Home » » সুলতান মাহমুদের ভারত অভিযান

সুলতান মাহমুদের ভারত অভিযান

সুলতান মাহমুদের ভারত অভিযান

সুলতান মাহমুদের অভিযানের কারণ

সুলতান মাহমুদ ছিলেন তুর্কি বংশোদ্ভূত। মুহম্মদ বিন কাসিমের সিন্ধু অভিযানের প্রায় তিনশ বছর পর গজনির সুলতান মাহমুদ ভারত অভিযান করেন। গজনি রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন আলপ্তগীন। আলপ্তগীনের ক্রীতদাস ও জামাতা গজনীর আমির সবুক্তগীনের পুত্র ছিলেন সুলতান মাহমুদ। এ রাজবংশটি ইসলামের ইতিহাসে ‘গজনি রাজবংশ' নামে পরিচিত। সবুক্তগীনের মৃত্যুর পর তাঁর কনিষ্ঠ পুত্র ইসমাইল সিংহাসনে বসেন। ইসমাইলকে পরাজিত ও কারারুদ্ধ করে মাহমুদ ক্ষমতা দখল করেন। তিনি আমির-এর পরিবর্তে সুলতান উপাধি ধারণ করেন। বাগদাদের খলিফা কাদির বিল্লাহ তাকে ‘ইয়ামিন-উদ-দৌলা’ ও ‘আমিন-উল-মিল্লাত' খেতাবে ভূষিত করেন। ১০০০ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১০২৭ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে তিনি সতেরো বার ভারত অভিযান করেন। তাঁর এই অভিযানের কারণগুলোকে চারটি ভাগে বিভক্ত করা যায় যথা: রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামরিক ও ধর্মীয়।


রাজনৈতিক কারণ

সুলতান মাহমুদের পিতা সবুক্তগীনের সময় থেকে গজনির সাথে পাঞ্জাবের হিন্দুশাহী বংশের বিরোধ চলছিল। পাঞ্জাবের হিন্দুশাহী রাজ্যের রাজা জয়পাল সবুক্তগীনের শত্রু হওয়ায় সুলতান মাহমুদ জয়পালের সাথে শত্রুতা উত্তরাধিকার সূত্রেই পেয়েছিলেন। ভারতের অনেক রাজা জয়পালের সাথে মাহমুদ বিরোধী জোটে যোগদান করেন। সুতরাং মাহমুদকে তাঁদের বিরুদ্ধেও অভিযান পরিচালনা করতে হয়। আবার ভারতের কোন কোন রাজা মাহমুদের সাথে বন্ধুত্ব সূত্রে আবদ্ধ হয়। এতে তাঁদের প্রতিবেশী রাজন্যবর্গ তাঁদের প্রতি বৈরী আচরণ শুরু করেন। মিত্রবর্গের স্বার্থ সংরক্ষণের জন্যও মাহমুদকে ভারতে অভিযান করতে হয়। পরাজিত রাজারা মাহমুদের সাথে সন্ধি করেন। তাঁদের মধ্যে কেউ কেউ সুযোগ পেয়ে সন্ধির শর্ত ভঙ্গ করেন । বিদ্রোহী রাজাদের সন্ধির শর্ত পালনে বাধ্য করার জন্যও মাহমুদকে অভিযান করতে হয়।


অর্থনৈতিক কারণ 

সুলতান মাহমুদ রাজধানী গজনিকে তিলোত্তোমা নগরীতে পরিণত করতে চেয়েছিলেন। তিনি ছিলেন জ্ঞানী-গুণীর পৃষ্ঠপোষক। তাঁর ছিল একটি অত্যন্ত শক্তিশালী সৈন্যবাহিনী। তিনি দক্ষ প্রশাসন ব্যবস্থা গড়ে তোলেন। এসবের জন্য তাঁর প্রচুর অর্থের প্রয়োজন ছিল। গজনীর রাষ্ট্রীয় কোষাগার তাঁর চাহিদার যোগান দিতে পারছিল না। তাই তিনি বাইরে থেকে অর্থ সংগ্রহের পরিকল্পনা করেন। তখন ভারত ছিল সম্পদশালী দেশ। এখানকার বিভিন্ন রাজ্যের কোষাগার ধনরত্নে পূর্ণ ছিল। ধর্মপ্রাণ বিত্তশালী ব্যক্তিবর্গ অকাতরে মন্দিরগুলোতে দান করতো। মন্দিরকে নিরাপদ বিবেচনা করে অনেক সময় রাজারাও তাতে ধনরত্ন সংরক্ষণ করতেন। সুতরাং স্বাভাবিকভাবেই সুলতান মাহমুদের নজর ভারতের উপর পড়ে। এজন্য তিনি প্রায় প্রতি বছর ভারতে অভিযান প্রেরণ করেন এবং ভারত থেকে প্রচুর ধন-রত্ন নিয়ে নিজ দেশে ফিরে যান। প্রফেসর হাবিব, প্রফেসর নাজিম ও হেইগ প্রমুখ আধুনিক ঐতিহাসিকগণ সুলতান মাহমুদের ভারত অভিযানের কারণ হিসেবে অর্থনৈতিক কারণকে অধিকতর গুরুত্ব দিয়েছেন। তাই বলে মাহমুদকে লুণ্ঠনকারী বা অর্থলোলুপ তস্কর বলা যাবে না। কারণ ভারত থেকে সংগৃহীত অর্থ তিনি মানব কল্যাণে ব্যয় করেন। নিজের ভোগ-বিলাসের জন্য তিনি সে অর্থ ব্যবহার করেন নি।


সামরিক উদ্দেশ্য

সুলতান মাহমুদের ভারত অভিযানের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কারণের পাশাপাশি সামরিক উদ্দেশ্য ছিল। তাঁর রাজ্যের নিরাপত্তার জন্য উত্তর-পশ্চিম সীমান্তপ্রদেশ, পাঞ্জাব ও সিন্ধু দখল করা অত্যন্ত প্রয়োজন ছিল। এ সকল অঞ্চল ছিল সামরিক দিক দিয়ে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। দক্ষ সমরবিদ হিসেবে তাঁর অশ্বারোহী ও পদাতিক বাহিনী ছিল সুশৃংঙ্খল ও সমরনিপুণ। তিনি বুঝতে পারেন এ সকল অঞ্চল জয় করতে তাঁকে খুব একটা বাঁধার সম্মুখীন হতে হবে না। সুতরাং তিনি বার বার ভারত আক্রমণ করে তাঁর সামরিক উদ্দেশ্য হাসিল করেছিলেন।


ধর্মীয় উদ্দেশ্য

সুলতান মাহমুদের ভারত অভিযানের পশ্চাতে কোন কোন ঐতিহাসিক ধর্মীয় উদ্দেশ্যও কার্যকর ছিল বলে মনে করেন। তাঁদের মতে তিনি ভারতে ইসলাম প্রচারে অভিলাষী ছিলেন। কিন্তু আধুনিক ঐতিহাসিকগণ এই মত সমর্থন করেন না। তাঁরা মনে করেন মাহমুদের যুগে শাসকগণ ইসলাম প্রচার করা তেমন কর্তব্য বলে মনে করতেন না। তিনি ভারত অভিযানে এসে কোন বিধর্মীকে বলপূর্বক ইসলাম গ্রহণে বাধ্য করেন নি। এছাড়া মাহমুদ হিন্দু মন্দির দখল করেছেন ধর্ম বিদ্বেষের কারণে নয়, বরং অর্থ পাওয়ার আশায়। এ সকল মন্দির ছিল যুগ যুগ ধরে সঞ্চিত সম্পদে পূর্ণ। সর্বোপরি তাঁর সেনাবাহিনীতে হিন্দু সৈন্যের উপস্থিতি তার ধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্যকে অনুমোদন করে না।


সুলতান মাহমুদের প্রধান প্রধান অভিযান

সুলতান মাহমুদ ১০০০ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১০২৭ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে মাত্র ২৭ বছরে ১৭ বার ভারতীয় উপমহাদেশে অভিযান পরিচালনা করেন । প্রথমে তিনি খাইবার গিরিপথের কয়েকটি দুর্গ দখল করেন। পিতা সবুক্তগীনের সময় থেকেই জয়পালের সাথে তাদের শত্রুতা চলে আসছিল। ১০০০ খ্রিস্টাব্দে পাঞ্জাবের রাজা জয়পাল বীরবিক্রমে যুদ্ধ করেও পরাজিত হন। তিনি কয়েকজন পুত্র-পৌত্রসহ সুলতানের সৈন্যদের হাতে বন্দী এবং কয়েকটি শর্তে তিনি মুক্তি পান। নিজ পুত্র আনন্দপালের হাতে রাজ্যের ভার ছেড়ে দেন তিনি। অত:পর তিনি আগুনে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করেন। জয়পালের পৌত্র সুখপাল ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। তাঁর নতুন নাম হয় ‘নওশাহ'। ১০০৪ খ্রিস্টাব্দে সুলতান মাহমুদ ভীরা রাজ্যের বিরুদ্ধে অভিযান প্রেরণ করেন। এই রাজ্যের রাজা ছিলেন বিজয় রায়। যুদ্ধে পরাজিত হয়ে বিজয় রায় পলায়ন করেন। মুসলমান সৈন্যগণ তাঁর পিছু ধাওয়া করে । পলায়ন সম্ভব নয় বুঝতে পেরে তিনি আত্মহত্যা করেন। ১০০৬ খ্রিস্টাব্দে মাহমুদ মুলতান আক্রমণ করেন। মুলতানের শাসনকর্তা ছিলেন আবুল ফতেহ দাউদ। দাউদ পরাজিত হয়ে পলায়ন করেন। মাহমুদ জয়পালের পুত্র নওশাহকে মুলতানের শাসনকর্তা নিযুক্ত করেন। কিন্তু সুলতান গজনীতে ফিরে যাওয়া মাত্র নওশাহ ইসলাম ধর্ম ত্যাগ করেন। সুলতান তাঁকে দমন করার জন্য আবার অভিযান পাঠান। এটি ছিল ভারতে তাঁর পঞ্চম অভিযান। নওশাহ পরাজিত হয়ে ক্ষমা প্রার্থনা করেন। ১০০৮ খ্রিস্টাব্দে মাহমুদ ভারতে তাঁর ষষ্ঠ অভিযান পরিচালনা করলে পাঞ্জাবের শাসনকর্তা আনন্দপাল পার্শ্ববর্তী হিন্দু রাজ্যগুলোর রাজাদের নিকট সাহায্য প্রার্থনা করেন। উজ্জয়িনী, কালিঞ্জর, গোয়ালিয়র, কনৌজ, দিল্লি ও আজমীরের রাজাগণ এই আবেদনে ব্যাপক সাড়া দেন। হিন্দু রমণীগণ তাদের গায়ের গহনা ও অন্যরা সৈন্য ও অর্থ দিয়ে আনন্দপালকে সাহায্য করেন। আনন্দপাল এক বিশাল সৈন্যবাহিনী নিয়ে মাহমুদের মুখোমুখি হন। ওয়াইহিন্দ নামক স্থানে উভয়পক্ষে প্রচণ্ড যুদ্ধের প্রথম পর্যায়ে আনন্দপালের সম্মিলিত বাহিনীই সুবিধাজনক অবস্থায় ছিল। কিন্তু হঠাৎ আনন্দপালের হাতী ভয় পেয়ে যুদ্ধক্ষেত্র ত্যাগ করে। এতে তাঁর বাহিনী ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়ে। সুলতান মাহমুদ বিজয়ী হয়ে পাঞ্জাব থেকে প্রচুর ধন-রত্ন গজনীতে নিয়ে যান। পাঞ্জাবকে তিনি নিজ রাজ্যভুক্ত করেন।


মাহমুদ ১০১৪ খ্রিস্টাব্দে ত্রিলোচনপালের রাজধানী নন্দনা আক্রমণ করেন। এটি ছিল তাঁর নবম অভিযান। যুদ্ধে হেরে গিয়ে ত্রিলোচনপাল কাশ্মীরে পলায়ন করেন। কাশ্মীরের রাজা তুঙ্গ তাঁকে আশ্রয় দেন। মাহমুদের সাথে তাঁদের যুদ্ধ হয়। এই যুদ্ধেও মাহমুদ জয়ী হন। সুলতান গজনীতে ফিরে গেলে ত্রিলোচনপাল পাঞ্জাবে ফিরে আসেন। তিনি শিবলী পাহাড়ে নতুন রাজধানী স্থাপন করেন। বুন্দেলখন্ডের রাজা বিদ্যাধরের সাথে তিনি মৈত্রী চুক্তি করেন। মাহমুদ তাঁকে এই চুক্তি ভঙ্গ করতে বলেন। কিন্তু ত্রিলোচন এতে রাজী হন নি। মাহমুদ তাই তার বিরুদ্ধে পুনরায় অভিযান প্রেরণ করেন। এবার মাহমুদ পাঞ্জাব দখল করে নিজ সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত করেন। তিনি নিজের একজন আমিরকে পাঞ্জাবের শাসনকর্তা নিযুক্ত করেন। সুলতান মাহমুদের পরবর্তী গুরুত্বপূর্ণ অভিযান পরিচালিত হয় কনৌজের বিরুদ্ধে। এটি ছিল তাঁর ১২তম অভিযান। কনৌজ ভারতের কেন্দ্রিয় শক্তি হিসেবে বিবেচিত ছিল। রাজ্যপাল ছিলেন সে-সময় কনৌজের রাজা। মাহমুদ ১০১৮ খ্রিস্টাব্দে


একটি শক্তিশালী বাহিনী নিয়ে গজনী ত্যাগ করেন এবং পথে তিনি বারণ জয় করেন। বারণের রাজা তাঁর অনুচরসহ ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। অতঃপর সুলতান কনৌজের দ্বারপ্রান্তে এসে পৌঁছালে রাজ্যপাল সামান্য বাঁধা দানের পর আত্মসমর্পণ করেন। রাজ্যপাল সুলতানের নিকট নতি স্বীকার করায় ভারতের অন্যান্য রাজারা তাঁর প্রতি ক্ষুব্ধ হন। কালিঞ্জরের রাজা গোন্ড তাদের নেতৃত্ব দেন। তাঁরা একজোট হয়ে কনৌজ আক্রমণ ও রাজ্যপালকে তাঁরা হত্যা করেন। রাজ্যপালের পুত্রকে সিংহাসনে বসানো হয়। এতে মাহমুদ খুবই ক্রোধান্বিত হন। তিনি গোন্ডকে শাস্তি দেওয়ার জন্য ভারত অভিযান করেন। গোন্ড যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পালিয়ে যান। এটি ছিল তাঁর ১৩তম অভিযান। মাহমুদের ১৪ তম ও ১৫ তম অভিযান পরিচালিত হয় যথাক্রমে গোয়ালিয়র ও কালিঞ্জরের বিরুদ্ধে। উভয় অভিযানে তিনি সফল হন। গোয়ালিয়র ও কালিঞ্জর থেকে তিনি প্রচুর ধন-রত্ন প্রাপ্ত হন। উভয় রাজ্যের রাজা বার্ষিক কর প্রদানে বাধ্য হয়। মাহমুদের অভিযানগুলোর মধ্যে সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ ছিল তাঁর ষোড়শ অভিযান। কাথিওয়ারের বর্তমান গুজরাট এর সোমনাথ মন্দিরের বিরুদ্ধে এই অভিযান পরিচালিত হয়। এই মন্দিরে বিপুল পরিমাণ ধন-রত্ন সঞ্চিত ছিল। ধনী ব্যক্তিগণ এবং রাজণ্যবর্গ এই মন্দিরে অর্থ হিসেবে সোনা- রূপা দান করতেন। তাছাড়া অনেকেই মন্দিরকে নিরাপদ স্থান মনে করে সেখানে তাদের ব্যক্তিগত ধন-রত্নও গচ্ছিত রাখতেন । হিন্দুগণ সোমনাথ মন্দিরকে অজেয় মনে করতো। মাহমুদ সোমনাথ জয়ের পরিকল্পনা করেন। তিনি ১০২৫ খ্রিস্টাব্দের শেষ দিকে গজনী থেকে বের হন। মুলতান ও রাজস্থান হয়ে তিনি সোমনাথ মন্দিরের দ্বারে এসে পৌঁছেন। পার্শ্ববর্তী রাজ্যের রাজারা সোমনাথ মন্দির রক্ষার জন্য বিপুল শক্তি সংগ্রহ করে। কিন্তু ১০২৬ খ্রি. মাহমুদ তাদের সকল বাঁধা ছিন্ন করেন। এই মন্দির থেকে তিনি বিপুল সম্পদ সংগ্রহ করেন। এই সম্পদের মধ্যে ছিল দুই কোটি স্বর্ণমুদ্রা, প্রচুর অলঙ্কার ও মণি-মানিক্য। মাহমুদের সোমনাথ বিজয় ইসলামের ইতিহাসের অন্যতম দুঃসাহসিক অভিযান। ভারতে সুলতান মাহমুদের শেষ অভিযান পরিচালিত হয় জাঠদের বিরুদ্ধে। মাহমুদ যখন সোমনাথ অভিযান শেষে গজনি ফিরছিলেন তখন জাঠগণ চোরাগুপ্তা হামলা চালিয়ে তাঁর সৈন্যবাহিনীকে উত্যক্ত করে। তাদেরকে সমুচিত জবাব দেওয়ার জন্য মাহমুদ ১০২৭ খ্রিস্টাব্দে তাঁর এই শেষ অভিযান পরিচালনা করে জাঠদের পরাজিত করেন। উপরোক্ত আলোচনা থেকে স্পষ্ট হয় যে, সুলতান মাহমুদের ভারত অভিযান নিষ্ফল ছিল না। মাহমুদের এই অভিযানের ফলাফলকে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক এই তিন ভাগে পাওয়া যায়। 


সুলতান মাহমুদের ভারত অভিযানের ফলাফল

সুলতান মাহমুদের ভারত অভিযানের প্রভাব সমগ্র উত্তর-পশ্চিম ভারতে অনুভূত হয়। রাজনৈতিক ক্ষেত্রে এই অভিযানের প্রভাব ছিল ব্যাপক। সুলতান মাহমুদ অভিযান করেছেন, জয়লাভ করেছেন এবং ধন-সম্পদ নিয়ে নিজের রাজ্য গজনিতে ফিরে গিয়েছেন। শুধু পাঞ্জাবের কিয়দংশ এবং মুলতান ছাড়া ভারতের আর কোন অঞ্চল তাঁর সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত করেন নি এবং কোন স্থায়ী সাম্রাজ্যও প্রতিষ্ঠা করেন নি। কয়েকজন রাজা অবশ্য তাঁকে কর দিতে বাধ্য হয়েছিলেন। কিন্তু ১০৩০ খ্রিস্টাব্দে তাঁর মৃত্যুর সাথে সাথে এই সকল রাজা কর প্রদান বন্ধ করেন। পাঞ্জাব ও মুলতান ছাড়া উত্তর ভারতের অন্যান্য অঞ্চলের রাজাগণ তাঁদের স্ব স্ব রাজ্যে নিজেদের প্রভুত্ব পুনরায় স্থাপন করেন। এই দিক দিয়ে বিবেচনা করলে আমাদের স্বীকার করতে হবে যে, সুলতান মাহমুদের ভারত অভিযান সফল হয় নি। তবে এ কথাও সত্য যে, সুলতান মাহমুদের বিজয় স্থায়ী না হলেও তাঁর বিজয়ই পরবর্তীকালে মুসলমানদের ভারত বিজয়ের পথ সুগম করেছিল। সুলতান মাহমুদের বার বার আক্রমণ উত্তর ভারতের রাজন্যবর্গের সামরিক শক্তি দুর্বল করে দিয়েছিল। সামরিক, প্রশাসনিক ও অর্থনৈতিক দিক থেকে একেবারেই দুর্বল হয়ে পড়েছিলেন বলে পরবর্তী মুসলমান আক্রমণ প্রতিহত করা সম্ভবপর হয় নি। সুলতান মাহমুদের অভিযানের সময় ভারতীয় সামরিক শক্তি ও রণকৌশল মুসলমানদের সামরিক শক্তি ও রণকৌশলের তুলনায় যে কত দুর্বল তা প্রকটভাবে ধরা পড়ে। মাহমুদ ভারতের সমৃদ্ধ জনপদ, নগর, দুর্গ ও মন্দির আক্রমণ করেন ধন-রত্ন লাভ করার জন্য। এই জন্য এ সকল লক্ষ্যস্থল থেকে তিনি প্রচুর সম্পদ নিজ রাজধানী গজনিতে নিয়ে যান। এর ফলে ভারত অর্থনৈতিক দিক থেকে দুর্বল হয়ে পড়ে। অপরদিকে গজনি অর্জন করে আর্থিক সমৃদ্ধি। ভারতের আর্থিক দুর্বলতা তার সামরিক শক্তি ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার উপরও বিরূপ প্রভাব ফেলে। অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে সুলতান মাহমুদের ভারত অভিযানের ফলাফল ছিল লক্ষ্যনীয়। সুলতান মাহমুদের ভারত অভিযানের ফলাফল সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রেও লক্ষ্যনীয়। সুলতান মাহমুদ সম্পর্কে ঐতিহাসিক ডব্লিউ হেগ মন্তব্য করেন, “তিনিই প্রথম ভারতের মধ্যস্থলে ইসলামের পতাকা উড্ডীন করেন” । সুলতান মাহমুদের সৈন্যবাহিনীর সাথে অনেক সুফি-দরবেশ ও পণ্ডিত ব্যক্তি ভারতে আসেন। সুফি-দরবেশগণ ভারতে ইসলাম প্রচারে সহায়তা করেন। তাঁদের সান্নিধ্যে এসে বহু ভারতীয় ইসলাম গ্রহণ করে। পন্ডিত ব্যক্তিগণ ভারতের জ্ঞান-বিজ্ঞানের সাথে ইসলামি চিন্তা-চেতনার সমন্বয় সাধন করেন। উদাহরণ স্বরূপ বিখ্যাত পন্ডিত আল-বিরুনী দশ বছর ভারতে অবস্থান করেন। তিনি ভারতীয় পন্ডিতদের নিকট ভারতের দর্শন, সমাজ ব্যবস্থা ও কৃষি সম্পর্কে জ্ঞানলাভ করেন। এর ফল স্বরূপ তিনি তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ ‘কিতাব-উল-হিন্দ' প্রণয়ন করেন। গ্রন্থটি ভারত ইতিহাসের অমূল্য উপকরণ। মাহমুদের অভিযানের ফলে ইসলামি সভ্যতা ও ভারতীয় সভ্যতার মধ্যে ভাব বিনিময় ঘটে।


সুলতান মাহমুদ: চরিত্র ও কৃতিত্ব

ভারতবর্ষের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সুলতান ও বিজেতা হিসেবে সুলতান মাহমুদের অবস্থান ইতিহাসের পাতায় এখনো অক্ষুন্ন রয়েছে। সুলতান মাহমুদ অনেকবার বিজয়ী হয়ে জীবনের শেষ বেলায় অক্লান্ত পরিশ্রমে তাঁর স্বাস্থ্য ভেঙ্গে পড়ে এবং ১০৩০ খ্রিস্টাব্দে মাত্র ৬০ বছর বয়সে গজনিতে মৃত্যু বরণ করেন। তিনি প্রায় ৩২ বছর রাজত্ব করেন। সুলতান মাহমুদকে তাঁর যুগের প্রতিভাবান শাসক হিসেবে আখ্যায়িত করা যায়। প্রকৃতপক্ষে মাহমুদ ছিলেন একজন সুনিপুন সৈনিক। তাঁর দেহে ছিল যেমন শক্তি, তেমনি মনেও ছিল অফুরন্ত সাহস।


সুলতান মাহমুদ সকল অভিযানেই বিজয়ী হয়েছিলেন। ঈশ্বরী প্রসাদ তাঁকে ‘বড় মাপের দিগ্বিজয়ী বীর' বলে আখ্যায়িত করেছেন। ঈশ্বর টোপ্পয়ার মতে, সুলতান মাহমুদ ছিলেন ‘গজনির নেপোলিয়ন'। সামরিক দক্ষতা, বীরত্ব, তীক্ষ্ণতা এবং সামরিক সংগঠক হিসেবে সুলতান মাহমুদ অনন্য প্রতিভার অধিকারী ছিলেন। একজন দক্ষ সংগঠক হিসেবে আরব,আফগান, ইরান, তুরান, হিন্দু ও তুর্কিদের দ্বারা গঠিত সেনাবাহিনীর ক্ষিপ্রতা, সাহসিকতা ও অপরাজেয়তা তাঁর সাংগঠনিক ক্ষমতার পরিচায়ক। ঈশ্বরী প্রসাদের মতে, একটি পার্বত্য ক্ষুদ্র রাজ্যকে শুধু শক্তির বলে বিশাল ও সমৃদ্ধ সাম্রাজ্যে পরিণত করা অসাধারণ কৃতিত্বের পরিচায়ক। আরব-তুর্কি শাসকদের মধ্যে তিনিই প্রথম শাসক, যিনি হিরাত, কাবুল ও গজনির সীমা অতিক্রম করে সমগ্র আফগানিস্তানের ওপর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেন। ঐতিহাসিক গিবনের মতে, সুলতান মাহমুদ নিঃসন্দেহে বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ শাসক ছিলেন। ভারতবর্ষের আবহাওয়ার কথা ভেবে তিনি অক্টোবর মাসের প্রথম দিকে অভিযান আরম্ভ করতেন এবং শীতকালে গিরিপথ, মরুভূমি এবং পাহাড়িয়া অঞ্চল অতিক্রম করে তিন মাসের মধ্যে গাঙ্গেয় অঞ্চলে পৌছে যেতেন। আর শত্রু নিধন ও ধন-সম্পদ লাভ করে গ্রীষ্মের পূর্বেই গজনিতে প্রত্যাবর্তন করতেন। সুলতান মাহমুদ শিল্প, সাহিত্য ও সংস্কৃতির উদার পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। বহু মূল্যবান গ্রন্থ প্রণেতা আল বিরুনী ছিলেন, সুলতান মাহমুদের দরবারের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র। যে গ্রন্থটি আল বিরুনীকে ইতিহাসে বিখ্যাত করে রেখেছে তা হলো ‘কিতাব-উল-হিন্দ'। ঈশ্বরী প্রসাদ সুলতান মাহমুদের যুগকে কবিতার যুগ বলে অভিহিত করেছেন। ঐ যুগের প্রসিদ্ধ কবি ছিলেন আবুল কাশেম ফেরদৌসী। প্রাচ্যের হোমার নামে খ্যাত এ কবি সুলতান মাহমুদের অনুরোধে জগদ্বিখ্যাত ‘শাহনামা' মহাকাব্য রচনা করেন ।

0 মন্তব্য(গুলি):

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Comment below if you have any questions

অফিস/বেসিক কম্পিউটার কোর্স

এম.এস. ওয়ার্ড
এম.এস. এক্সেল
এম.এস. পাওয়ার পয়েন্ট
বাংলা টাইপিং, ইংরেজি টাইপিং
ই-মেইল ও ইন্টারনেট

মেয়াদ: ২ মাস (সপ্তাহে ৪দিন)
রবি+সোম+মঙ্গল+বুধবার

কোর্স ফি: ৪,০০০/-

গ্রাফিক ডিজাইন কোর্স

এডোব ফটোশপ
এডোব ইলাস্ট্রেটর

মেয়াদ: ৩ মাস (সপ্তাহে ২দিন)
শুক্র+শনিবার

কোর্স ফি: ৮,৫০০/-

ওয়েব ডিজাইন কোর্স

এইচটিএমএল ৫
সিএসএস ৩

মেয়াদ: ৩ মাস (সপ্তাহে ২দিন)
শুক্র+শনিবার

কোর্স ফি: ৮,৫০০/-

ভিডিও এডিটিং কোর্স

এডোব প্রিমিয়ার প্রো

মেয়াদ: ৩ মাস (সপ্তাহে ২দিন)
শুক্র+শনিবার

কোর্স ফি: ৯,৫০০/-

ডিজিটাল মার্কেটিং কোর্স

ফেসবুক, ইউটিউব, ইনস্টাগ্রাম, এসইও, গুগল এডস, ইমেইল মার্কেটিং

মেয়াদ: ৩ মাস (সপ্তাহে ২দিন)
শুক্র+শনিবার

কোর্স ফি: ১২,৫০০/-

অ্যাডভান্সড এক্সেল

ভি-লুকআপ, এইচ-লুকআপ, অ্যাডভান্সড ফাংশনসহ অনেক কিছু...

মেয়াদ: ২ মাস (সপ্তাহে ২দিন)
শুক্র+শনিবার

কোর্স ফি: ৬,৫০০/-

ক্লাস টাইম

সকাল থেকে দুপুর

১ম ব্যাচ: সকাল ০৮:০০-০৯:৩০

২য় ব্যাচ: সকাল ০৯:৩০-১১:০০

৩য় ব্যাচ: সকাল ১১:০০-১২:৩০

৪র্থ ব্যাচ: দুপুর ১২:৩০-০২:০০

বিকাল থেকে রাত

৫ম ব্যাচ: বিকাল ০৪:০০-০৫:৩০

৬ষ্ঠ ব্যাচ: বিকাল ০৫:৩০-০৭:০০

৭ম ব্যাচ: সন্ধ্যা ০৭:০০-০৮:৩০

৮ম ব্যাচ: রাত ০৮:৩০-১০:০০

যোগাযোগ:

আলআমিন কম্পিউটার প্রশিক্ষণ কেন্দ্র

৭৯৬, পশ্চিম কাজীপাড়া বাসস্ট্যান্ড,

[মেট্রোরেলের ২৮৮ নং পিলারের পশ্চিম পাশে]

কাজীপাড়া, মিরপুর, ঢাকা-১২১৬

মোবাইল: 01785 474 006

ইমেইল: alamincomputer1216@gmail.com

ফেসবুক: facebook.com/ac01785474006

ব্লগ: alamincomputertc.blogspot.com

Contact form

নাম

ইমেল *

বার্তা *