Home » » সাম্যবাদী কবিতা - কাজী নজরুল ইসলাম

সাম্যবাদী কবিতা - কাজী নজরুল ইসলাম

সাম্যবাদী কবিতা

ভুমিকা:

কাজী নজরুল ইসলাম রচিত সাম্যবাদী কবিতাটি আবদুল কাদির সম্পাদিত বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত ‘নজরুল রচনাবলি’র প্রথম খ- থেকে সংকলিত হয়েছে। ১৯২৫ খ্রিষ্টাব্দে প্রকাশিত ‘সাম্যবাদী’ কাব্যের অমত্মর্ভুক্ত এ কবিতাটি বৈষম্যহীন অসাম্প্রদায়িক মানব সমাজ গঠনের প্রত্যাশায় রচিত হয়েছে। ধর্ম-বর্ণ-গোষ্ঠীর দোহাই দিয়ে মানুষে মানুষে বিভেদকে ভুলে কবি মানবতার মর্মবাণীকে সকলের মাঝে ছড়িয়ে দিতে আহবান জানিয়েছেন এই কবিতায়।

কবিতা

সাম্যবাদী
কাজী নজরুল ইসলাম

গাহি সাম্যের গান-
যেখানে আসিয়া এক হয়ে গেছে সব বাধা-ব্যবধান,
যেখানে মিশেছে হিন্দু-বৌদ্ধ-মুসলিম ক্রিশ্চান।
গাহি সাম্যের গান!
কে তুমি?- পার্সি? জৈন? ইহুদি? সাঁওতাল, ভীল, গারো?
কন্ফুসিয়াস্? চার্বাক- চেলা? বলে যাও, বল আরও!
বন্ধু, যা খুশি হও,
পেটে-পিঠে, কাঁধে-মগজে যা-খুশি পুঁথি ও কেতাব বও,
কোরান-পুরাণ-বেদ-বেদামত্ম-বাইবেল-ত্রিপিটক-
জেন্দাবেস্তা-গ্রন্থ-সাহেব পড়ে যাও যত সখ,-
কিন্তু কেন এ প-শ্রম, মগজে হানিছ শূল?
দোকানে কেন এ দর-কষাকষি?- পথে ফোটে তাজা ফুল!
তোমাতে রয়েছে সকল কেতাব সকল কালের জ্ঞান,
সকল শাস্ত্র খুঁজে পাবে সখা খুলে দেখ নিজ প্রাণ!
তোমাতে রয়েছে সকল ধর্ম, সকল যুগাবতার,
তোমার হৃদয় বিশব-দেউল সকলের দেবতার।
কেন খুঁজে ফের দেবতা-ঠাকুর মৃত-পুথি-কঙ্কালে?
হাসিছেন তিনি অমৃত-হিয়ার নিভৃত অমত্মরালে!
বন্ধু, বলিনি ঝুট,
এইখানে এসে লুটাইয়া পড়ে সকল রাজমুকুট
এই হৃদয়ই সে নীলাচল, কাশী, মথুরা, বৃন্দাবন,
বুদ্ধ-গয়া এ, জেরুজালেম এ, মদিনা, কাবা-ভবন,
মসজিদ এই, মন্দির এই, গির্জা এই হৃদয়,
এইখানে বসে ঈসা মুসা পেল সত্যের পরিচয়।
এই রণ-ভূমে বাঁশির কিশোর গাহিলেন মহা-গীতা,
এই মাঠে হলো মেষের রাখাল নবিরা খোদার মিতা।
এই হৃদয়ের ধ্যান-গুহা মাঝে বসিয়া শাক্যমুনি
ত্যজিল রাজ্য মানবের মহা-বেদনার ডাক শুনি।
এই কন্দরে আরব-দুলাল শুনিতেন আহবান,
এইখানে বসি গাহিলেন তিনি কোরানের সাম-গান!
মিথ্যা শুনিনি ভাই,
এই হৃদয়ের চেয়ে বড়ো কোনো মন্দির-কাবা নাই।


সারসংক্ষেপ

এই কবিতায় কাজী নজরুল ইসলাম বৈষম্যহীন অসাম্প্রদায়িক মানবসমাজ প্রতিষ্ঠার কথা বলেছেন। কবির বিশ্বাস মানুষ হিসেবে স্বীকৃতি পেয়ে পরিচিত হয়ে ওঠা সবচেয়ে সম্মানের। নজরুলের এ আদর্শ আজও প্রতিটি মানুষের জীবনপথের প্রেরণা। কিন্তু মানুষ সম্প্রদায়কে ব্যবহার করে রাজনীতি করে, দুর্বলকে শোষণ করে, এখনও একের বিরুদ্ধে অন্যকে উস্কে দেয়। এক জনের প্রতি অন্য জনকে বিমুখ করার ষড়যন্ত্র করে। নজরুল এ কবিতায় বলেছেন- ‘‘মানুষেরই মাঝে স্বর্গনরক মানুষেতে সুরাসুর।’’ নজরুল জোর দেন অমত্মর ধর্মের ওপর। ধর্মগ্রন্থ পড়ে অর্জিত জ্ঞান যথার্থভাবে উপলব্ধি করতে প্রয়োজন মানবিকতাবোধ। কবি বলেছেন মানুষের হৃদয়ের চেয়ে শ্রেষ্ঠ কোন মন্দির কাবা নেই। কবি সকল মত, সকল পথের উপরে স্থান দিয়েছেন মানবিকতা। হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান, মুসলিম সকলকে একই মায়ের সমত্মানের মতো ভেবেছেন। নজরুল মানবিক মেলবন্ধনের জন্য সংগীত রচনা করেছেন। বাণী ও সুরের মাধ্যমে মানবতার সুবাস ছড়ানোর চেষ্টা করেছেন। নজরুল ‘সাম্যবাদী’ কবিতায় মন্দির, মসজিদ, গির্জা বা অন্যান্য তীর্থক্ষেত্রের মতো পবিত্র মনে করেছেন মানুষের হৃদয়কে। এ হৃদয় যদি পবিত্র থাকে, হৃদয়ে যদি কারো প্রতি হিংসা, বিদ্বেষ না থাকে, সকলের প্রতি সমদর্শিতা থাকে তাহলে পৃথিবী হবে সুখের আবাসস্থল। সাম্যবাদ মানে জাতি, ধর্ম, বর্ণ বির্বিশেষে রাষ্ট্রের সকল মানুষের সমান অধিকার থাকা উচিত এ মতবাদ। কাজী নজরুল ইসলাম তাঁর ‘সাম্যবাদী’ কবিতায় সব ধরনের মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠিত করার জন্য সাম্যবাদের বাণী প্রচার করেছেন।

নির্বাচিত শব্দের অর্থ ও টীকা

আরব-দুলাল- আরব সমত্মান। এখানে হযরত মুহম্মদ (স) কে বোঝানো হয়েছে। ইহুদি- প্রাচীন হিব্রম্ন বা জু-জাতি ও ধর্ম- সম্প্রদায়ের মানুষ। কন্ফুসিয়াস- চিন দেশের একজন প্রখ্যাত দার্শনিক। এখানে তাঁর অনুসারীদের বোঝানো হয়েছে। কন্দরে-পর্বতের গুহা, হৃদয়ের গভীর গোপন স্থান। কোরানের সাম্য-গান- পবিত্র কোরানের সাম্যের বাণী। কাশী, মথুরা, বৃন্দাবন, গয়া- হিন্দুদের পবিত্র ধর্মীয় কয়েকটি স্থান। গারো- গারো পর্বত অঞ্চলের অধিবাসী ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীবিশেষ। চার্বাক- একজন বস্ত্তবাদী দার্শনিক ও মুনি। তিনি বেদ, আত্মা, পরলোক ইত্যাদিতে আস্থাশীল ছিলেন। জেরুজালেম-বায়তুল-মোকাদ্দস। ফিলিসিত্মনে অবস্থিত এই স্থানটি মুসলমান, খ্রিষ্টান ও ইহুদিদের নিকট সমভাবে পুণ্যস্থান। জেন্দাবেস্তা- পারস্যের অগ্নি উপাসকদের ধর্মগ্রন্থ আবেস্তা এবং তার ভাষা জেন্দা। জৈন- জিন বা মহাবীর প্রতিষ্ঠিত ধর্মমতাবলম্বী সম্প্রদায়। ঝুট- মিথ্যা। দেউল- দেবালয়, মন্দির। নীলাচল- জগন্নাথক্ষেত্র, নীলবর্ণযুক্ত পাহাড়। যে বিশাল পাহাড়ের পরিসীমা নির্ধারণ করা যায় না। পার্সি- পারস্যদেশের বা ইরানের নাগরিক। বাঁশির কিশোর গাহিলেন মহা-গীতা- হিন্দুধর্মের অবতার শ্রীকৃষ্ণের মুখনিঃসৃত বাণীই শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা। মসজিদ এই, মন্দির এই, গির্জা এই হৃদয়- মানুষের হৃদয়ই মসজিদ, মন্দিও, গির্জা বা অন্যান্য তীর্থক্ষেত্রের মতো পবিত্র। যুগাবতার- বিভিন্ন যুগে অবতীর্ণ মহাপুরুষ। শাক্যমুনি- শাকবংশে জনম যার, বুদ্ধদেব। সাম্য- সমদর্শিতা, সমতা। সাম্যবাদ- জাতি ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে রাষ্ট্রের সকল মানুষের সমান অধিকার থাকা উচিত এই মতবাদ। সাঁওতাল, ভীল- ভারতীয় উপমহাদেশের আদিম নৃগোষ্ঠীবিশেষ। সকল শাস্ত্র খুঁজে পাবে সখা খুলে দেখ দেখ নিজ প্রাণ- ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের প্রধান ধর্মগ্রন্থ কোরান শরিফ, হিন্দুদের বেদ, খ্রিষ্টান সম্প্রদায়ের বাইবেল- এভাবে পৃথিবীর নানাজাতির নানা ধর্মগ্রন্থ। কবি এখানে বলতে চেয়েছেন সকল ধর্মগ্রন্থের মূলমন্ত্র মানুষের হৃদয়ের মধ্যেই সংকলিত আছে তা হচ্ছে মানবতাবোধ, সমতার দৃষ্টিভঙ্গি। হিয়া- হৃদয়।

কবি পরিচিতি:

কাজী নজরুল ইসলাম ১৮৯৯ সালের ২৫ মে (বাংলা ১৩০৬ সালের ১১ জ্যৈষ্ঠ) পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার আসানসোল মহকুমার চুরুলিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর ডাক নাম দুখু মিয়া। তাঁর পিতার নাম কাজী ফকির আহমদ এবং মাতার নাম জাহেদা খাতুন। নজরুল অল্প বয়সেই পিতামাতা দুজনকেই হারান। শৈশব থেকেই দারিদ্র্য আর দুঃখ-কষ্ট ছিল তাঁর নিত্যসঙ্গী। স্কুলের ধরাবাঁধা জীবনে কখনোই তিনি আকৃষ্ট হননি। বারো বছর বয়সে তিনি লেটো গানের দলে যোগ দেন ও পালাগান লেখেন। পরে বর্ধমানে ও ময়মনসিংহের ত্রিশাল থানার দরিরামপুর হাইস্কুলে লেখাপড়া করেন। ১৯১৪ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে ১৯১৭ সালে ৪৯ নং বাঙালি পল্টনে যোগ দিয়ে করাচি যান। যুদ্ধশেষে নজরুল কলকাতায় ফিরে আসেন ও সাহিত্যসাধনায় মনোনিবেশ করেন। তিনি কিছুদিন মসজিদে ইমামতিও করেন। সাপ্তাহিক বিজলি পত্রিকায় ‘বিদ্রোহী’ কবিতা প্রকাশের পর সাহিত্যক্ষেত্রে তিনি বিদ্রোহী কবি হিসেবে পরিচিত হন। তাঁর লেখায় তিনি বিদেশি শাসক, সামাজিক অবিচার ও অন্যায়-অত্যাচারের বিরুদ্ধে বলিষ্ঠ কণ্ঠে প্রতিবাদ জানিয়েছেন। নজরুল সাহিত্য রচনা ছাড়াও কয়েক হাজার গানের রচয়িতা। তিনি বেশ কয়েকটি পত্রিকাও সম্পাদনা করেন। তিনি গজল, খেয়াল ও রাগপ্রধান গান রচনা করে খ্যাতি অর্জন করেন। আরবি-ফারসি শব্দের সার্থক ব্যবহার তাঁর কবিতাকে বিশিষ্টতা দান করেছে। তিনি রবীন্দ্রনাথের তৈরি করা পথে না চলে স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যে নিজেকে বিকশিত করেছেন। সাহিত্যে এনেছেন সাম্যবাদ ও অসাম্প্রদায়িক চেতনা। গল্প, উপন্যাস, নাটক ও প্রবন্ধ রচনায়ও তিনি কুশলতার পরিচয় দিয়েছেন। সম্পাদক এবং সমালোচক হিসেবেও নজরুল খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। তিনি মূলত যৌবনের কবি। যৌবনের ধর্মই হল একদিকে যেমন বিদ্রোহ এবং প্রতিবাদ, অন্যদিকে প্রেম। এ দুটো অনুভূতিরই সূচনা হয় আবেগের প্রাবল্য থেকে। নজরুলের ভাষণ, সম্পাদকীয়, সমালোচনা, প্রবন্ধ, উপন্যাস, ছোটগল্প প্রতিটি ক্ষেত্রই ভাষার কাব্যিক ব্যঞ্জনা এবং বলিষ্ঠতায় পূর্ণ। তিনি দৈনিক নবযুগ, ধূমকেতু ও লাঙল পত্রিকায় সম্পাদকের কাজ করেছেন। মাত্র তেতালিস্নশ বছর বয়সে দুরারোগ্য রোগে আক্রামত্ম হয়ে বাকশক্তি হারিয়ে ফেলেন। ১৯৭২ সালে কবিকে ঢাকায় আনা হয় এবং তাঁকে বাংলাদেশের নাগরিকতব প্রদান করে জাতীয় কবির মর্যাদায় অভিষিক্ত করা হয়। কবিকে ঢাকা ও রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয় ডিলিট, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় ‘জগত্তারিণী স্বর্ণপদক’, ভারত সরকার ‘পদ্মভূষণ’ ও বাংলাদেশ সরকার ‘একুশে পদক’ প্রদান করে। ১৯৭৬ সালের ২৯ আগস্ট তিনি মৃত্যুবরণ করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মসজিদ প্রাঙ্গণে তাঁকে পূর্ণ রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় সমাহিত করা হয়।

নজরুলের প্রধান সাহিত্যকর্ম :

অগ্নিবীণা (১৯২২), বিষের বাঁশী (১৯২৪), ছায়ানট (১৯২৪), সাম্যবাদী (১৯২৫), সর্বহারা
(১৯২৬), সিন্ধু-হিন্দোল (১৯২৭), চক্রবাক (১৯২৯), ফণি-মনসা (১৯২৯), প্রলয়-শিখা (১৯৩০);
: বাঁধনহারা (১৯২৭), মৃত্যুক্ষুধা (১৯৩০), কুহেলিকা (১৯৩১);
: ব্যথার দান (১৯২২), রিক্তের বেদন (১৯২৫), শিউলিমালা (১৯৩১);
: যুগবাণী (১৯২২), রাজবন্দীর জবানবন্দী (১৯২৩), দুর্দিনের যাত্রী (১৯২৬), রুদ্রমঙ্গল (১৯২৬)।

0মন্তব্য(গুলি):

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Comment below if you have any questions

Basic Computer Course

MS Word
MS Excel
MS PowerPoint
Bangla Typing, English Typing
Email and Internet

Duration: 2 months (4 days a week)
Sun+Mon+Tue+Wed

Course Fee: 4,500/-

Graphic Design Course

Adobe Photoshop
Adobe Illustrator

Duration: 3 months (2 days a week)
Fri+Sat

Course Fee: 9,000/-

Web Design Course

HTML 5
CSS 3

Duration: 3 months (2 days a week)
Fri+Sat

Course Fee: 8,500/-

Digital Marketing Course

Facebook, YouTube, Instagram, SEO, Google Ads, Email Marketing

Duration: 3 months (2 days a week)
Fri+Sat

Course Fee: 15,000/-

Class Time

Morning to Noon

1st Batch: 08:00-09:30 AM

2nd Batch: 09:30-11:00 AM

3rd Batch: 11:00-12:30 PM

4th Batch: 12:30-02:00 PM

Afternoon to Night

5th Batch: 04:00-05:30 PM

6th Batch: 05:30-07:00 PM

7th Batch: 07:00-08:30 PM

8th Batch: 08:30-10:00 PM

Contact:

Alamin Computer Training Center

796, West Kazipara Bus Stand,

West side of Metro Rail Pillar No. 288

Kazipara, Mirpur, Dhaka-1216

Mobile: 01785 474 006

Email: alamincomputer1216@gmail.com

Facebook: www.facebook.com/ac01785474006

Blog: alamincomputertc.blogspot.com

Contact form

নাম

ইমেল*

বার্তা*

-->