Home » » গ্রীক সভ্যতা

গ্রীক সভ্যতা

গ্রীক সভ্যতা

গ্রিক সভ্যতার উৎপত্তি স্থল 

ইউরোপ মহাদেশের গ্রিক রাষ্ট্রের অন্তর্গত প্রাচীন কয়েকটি শহরকে কেন্দ্র করে গ্রিক সভ্যতার উদ্ভব ঘটে। বলকান উপকূলের দক্ষিণাংশে অবস্থিত গ্রিক প্রায় পাঁচ হাজার বর্গমাইল। ব্যাপী বিস্তৃত। ভূ-প্রকৃতিই দেশটিকে তিন ভাগে বিভক্ত করে দিয়েছে; দক্ষিণ গ্রিস, মধ্য গ্রিস ও উত্তর গ্রিস। মেসিডোনিয়ান অধিপতি। আলেকজাণ্ডারের শাসনামলে এ সভ্যতার সীমা ছাড়িয়ে আধুনিক মিসর, ইসরাইল, প্যালেষ্টাইন, লেবানন, সিরিয়া, ইরাক ও ইরান হয়ে ভারতবর্ষ পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছিল। আড্রিয়াটিক সাগর, ভূমধ্যসাগর, ইজিয়ান সাগর দ্বারা বেষ্টিত থাকার কারণে গ্রিক সভ্যতাকে ‘ওসেনিয়ান' (সাগরীয়) সভ্যতা বলা হয়। অপরদিকে মিসর, ব্যাবিলন সভ্যতা ছিল। নদীকেন্দ্রিক সভ্যতা।


গ্রিকদের রাজনৈতিক ইতিহাস

প্রাচীন গ্রিক সমাজের বিশেষত্ব দাসপ্রথা, গ্রিকদের আগে আর কোন সমাজই দাসত্বের বুনিয়াদের উপর গড়ে ওঠে নাই। গ্রিকদের আদি বাসস্থান গ্রিসে নয়। গ্রিসে আসার পূর্বে তারা থিসালি ও এপিরাসে বাস করত। গ্রিক সভ্যতার সূচনাকাল থেকে পতন পর্যন্ত এর রাজনৈতিক অবস্থা পর্যালোচনা করে, এ সভ্যতাকে ২টি ভাগে ভাগ করে আলোচনা করা যায়। যথা: ১. হেলেনিক যুগ, ২. হেলেনিস্টিক যুগ। 


হেলেনিক সভ্যতা 

গ্রিক সভ্যতায় দুটি স্তর লক্ষ্য করা যায়। প্রথম স্তর হেলেনিক সভ্যতা এবং দ্বিতীয় স্তরে হেলেনিস্টিক সভ্যতা। গ্রিকরা তাদের ‘হেলাস' বলতো। তাই গ্রীক সভ্যতার উন্মেষ বা আদিপর্ব হেলেনিক যুগ। কেবল গ্রিক উপদ্বীপ কেন্দ্রিক এই সভ্যতার প্রধান কেন্দ্র বিন্দু ছিল এথেন্স। খ্রিস্টপূর্ব ২০০০ থেকে ৩৩৬ অব্দ পর্যন্ত হেলেনিক যুগ বিদ্যমান ছিল। অতঃপর রাজা ফিলিপ কর্তৃক মেসিডোনিয়া কেন্দ্রিক নতুন সভ্যতা গড়ে ওঠে। রাজা ফিলিপের পুত্র আলেকজান্ডারের নেতৃত্বে গ্রিকরা ইউরোপ, আফ্রিকা ও এশিয়াব্যাপী বিশাল সাম্রাজ্য গড়ে তোলে। গ্রিক শিক্ষা-সংস্কৃতির সঙ্গে বাইরের সংস্কৃতির মিশ্রণ ঘটিয়ে পরবর্তীতে যে সভ্যতার সৃষ্টি হয় তা-ই হেলেনিস্টিক যুগের সভ্যতা। হলাস’ 


গ্রীক সভ্যতায় হোমারিক যুগ (১২০০-৮০০ খ্রি :) 

গ্রিক সভ্যতার ক্রমবিকাশে আদিকালকে ‘হোমারিক যুগ বলা হয়। গ্রিক কবি হোমারের নাম থেকে এ যুগের নামকরণ করা হয়। খ্রিস্টপূর্ব ১২০০ থেকে ৮০০ অব্দ পর্যন্ত এই যুগের বিস্তৃতি। বিখ্যাত কবি হোমার ‘ইলিয়ড' এবং ‘ওডিসি' নামে দুটি মহাকাব্য রচনা করেন। তার রচনাবলী থেকে গ্রিক ইতিহাস, ভূগোল, সাহিত্য, লোক ঐতিহ্যের সন্ধান পাওয়া যায়। হোমারিক যুগে সমগ্র গ্রিস ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র গ্রামীণ সংস্থায় (Village/Rural Community) বিভক্ত ছিল এবং স্বাধীন ভাবে পরিচালিত হতো।


গ্রীক সভ্যতায় নগর রাষ্ট্রের ক্রমবিকাশ ও গণতান্ত্রিক এথেন্স 

খ্রিস্টপূর্ব ৮০০ অব্দের দিকে হোমারিক যুগের অবসান ঘটে। হোমারিক যুগের গ্রাম সম্প্রদায়গুলি ভেঙ্গে কালক্রমে নগর রাষ্ট্রের সৃষ্টি হয়। এথেন্স, থিস, মেগারা, স্পার্টা এবং করিন্থ প্রভৃতি নগরীকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছিল এসব ক্ষুদ্র রাষ্ট্র। এগুলির মধ্যে এথেন্স ছিল সম্পূর্ণ গণতান্ত্রিক ও প্রগতিশীল চিন্তাচেতনার ধারক বাহক। এথেন্সই ছিল গ্রিসের অর্থনৈতিক সাংস্কৃতিক কেন্দ্র। ৫৯৪ খ্রিস্টপূর্বাব্দে সোলন নামক একজন সংস্কারক এথেন্সের সামাজিক ও রাজনৈতিক সংস্কার সাধন  করেন। তাঁর পদক্ষেপসমূহ (১) ৪০০ সদস্যবিশিষ্ট একটি কাউন্সিল গঠন, (২) সংসদ বা সাধারণ পরিষদে নিম্ন শ্রেণীর অন্তর্ভুক্তি, (৩) জনগণের দ্বারা নির্বাচিত একটি সুপ্রীম কোর্ট গঠন। এছাড়া প্রশাসন ও ভূমি সংস্কারের ক্ষেত্রে তিনি অবদান রাখেন। এই সংস্কারের ফলে এথেন্সের রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক ক্ষেত্রে গণতন্ত্র সুপ্রতিষ্ঠিত হয়।


গ্রীক সভ্যতায় ক্লিথিনিস

খ্রিস্টপূর্ব ১৫০ অব্দে ক্লিথিনিস জনগণের সহায়তায় এথেন্সের ক্ষমতায় আসেন। তিনি এথেন্সের গণতন্ত্রের প্রতিভূ (Father of Athenian Democracy) হিসেবে পরিচিত ছিলেন। এ সময়ে পারস্য কর্তৃক গ্রিস আক্রান্ত হয় এবং দীর্ঘ দিন গ্রিকপারস্য যুদ্ধ অব্যাহত থাকে।


গ্রিক-পারস্য যুদ্ধ

পারস্যের অ্যাকামেনীয় সম্রাট ছিলেন বিখ্যাত সাইরাস। তিনি প্রথমে গ্রিক অভিযান করেন এবং নগর রাষ্ট্র সমূহের ওপর ধ্বংসলীলা চালান। সাইরাসের পর পারস্য সম্রাট দারিয়ুস গ্রিক আক্রমণ করে। খ্রিস্টপূর্ব ৪৯০ অব্দে ম্যারাথন নামক স্থানে সংঘটিত যুদ্ধে গ্রিকরা পারস্য বাহিনীকে পরাজিত ও বিতাড়িত করে। উল্লেখ এ যুদ্ধের ঘটনাকে স্মরণ করে পরবর্তীতে ম্যারাথন দৌড় প্রতিযোগিতার উদ্ভব হয়। প্রতি ৪ বছর অন্তর অনুষ্ঠিত এ খেলায় বিভিন্ন নগররাষ্ট্রের খেলোয়াড়রা অংশ গ্রহণ করত। ফলে এ খেলার সূত্র ধরে পারস্পরিক শত্রুতা অপসারিত হয়ে গ্রিকদের মধ্যে একটি সাংস্কৃতিক ঐক্য গড়ে ওঠে। ম্যারাথনে পরাজয়ের পর দারিয়ুসের পুত্র জারেক্সস খ্রিস্টপূর্ব ৪৮০ অব্দে গ্রিক যুদ্ধ অভিযান পরিচালনা করেন। কিন্তু থার্মোপলীর যুদ্ধে পারস্য বাহিনী আবার পরাজিত হয়। গ্রিকদের বিজয়ের ফলে গ্রিক গণতন্ত্র আরো সুদৃঢ় হয় এবং গ্রিসের  মূলভুখণ্ড থেকে এশিয়া মাইনর পর্যন্ত গ্রিক গণতন্ত্র ছড়িয়ে পড়ে। গ্রিক গণতন্ত্র পৃথিবীর ইতিহাসে আজও স্বরণীয়।


গ্রীক সভ্যতায় পেরিক্লিসের যুগ

দেশাত্মবোধে উজ্জিবিত গ্রিকরা এথেন্সের নেতৃত্বে এক সমৃদ্ধিশালী গণতান্ত্রিক সমাজ ও রাষ্ট্র ব্যবস্থা গড়ে তোলে। এই বিকশিত গণতন্ত্র ও সমাজকে আরো চূড়ান্ত শিখরে তোলেন বিখ্যাত পেরিক্লিস। তাঁর সময়ে (খ্রি: পূর্ব ৪৬১-৪২৯) সমগ্র গ্রিসের গণতন্ত্র, স্থাপত্যকলা ও জ্ঞান বিজ্ঞানের চরম বিকাশ লাভ করে। এই কারণে তার সময়কালে পেরিক্লিসের যুগ বলা হয়। পেরিক্লিসের সময়ে নাট্যকার সোফোক্লিস, দার্শনিক এনাক্সগোরাস, নাট্যকার ইউরিপিডিস রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করেন।


হেলেনিক সভ্যতার পতন 

খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চম শতাব্দীতে গ্রিসের দুটি শক্তিশালী নগর রাষ্ট্র এথেন্স ও স্পার্টার মধ্যে বিরোধ দেখা দেয়। এ সময় স্পার্টা নগর রাষ্ট্রটি বরাবরই সামরিকতন্ত্রের ওপর প্রতিষ্ঠিত ছিল। উভয় রাষ্ট্রের মধ্যে যে যুদ্ধ হয় তা ইতিহাসে পেলোপনেসীয় যুদ্ধ (খ্রিস্টপূর্ব ৪৩১-৪০৪ খ্রিস্টপূর্বাব্দ) বলে খ্যাত। এই যুদ্ধে এথেন্সের পতন ঘটে এবং স্পার্টা এথেন্স দখল করে নেয়। যার ফলে হেলেনিক সভ্যতারও পতন ঘটে। 


গ্রীক সভ্যতায় হেলেনিস্টিক যুগ 

আলেকজান্ডারের সাম্রাজ্য 

খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে উত্তর গ্রিসের মেসিডোনীয় রাজ্য শক্তিশালী হয়ে ওঠে। মেসিডোনীয় রাজা ফিলিপ, এথেন্সসহ সমগ্র গ্রিক রাজ্যের ওপর আধিপত্য বিস্তার করেন। রাজা ফিলিপের পর তাঁর সুযোগ্য পুত্র আলেকজান্ডারের নেতৃত্বে ইউরোপসহ শক্তিশালী পারস্য সাম্রাজ্য অধিকৃত হয়। আলেকজান্ডার এখন পারস্য,  মেসোপটেমিয়া, মিশর, সিরিয়া ও প্যালেস্টাইনের সম্রাট। ফলে গ্রিক সভ্যতা ও সংস্কৃতিতে প্রাচ্য সংস্কৃতির সংমিশ্রণে এক নতুন যুগের সূচনা হয়। মিসরের আলেকজান্দ্রিয়া নগরী ছিল এই সভ্যতা ও সংস্কৃতির লীলাভূমি। তাই এই সভ্যতা ও সংস্কৃতি আলেকজান্দ্রিয়ান বা হেলেনিস্টিক সভ্যতা বলে পরিচিত।


গ্রীক সভ্যতায় দর্শন ও সংস্কৃতি 

পৃথিবী ব্যাপী সভ্যতার ইতিহাসে গ্রীক দর্শন গোটা বিশ্বের দর্শন ও সভ্যতাকে প্রভাবিত করেছে। অদ্যাবধি জ্ঞানের জগতে যে সকল গ্রিক কবি দার্শনিক জ্ঞানের আলোক বর্তিকা বিতরণ করেছেন তাদের মধ্যে বিশ্ব বিখ্যাত শিক্ষাগুরু সক্রেটিস।

সক্রেটিস এর ছাত্র প্লেটো ও প্লেটো এর ছাত্র এ্যারিস্টটল বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। গ্রিক দার্শনিকদের যুক্তি, ব্যাখ্যা ও দর্শন জগতকে সমৃদ্ধিশালী করে। এই সকল যুক্তিবাদী দার্শনিককে সফিস্ট বলা হয়। গ্রিক দর্শনে অন্যতম দার্শনিক সক্রেটিস নিজের সত্য প্রকাশে অনড় থেকে শাসকের নির্দেশে বিষপান করে মৃত্যুবরণ করেন। তার বিখ্যাত উক্তি নিজেকে। জানো' (Know Thyself)। তাঁর শিষ্য প্লেটো এবং প্লেটো শিষ্য এ্যারিস্টটলের সর্বকালের বিখ্যাত দার্শনিক ছিলেন। প্লেটো বারো বছর বিভিন্ন দেশে ভ্রমণ শেষে দেশে ফিরে ‘একাডেমি' নামে একটি উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। শিক্ষাগুরু প্লেটোর সাথে জ্ঞানের  ক্ষেত্রে মতের কিছুটা অমিল ঘটলে এ্যারিস্টটল নিজেই ‘লাইসিয়াম’ নামক একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করেন। প্লেটোর বিখ্যাত গ্রন্থ সিম্পোজিয়াম, রিপাবলিক এবং লজ প্রভৃতি। এ্যারিস্টটলের বিখ্যাত গ্রন্থ লজিক, ফিজিক্স এবং পলিটিক্স প্রভৃতি। এ্যারিস্টটলের ‘পলিটিক্স' (Politics) গ্রন্থে রাজনীতি, গণতন্ত্র ইত্যাদি বিষয়ে মতামত তুলে ধরা হয়েছে। প্লেটোর বিখ্যাত গ্রন্থ ‘দি রিপাবলিক'। আর বিশ্ববিজেতা আলেকজান্ডার নিজেও একজন দার্শনিক ও জ্ঞানী ব্যক্তি ছিলেন। তাঁর শিক্ষক ছিলেন দার্শনিক প্লেটো।


গ্রীক সভ্যতায় সাহিত্য 

হোমারিক যুগে গ্রিক সাহিত্যের চূড়ান্ত বিকাশ ঘটে। যদিও হোমারের সাহিত্য নিয়ে পূর্বে আলোচনা হয়েছে। হোমারের মহাকাব্য ‘ইলিয়াড ও ওডিসি'তে গ্রিকদের বীরত্বের কাহিনী। বর্ণিত হয়েছে। হোমারিকযুগের পরে গ্রিক সমাজে গীতিকাব্য ও শোক গাথার আবির্ভাব ঘটে। এ সকল শোক গাথায় ব্যক্তিগত প্রণয়কাহিনীর বিবরণ রয়েছে। সোলোন ছিলেন একজন বিখ্যাত গীতি কাব্য রচয়িতা। এছাড়া বিখ্যাত নাট্যকার ছিলেন এসকাইলাস, সোফোক্লিস, ইউরিপিডিস। প্রমুখ।


গ্রীক সভ্যতায় ইতিহাস

ইতিহাসের জনক ছিলেন গ্রিসের বিখ্যাত ঐতিহাসিক হিরোডোটাস (৪৮৪-৪২৫ খ্রি:পূর্ব)। ইতিহাস শব্দের ইংরেজী  প্রতিশব্দ ‘হিস্ট্রি' শব্দটি গ্রিক ভাষার শব্দ। তিনি মিসর, পারস্য ও ইতালি ভ্রমণ করে ইতিহাসের বিভিন্ন উপাদান ও তথ্য সংগ্রহ করেন। এছাড়া জেনোফার নামে এক ব্যক্তি ইতিহাস সংগ্রহে খ্যাতি অর্জন করেন। 


গ্রীক সভ্যতায় বিজ্ঞান 

বিজ্ঞান সাধনায় হেলেনিস্টিক যুগেও অসাধারণ উৎকর্ষ সাধিত হয়। সে সময়ে ইতিহাস গবেষণায় পলিবিয়াস, জ্যোর্তিবিদ্যায় এ্যারিস্টটল ও হিপারকাস, গণিতে বিখ্যাত পিথাগোরাস ও ইউক্লিড প্রমুখ মনিষীগণ জ্ঞান বিজ্ঞানের চর্চায় খ্যাতি অর্জন করেছিলেন।

পরিশেষে বলা যায়, গ্রীক সভ্যতার বড় বৈশিষ্ট্য চিন্তার স্বাধীনতা। এ সময়ে মানুষের মধ্যে স্বাধীনতার প্রতি স্পৃহা জাগে এবং আত্মার উৎকর্ষতা বৃদ্ধি পায়। এছাড়া এ সভ্যতায় ধর্মীয় স্বাধীনতা অর্জিত হয়। পুরোহিতদের কজা থেকে মুক্তি পেয়ে মানুষ  নিজের বিবেক বুদ্ধি ও মননশীলতাকে প্রাধান্য দেয়।

0 comments:

Post a Comment

Comment below if you have any questions

Contact form

Name

Email *

Message *