প্রাচীন প্রস্তর যুগ কাকে বলে
প্রাচীন প্রস্তর যুগ (Paleolithic age):
প্রাচীন প্রস্তরযুগ-এর ইংরেজি প্রতিশব্দ হল Paleolithic Age। গ্রিক শব্দ Palaeo (পুরো > পুরাতন) এবং Lithos (পাথর) শব্দদ্বয়ের সমন্বয়ে Paleolithic / Palaeolithic শব্দটি গঠিত। এ যুগটি ছিল প্রস্তরযুগের প্রথম পর্যায়। প্রাগৈতিহাসিক এ যুগকে সময়ের হিসেবে সবচেয়ে দীর্ঘতম বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। প্রাথমিকভাবে ১০ থেকে ১৫ লক্ষ খ্রিস্টপূর্ব অব্দ পর্যন্ত প্রাচীন প্রস্তরযুগের সময়কাল বিবেচনা করা হয়। তবে প্রয়োজনীয় প্রমাণাদি না পাওয়ায় আধুনিক প্রত্নতত্ত্ববিদ ও ইতিহাস গবেষকেরা এ যুগের সময়কাল সংক্ষিপ্ত করে ১ লক্ষ থেকে ১০ হাজার বছরের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখেন। এ যুগে অবিকৃত, অমসৃণ ও স্থুল পাথরের অস্ত্র ব্যবহৃত হয়েছে। যাবতীয় তথ্য-প্রমাণ থেকে দাবি করা হয়েছে যে, মানবসভ্যতার প্রাথমিক বিকাশ প্রাচীন প্রস্তরযুগ বা পুরোপলীয় যুগেই ঘটেছিলো। প্রাচীন প্রস্তরযুগটি ছিল প্রস্তরযুগের প্রথম পর্যায়।
নিম্নে প্রাচীন প্রস্তরযুগের সমাজ ও সংস্কৃতি সম্পর্কে আলোচনা করা হল :
ক) খাদ্য: প্রাচীন প্রস্তরযুগের মানুষ ছিল খাদ্য-সংগ্রহকারী। শিকার ও খাদ্য আহরণের দ্বারা মানুষ ক্ষুন্নিবৃত্তি নিবারণ করত । খাদ্যতালিকায় ছিল ফলমূল, লতাগুল্ম, শাক-সবজি, পাখির ডিম, কীট-পতঙ্গ, ছোট বড় জীবজন্তুর মাংস, শামুক, ঝিনুকসহ জলজ অন্যান্য উদ্ভিদ ও প্রাণী ইত্যাদি।
খ) বাসস্থান: পুরোপলীয় যুগে দীর্ঘদিন মানুষ গাছের ডালে, গাছের কোটরে, পাহাড়ের গুহায়, মাটির গর্ত প্রভৃতি স্থানে বসবাস করত। পরবর্তীতে তারা ঘরবাড়ি বানানোর কৌশল আয়ত্ত করে।
গ) বস্ত্র ও অলঙ্কার: পুরোপলীয় যুগের মানুষ প্রথমদিকে জীবজন্তুর মতো উলঙ্গ থাকত। পরবর্তীতে তারা গাছের পাতা, ছাল-বাকল ইত্যাদি লজ্জা-নিবারণে ব্যবহার করত। শেষ পর্যায়ে এসে পশুর চামড়া ও লোম দিয়ে পোশাক তৈরি করত। নারী-পুরুষ নির্বিশেষে গহনা ব্যবহারের প্রচলন ছিল।
ঘ) হাতিয়ার: প্রাচীন প্রস্তরযুগের মানুষ বিভিন্ন ধরনের হাতিয়ার তৈরি করত। পাথরের পাশপাশি বাঁশ, গাছের ডাল, পশুর হাড়, দাঁত, শিং ইত্যাদি দিয়েও হাতিয়ার তৈরি করা হত ।
ঙ) সমাজ জীবন: প্রাকৃতিক বৈরিতা এবং শ্বাপদসংকুল পরিবেশে আত্মরক্ষার প্রয়োজনে মানুষ প্রাচীন প্রস্তর যুগেই যূথবদ্ধ জীবন-যাপন শুরু করে। পরিবার ও সমাজের নেতৃত্ব বিষয়ে বিতর্ক থাকলেও অনেকেই মনে করেন যে তখন পরিবার ও সমাজের নেতৃত্ব নারীদের ওপর ন্যস্ত ছিল।
চ) ধর্ম: প্রাকৃতিক বৈরিতা থেকে মুক্তি, শিকারি জীবনকে সফল করা, আত্মরক্ষা, পূর্বপুরুষের কৃপালাভ প্রভৃতি কারণে এ যুগের মানুষ অদৃশ্য শক্তির সাহায্য প্রার্থনা করত। এভাবে তাদের মনে একটা ধর্মীয় অনুভূতির জন্ম হয়। সমাজবিজ্ঞানী ডুর্খেইম (Durkheim) আদিম ধর্মীয় বিশ্বাসকে টোটেম (Totem) বলে অভিহিত করেছেন ।
ছ) চিত্র/শিল্পকলা: প্রাচীন প্রস্তযুগের মানুষ গুহার ভিতরে চিত্রকলার মাধ্যমে তাদের শিকারি জীবন, শিকার প্রাণী শিকারের দৃশ্য, ব্যবহৃত হাতিয়ারাদি, বসন-ভূষণ, জীবনযাপন পদ্ধতি, সংস্কৃতিবোধ, শিল্পবোধ, জাদুবিশ্বাস, ধর্মীয় চেতনা, দার্শনিক চিন্তা ইত্যাদি চিত্রকলা ফুটিয়ে তুলেছে।
জ) আবিষ্কার: প্রস্তরযুগেই মানুষ আগুন আবিষ্কার করেছিল। তারা আগুনের ব্যবহার জানত এবং তা সংরক্ষণ করতে পারতো।
ঝ) শ্রম বিভাজন: প্রাচীন প্রস্তরযুগে খাদ্য সংগ্রহ কর্মকান্ডে শ্রমবিভাগের সূত্রপাত হয় বলে অনেক পন্ডিত মনে করেন। এসময় মেয়েরা ফলমূল সংগ্রহ, পুরুষেরা শিকার করতো। অল্পবয়সীরা ছোটখাটো জীবজন্তু ও মাছ শিকার এবং বয়স্কদের কাজে যথাসম্ভব সহযোগিতা করত। বৃদ্ধরা অস্ত্র তৈরি ও বুদ্ধি-পরামর্শ দিয়ে সহায়তা দিত। তৎকালীন সমাজে শ্রমভেদ থেকেই সামাজিক স্তরভেদের জন্ম হয় ।
0 মন্তব্য(গুলি):
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
Comment below if you have any questions