বাংলাদেশের পোশাক শিল্প
বাংলাদেশের মত উন্নয়নশীল দেশগুলোর অর্থনৈতিক উন্নয়নের প্রধান অবলম্বন হলো শিল্পায়ন। বাংলাদেশে অর্থনীতিতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ খাত হচ্ছে পোশাক শিল্প। রপ্তানী আয়, জিডিপিতে অবদান, কর্মসংস্থান প্রভৃতি বিবেচনা করে পোশাক শিল্পকেই বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ শিল্প বলে অভিহিত করা যায়, যা বিশ্ববাজারে দ্বিতীয় স্থানের অধিকারী। ২০১৫-১৬ অর্থবছরে বাংলাদেশের মোট রপ্তানির আয়ের প্রায় ৮৫ শতাংশ এসেছে বস্ত্র ও পোশাক শিল্প থেকে। একই অর্থ বছরে বস্ত্র ও পোশাক শিল্প থেকে বাংলাদেশের মোট রপ্তানি আয় ছিল ২৯,১০৪ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। বর্তমানে বিশ লক্ষেরও বেশি মানুষ কাজ করে পোশাক শিল্পে ।
বাংলাদেশের পোশাক শিল্পের কয়েকটি শাখা রয়েছে। নিটওয়্যার, সোয়েটার, ডেনিম, আন্ডারওয়্যার ইত্যাদি এক্ষেত্রে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। বাংলাদেশের পোশাক শিল্পের বিশেষত্ব হচ্ছে, এ খাতের মোট শ্রমশক্তির প্রায় ৮৫ শতাংশ নারী শ্রমিক। এ শিল্পের উন্নয়নে সরকারের পৃষ্ঠপোষকতার পাশাপাশি বাংলাদেশ গার্মেন্টস ম্যানুফ্যাকচারিং এক্সপোর্টার এ্যাসোসিয়েশন (বিজিএমইএ) গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। বিশ্বের প্রায় অধিকাংশ দেশে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক রপ্তানি হয়। তবে আমেরিকা, কানাডা, জার্মানি, ফ্রান্স, যুক্তরাজ্যসহ ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলো বাংলাদেশি পোশাক শিল্পের বড় বাজার। বাংলাদেশের শিল্পায়নে পোশাক শিল্প সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। এ শিল্পের মত আর কোনো শিল্প দ্রুত বিস্তার লাভ করেনি। তবে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক শিল্পের বর্তমান অগ্রগতি রাতারাতি সম্ভব হয়নি। স্বাধীনতার পর থেকেই ধীরে ধীরে এ শিল্পের বিকাশ হয়েছে।
স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের তৈরি পোশাক শিল্পের উন্নয়নের জন্য বাংলাদেশে টেক্সটাইলস মিলস কর্পোরশেন নামে আলাদা একটি প্রতিষ্ঠান স্থাপন করা হয়। ১৯৮২-৮৩ সালে বিটিএমসি এর নিয়ন্ত্রণে মোট ২২টি টেক্সটাইল মিল ছিল। ঐ বছর ২টি নতুন মিলসহ ১টি পুরাতন মিল চালু হয় এবং মোট মিলের সংখ্যা দাঁড়ায় ৩৩টি। এ বছর মিলসমূহের ৯৬০.৬০ লক্ষ পাউন্ড সুতা এবং ৫৪৬.০০ লক্ষ গজ কাপড় উৎপাদনের লক্ষ মাত্রা নির্ধারণ করে। ১৯৮৫-৮৬ সালে আরও ৫টি বিশেষ ধরনের মিল চালু হয়। ১৯৮৭-৮৮ সালে ৩৬টি সুতা ও বস্ত্রকল এবং ৫টি বিশেষ মিলসহ মোট ৪১টি মিল চালু হয়। এ ধারা নব্বইয়ের গোটা দশক জুড়ে অব্যাহত ছিল। একবিংশ শতকের প্রথম দশকে এসেও বস্ত্র এবং তৈরি পোশাক শিল্পের অগ্রযাত্রায় ছেদ পড়েনি। তবে বাংলাদেশের বস্ত্র ও তৈরি পোশাক শিল্পে ঘাটতি এবং ঝুঁকিও কম নেই। এসব ঘাটতি ও ঝুঁকি মোকাবিলা করা সম্ভব হলে এদেশের বস্ত্র ও পোশাক শিল্পের ব্যাপ্তি আরো অনেক বৃদ্ধি পাবে। নিম্নে এ সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা করা হলো:
১। উৎপাদিত পণ্যে বৈচিত্র্য আনয়ন: বাংলাদেশে তৈরিকৃত পোশাক পৃথিবীর বিভিন্ন উন্নত দেশে রপ্তানি হয়। রপ্তানীতে অনেক দেশের সাথে প্রতিযোগিতার মুখোমুখী হতে হয়। উৎপাদিত পণ্যে বৈচিত্র্য না থাকলে বিদেশী ক্রেতা আকৃষ্ট হবে না এবং প্রতিযোগিতায়ও টিকে থাকা সম্ভব হবে না ।
২। শ্রমিকদের মজুরি বৃদ্ধি এবং কাজের পরিবেশ উন্নত করা: বাংলাদেশের বস্ত্র ও তৈরি পোশাক শিল্পে নিয়োজিত শ্রমিকদের মানসম্মত বেতন-ভাতা ও সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করা জরুরি। তাদের কাজের পরিবেশ, নিরাপত্তা ও ট্রেড ইউনিয়ন করার অধিকার, দুর্ঘটনায় ক্ষতিপূরণ প্রদান ইত্যাদি বিষয়ে দৃশ্যমান অগ্রগতি ব্যতীত এ শিল্পের কাঙ্ক্ষিত উন্নতি সম্ভব নয়।
৩। শ্রমিকের দক্ষতা বৃদ্ধি: বাংলাদেশের গার্মেন্টস শিল্পে নিয়োজিত মোট শ্রমিকের সিংহভাগই নারী। এদের বেশিরভাগ আবার নিরক্ষর, স্বল্পশিক্ষিত এবং অদক্ষ। ফলে শ্রমিক হিসেবে অধিক শ্রম প্রদান করার পরেও তারা কম মজুরি পায় । কারণ দক্ষতার অভাবে তারা উৎকৃষ্টমানের পোশাক উৎপাদন করতে পারে না। দক্ষ জনবলের জন্য অনেক সময় বিদেশিদের উপর নির্ভর করতে হয়। এতে বিরাট অংকের বৈদেশিক মুদ্রা খরচ হয়। সুতরাং পোশাক শিল্পের উন্নয়নে দক্ষ জনবল তৈরি করা অপরিহার্য।
৪ । দেশীয় কাঁচামালের উৎপাদন বৃদ্ধিঃ বস্ত্র ও পোশাক শিল্পের উৎপাদন, বাজারজাতকরণ এবং রপ্তানিতে প্রচুর কাঁচামালের প্রয়োজন হয়। এসব কাঁচামাল বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়। ফলে আমদানি শুল্কসহ পণ্যের মূল্য অনেক বেশি পড়ে। তাই প্রয়োজনীয় কাঁচামাল দেশে উৎপাদন করা সম্ভব হলে পোশাক শিল্পের আরো সমৃদ্ধি ঘটবে।
৫। রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা: অতীতে বাংলাদেশের অস্থিতিশীল রাজনৈতিক পরিবেশ ও পরিস্থিতির কারণে তৈরি পোশাক শিল্প প্রায়ই ঝুঁকির মধ্যে পড়ে। রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা এবং সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ বিদেশি বিনিয়োগকারী এবং ক্রেতাদেরকে এদেশে আসতে নিরুৎসাহিত করে।
৬। গ্যাস-বিদ্যুৎ এবং অবকাঠামোগত সীমাবদ্ধতা: বাংলাদেশের বস্ত্র ও পোশাক শিল্পের অন্যতম বাধা হচ্ছে গ্যাস- বিদ্যুতের অভাব এবং দুর্বল অবকাঠামোগত সহযোগিতা। বন্দর, রাস্তা-ঘাট, পরিবহণসহ নানা বিষয়ে শিল্পের জন্য অনুকূল সহায়তার অভাব রয়েছে। এসব সীমাবদ্ধতা দূর না হলে আগামীতে দেশের বস্ত্র ও পোশাক শিল্পকে আরো ঝুঁকির মধ্যে পড়তে হতে পারে।
পোশাক শিল্পের আর্থ-সামাজিক প্রভাব
পোশাক শিল্পের দ্রুত প্রসার, বিকাশ, উন্নতি ও সম্প্রসারণ বাংলাদেশের সার্বিক অর্থনৈতিক উন্নয়নকে ত্বরান্বিত করছে। ২০১২ সালের অর্থনৈতিক সমীক্ষা অনুযায়ী বাংলাদেশে জাতীয় আয়ে পোশাক ও বস্ত্র খাতের অবদান ৩১.৬ শতাংশ । বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন, কর্মসংস্থান, মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি প্রভৃতি ক্ষেত্রে পোশাক শিল্পের প্রত্যক্ষ প্রভাব রয়েছে। বাংলাদেশের তৈরি পোশাক শিল্পের অবদান জাতীয় অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির একটি বৃহৎ অংশ। নারীর ক্ষমতায়নেও পোশাক শিল্পের অবদান অনস্বীকার্য। বস্ত্র এবং তৈরি পোশাক শিল্প বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক খাতে যে অবদান রাখছে এখানে সংক্ষেপে সে সম্পর্কে আলোচনা করা হলো।
১। কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও বেকারত্ব হ্রাস: বস্ত্র ও পোশাক শিল্প দেশের অন্যতম বৃহৎ কর্মক্ষেত্র। শিক্ষিত মানুষের পাশাপাশি দেশের বিপুলসংখ্যক নিরক্ষর এবং স্বল্পশিক্ষত মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টি করেছে পোশাক শিল্প।
২। দারিদ্র্য বিমোচন: কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও বেকারত্ব দূরীকরণের মাধ্যমে দেশের দারিদ্র্য বিমোচনে পোশাক শিল্পের অবদান অনস্বীকার্য। মাথাপিছু আয় বৃদ্ধিতেও এ শিল্পের অবদান রয়েছে।
৩। অর্থনৈতিক উন্নয়ন: বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন এবং জাতীয় আয়ে অবদানের মাধ্যমে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে পোশাক শিল্পের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
৪ । নারীর ক্ষমতায়ন: বস্ত্র ও পোশাক শিল্পের মোট শ্রমশক্তির ৮৫ শতাংশ নারী। সমাজের নিম্নবিত্ত, নিরক্ষর ও স্বল্পশিক্ষিত পরিবার থেকে উঠে আসা নারীরা কর্মসংস্থানের মাধ্যমে নিজেদেরকে পরিবার এবং আর্থ-সামাজিক ক্ষেত্রে অধিকতর অবদান রাখতে সক্ষম হচ্ছে।
৫। নগরায়ণকে ত্বরান্বিত করছে: তৈরি পোশাক শিল্প বাংলাদেশের নগরায়ণকে ত্বরান্বিত করেছে। গ্রামের বিপুলসংখ্যক মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে এ শিল্পে। কর্মসংস্থানের প্রয়োজনেই গ্রামের মানুষ শহরে এসে শহরকে আরো বিস্তৃত করেছে। আবার অনেক ক্ষেত্রে শহরের বাইরে তৈরি পোশাকের শিল্প-কারাখানা স্থাপন করা হয়েছে। ওই শিল্প-কারাখানাকে ঘিরে জনপদটি ক্রমশ নগরের রূপ লাভ করেছে ।
0 মন্তব্য(গুলি):
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
Comment below if you have any questions