণ করলেও তা ছিল রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। খ্রিস্টানরাও তার উপর বিশ্বাস স্থাপন করতে পারেনি। ফলে কোন সম্প্রদায়েরই আন্তরিক বিশ্বাস ও সমর্থন তিনি লাভ করতে পারেননি। এছাড়া তাঁর প্রভাবাধীন এলাকা কখনই রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি পায়নি। তাই তিনি কারও কারও নিকট জাতীয়তাবাদী হলেও অনেকের নিকট একজন বিদ্রোহী বা দুবৃত্ত হিসেবে পরিচিত। 

উমর বিন হাসুন প্রায় অর্ধ-শতাব্দীকাল ধরে বিদ্রোহ, লুটতরাজ, লুণ্ঠন, দুবৃত্তপনার মাধ্যমে বোবাস্ট্রতে রাজ্য প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করলেও তা সফল হয়নি। আমীর তথা সেনাবাহিনীর দুর্বলতা, ভৌগোলিক প্রতিকূলতা এবং উমর বিন হাসুনের ধূর্তামি তাঁর দীর্ঘদিন ধরে টিকে থাকার কারণ। তবে উমর বিন হাসুন রাজ্য প্রতিষ্ঠায় ব্যর্থ হলেও তাঁর বিদ্রোহ সে সময়ে মুসলিম স্পেনের সংহতি অর্জনের ক্ষেত্রে একটি বিরাট অন্তরায় সৃষ্টি করেছিল।


পরিশেষে বলা যায়, স্পেনের ইতিহাসে উমর বিন হাসুন একজন বিতর্কিত ব্যক্তিত্ব। তিনি দক্ষিণ স্পেনের বোবাস্ট্রতে তাঁর আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করে মুহম্মদ, মুযির, আবদুল্লাহ্ ও তৃতীয় আব্দুর রহমান- এ চারজন আমীরের বিরুদ্ধে ক্রমাগতভাবে যুদ্ধ  চালিয়ে যান। তিনি ইসলাম-ধর্ম ত্যাগ করে স্যামুয়েল নাম নিয়ে খ্রিস্টান-ধর্ম গ্রহণ করেন। তৃতীয় আব্দুর রহমান  গোয়দালকুইভার নদীর তীরে টোলক্স দুর্গে তাকে চূড়ান্তভাবে পরাজিত করেন।

0 মন্তব্য(গুলি):

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Comment below if you have any questions

Contact form

নাম

ইমেল *

বার্তা *