বাংলাদেশে ভূমিকম্প
বাংলাদেশের ভূমিকম্প বলতে বাংলাদেশ ও তার নিকটবর্তী এলাকার ভূমিকম্পকে বুঝায়। কারণ বাংলাদেশ আসলে ভারত ও মায়ানমারের ভূ-অভ্যন্তরের দুটি চ্যুতির প্রভাবে আন্দোলিত হয়। উল্লেখ্য বাংলাদেশ ভারতীয়, ইউরোপিয় এবং মায়ানমারের টেকটনিক প্লেটের মাঝে অবস্থিত। এই প্লেটগুলোর নড়াচড়ার কারণে আমাদের দেশে প্রায়ই ভূমিকম্প অনুভূত হয়। তাছাড়া ভারতিয় ও ইউরেশিয় প্লেট দুটো হিমালয়ের পাদদেশে আটকা পড়ে রয়েছে এবং ১৯৩৪ সালের পর তেমন কোন বড় ধরনের নড়াচড়া প্রদর্শন করে নি। এ কারণে বিজ্ঞানীরা ধারণা করছেন এ প্লেট দুটো হয়তো নিকট ভবিষ্যতে নড়ে ওঠবে যা বড় ধরনের ভূমিকম্পের কারণ হবে। বাংলাদেশে ৮টি ভূ-তাত্ত্বিক চ্যুতি এলাকা রয়েছে, যথা বগুড়া চ্যুতি এলাকা, রাজশাহীর তানোর চ্যুতি এলাকা, ত্রিপুরা চ্যুতি এলাকা, সিতাকুণ্ড টেকনাফ চ্যুতি এলাকা, হালুয়াঘাটের ডাওকি চ্যুতি এলাকা, ডুবরি চ্যুতি এলাকা, চট্টগ্রাম চ্যুতি এলাকা, সিলেটের শাহজীবাজার চ্যুতি এলাকা, রাঙামাটি চ্যুতি এলাকা। এসব ‘ভূ-চ্যুতি’ই বাংলাদেশের ভূমিকম্পের প্রধান কারণ।
প্রাকৃতিকভাবেই কার্বন চক্রের প্রভাবে ভূমিকম্প হয়ে থাকে, বাংলাদেশও তার ব্যতিক্রম নয়। এদেশের ভিতরে ও পার্শ্ববর্তী এলাকার ভূমিকম্পের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, ১৯০০ খ্রি. থেকে ২০০৪ খ্রি. পর্যন্ত শতাধিক ভূমিকম্প সংঘটিত হয়েছে, যার মধ্যে ১৯৬০ খ্রিষ্টাব্দের পরেই হয়েছে ৬৫ টিরও বেশি। অর্থাৎ গত ৩০ বছরে ভূমিকম্প সংঘটনের মাত্রা বেড়েছে। বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তরের মানমন্দিরে মে ২০০৭ থেকে জুলাই,২০০৮ পর্যন্ত কমপক্ষে ৯০টি ভূকম্পন নথিভূক্ত হয় যার ৯টিরই রিখটার স্কেলে মাত্রা ছিল ৫ এর ওপরে। গত ১৬ মাসের ব্যবধানে পাঁচটি শক্তিশালী ভূমিকম্পের মুখােমুখি হয়েছে দেশ। গত বছর ২৫ এপ্রিল তারিখে সংঘটিত নেপালের ৭.৯ মাত্রার ভূমিকম্পের প্রচণ্ড আঘাত বাংলাদেশকে নাড়িয়ে দিয়ে যায়। মাত্র ১৫ কিলোমিটার গভীর থেকে উৎপন্ন হওয়ায় এই ভূমিকম্প নেপালে মানবিক বিপর্যয় সৃষ্টি করেছে। এর রেশ না কাটতেই ১২ মে তারিখে নেপালে আবারও ৭.১ মাত্রার ভূমিকম্প আঘাত হানে। ঢাকা থেকে দুটি ভূমিকম্পের দূরত্ব ছিল যথাক্রমে ৭শত ও ৬শত কিলোমিটার। ২০১৬ সালের ৪ জানুয়ারি তারিখের ভােরে ৬.৭ মাত্রার ভূমিকম্পে কেঁপে ওঠে সারা দেশ, যার উৎপত্তিস্থল ছিল ঢাকা থেকে ৩৪৩ কিলোমিটার উত্তর-পূর্বে ভারতের মনিপুর রাজ্যে। এর রেশ না কাটতেই গত পয়লা বৈশাখের আগের দিন ১৩ এপ্রিল,২০১৬-এর সন্ধ্যায় ৬.৯ মাত্রার আরেকটি শক্তিশালী ভূমিকম্পে কম্পিত হয় এ দেশ। এর উৎপত্তিস্থল ছিল ঢাকা থেকে ৪৬৫ কিলোমিটার পূর্বে মিয়ানমারের দক্ষিণপূর্বেও মাইলাক শহরের কাছে। ভূ-পৃষ্ঠ থেকে এর কেন্দ্রের গভীরতা ছিল ১৩৫ কিলোমিটার। এরপর এ বছরের ২৩ ও ২৪ আগষ্টে মৃদু ভূমিকম্পের পর ২৪ আগষ্টে বাংলাদেশে ৬.৮ মাত্রার শক্তিশালী ভূমিকম্প হয়, যার উৎপত্তিস্থল ছিল মায়ানমারের মধ্যাঞ্চলে এবং কেন্দ্র ছিল ভূ-পৃষ্ঠের ৮৪.১ কিলোমিটার গভীরে। ঢাকা থেকে এর দূরত্ব ছিল ৫২৬ কিলোমিটার। এভাবে মৃদু ও মাঝারি ভূমিকম্পে দফায় দফায় কেঁপে ওঠছে বাংলাদেশ। এ পরিপ্রেক্ষিতে জনমনে আতংক তৈরি হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ শক্তিশালী ভূমিকম্পগুলো দেশ থেকে অনেক দূরে ও মাটির অনেক গভীরে কেন্দ্র হওয়ায় বড় ধরণের বিপর্যয় ডেকে আনে। তবে দেশের ভেতর থেকে কম গভীরতায় উৎপন্ন শক্তিশালী ভূমিকম্পের সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না। আর এ ধরনের ভূমিকম্প দেশে মানবিক বিপর্যয় সৃস্টি করবে। বিশেষজ্ঞদের মতে শুধু ভূমিকম্প নয়, ভূমিকম্পের পর দেশের উপকূলীয় এলাকা ঘিরে ভয়াবহ সুনামি সৃষ্টির জন্য সাইসমিক গ্যাপ বিরাজমান রয়েছে, যা আমাদের জন্য অশনিসংকেত।
অনেক ভূ-তাত্ত্বিক ঘন ঘন ছােট ছােট ভূমিকম্পন সংঘটনকে বড় ধরনের ভূমিকম্পের পূর্বাভাস বলে উল্লেখ করেছেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের লেমন্ট-ডোহের্টি আর্থ অবজারভেটরির ভূ-তাত্ত্বিকেরা জানিয়েছেন, বাংলাদেশের নিচে জমে ওঠা টেকটনিক চাপ জমে উঠছে কমপক্ষে ৪০০ বছর ধরে। এই চাপ যখন মুক্ত হবে তখন সৃষ্ট ভূমিকম্পের মাত্রা হবে প্রায় ৮.২ রিখটার, এমন কী তার মাত্রা বেড়ে ৯ রিখটারেও পৌছতে পারে। (জুলাই, ২০১৬)। প্রায় ১৪ কোটি মানুষ এর ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারেন।
বাংলাদেশকে ভূমিকম্পের তীব্রতার ভিত্তিতে তিনটি জোনে ভাগ করা হয়েছে। মাত্রাভেদে বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকার অবস্থান নিম্নরূপ :
জোন-১: পঞ্চগড়, রংপুর, গাইবান্ধা, কুড়িগ্রাম, জামালপুর, শেরপুর, ময়মনসিংহ, নেত্রকোনা, সুনামগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ, মৌলভীবাজার, সিলেট, হবিগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সম্পূর্ণ অংশ এবং ঠাকুরগাঁও, সিরাজগঞ্জ, টাঙ্গাইল, রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি ও কক্সবাজারের অংশবিশেষ।
জোন-২: রাজশাহী, নাটোর, মাগুরা, মেহেরপুর, কুমিল্লা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, ফেনি এবং ঢাকা।
জোন-৩ : বরিশাল, পটুয়াখালী এবং সব দ্বীপ ও চর। জোন ১-এর অন্তর্ভুক্ত বাংলাদেশের ৪৩% এলাকা উচ্চ মাত্রার ঝুঁকিতে, জোন ২-এর অন্তর্ভুক্ত ৪১% এলাকা মধ্যম মাত্রার ঝুঁকিতে এবং ১৬% এলাকা নিম্ন ঝুঁকিতে রয়েছে। জোন ১-এ অবস্থিত বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চল তথা সিলেট এবং তৎসংলগ্ন এলাকা ভূমিকম্প প্রবণ। এর পরের অংশগুলোও যেমন ঢাকা ও রাজশাহী সক্রিয় ভূমিকম্প এলাকায় থাকার কারণে মারাত্মক ভূমিকম্পের আঘাতে ক্ষত-বিক্ষত হতে পারে।
জাতিসংঘ পরিচালিত রিস্ক অ্যাসেসমেন্ট টুলস ফর ডায়াগনসিস অফ আরবান এরিয়াস এগেইন্সট সাইসমিক ডিজাস্টার’জরিপে ভূ-তাত্ত্বিক ঝুঁকিপূর্ণ বিশ্বের ২০টি শহরের মধ্যে ঢাকা অন্যতম। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূ-তত্ত্ব বিভাগ কর্তৃক এক গবেষণায় দেখা গেছে ঢাকার ভূমিতে বিভিন্ন প্রকার মাটি ( লাল মাটি, নরম মাটি ইত্যাদি) রয়েছে। ঢাকার সম্প্রসারিত অংশে জলাশয় ভরাট করে গড়ে তোলা হয়েছে আবাসন এলাকা। ভূমিকম্পের সময় নরম ও ভরাট করা এলাকার মাটি ভূমিকম্পের তরঙ্গকে বাড়িয়ে দেয়। তাই আলগা মাটি সমৃদ্ধ ঢাকার বর্ধিতাংশকে গবেষকরা যথেষ্ঠ ঝুঁকিপূর্ণ মনে করছেন। সরকারি তথ্যসূত্র মতে, ঢাকায় রাতের বেলায় ৭ থেকে ৭.৫ মাত্রার ভূমিকম্প হলে ৯০,০০০ লোক এবং দিনের বেলায় হলে ৭০,০০০ লোক হতাহত হবে। প্রায় ৭২,০০০ দালান সম্পূর্ণ ধ্বংস এবং ৮৫,০০০ ভবন মাঝারি ধরনের ক্ষতিগ্রস্ত হবে, যার আর্থিক মূল্য দাঁড়াবে ৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার।
ভূমিকম্প মোকবেলায় পদক্ষেপ
ভূমিকম্পের ঝুঁকি মোকাবেলায় আমাদের মূল লক্ষ্য হওয়া উচিত দুটি। এক. ভূমিকম্পে ক্ষয়ক্ষতির মাত্রাকে নিম্নতম পর্যায়ে রাখা। দুই. ভূমিকম্প পরবর্তী পরিস্থিতি সামাল দেওয়া। এ লক্ষ্যে ভূমিকম্প পূর্ব, ভূমিকম্প কালীন ও ভূমিকম্পের পরে করণীয় নির্ধারণ করে আমাদের ব্যাপক প্রস্তুতি গ্রহণ করতে হবে। পদক্ষেপসমূহ হলো:
১। পরিবারের সবাইকে ভূমিকম্পের জরুরি অবস্থায় করণীয় সম্পর্কে সচেতন করতে হবে।
২। ভূমিকম্প মোকাবেলায় সক্ষম বাড়িঘর, দালান ও অন্যান্য অবকাঠামো নির্মাণ করা।
৩। পূর্ব প্রস্তুতি হিসেবে ঘরের বড় বড় ও লম্বা আসবাবপত্রগুলোকে দড়ি দিয়ে বেঁধে রাখতে হবে।
৪। বিছানার পাশে সব সময় টর্চলাইট, ব্যাটারি এবং জুতা রাখা।
৫। ধুলাবালি থেকে বাঁচার জন্য আগেই রুমাল বা চাদরের ব্যবস্থা রাখা।
ভূমিকম্প মোকবেলায় সরকারি পদক্ষেপ
১। পুরনো নড়বড়ে দালানগুলো অপসারণ অথবা প্রয়োজনীয় সংস্কারের ব্যবস্থা গ্রহণ।
২। ভূমিকম্পের সময় করণীয় সম্পর্কে জনগণকে সচেতন করা ও প্রশিক্ষণ প্রদানের ব্যবস্থা করা।
৩। ভূমিকম্প সহনীয় করে বিল্ডিং নির্মাণ নিশ্চিতকরণের জন্য তদারকি নিশ্চিত করা।
৪। রাস্তা প্রশস্ত ও উন্মুক্ত মাঠ বাড়ানো নিশ্চিত করা।
৫। দ্রুত উদ্ধার কাজের জন্য আধুনিক যন্ত্রপাতির যোগান নিশ্চিত করা এবং প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণের মাধ্যমে পর্যাপ্ত সংখ্যক দক্ষ উদ্ধারকর্মী সৃষ্টি করা।
৬। ইলেকট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়ায় সচেতনতামূলক ব্যাপক প্রচারের ব্যবস্থা গ্রহণ।
মনে রাখতে হবে, “ প্রতিকারের চেয়ে প্রতিরোধ ভালো।”
ভূমিকম্প হলে করণীয়
১। ভূমিকম্প হলে টেবিল, চেয়ার, বিছানার নিচে আশ্রয় না নিয়ে ঠিক পাশে আশ্রয় নিতে হবে।
২। দৌড়াদৌড়ি বা হুড়াহুড়ি বা ধাক্কাধাক্কি করে সিঁড়ি দিয়ে না নামা।
৩। কখনো সিঁড়িতে আশ্রয় না দেওয়া।
৪। বাসার একেবারে ভিতরের দিকে রুমে না থেকে বাইরের দেয়ালের বিমের কাছাকাছি থাকতে চেষ্টা করা।
৫। উঁচু দালান, বড় গাছ, বিদ্যুতের খুঁটি ও গ্যাস লাইনের কাছাকাছি আশ্রয় না নেওয়া।
৬। ভূমিকম্পের সময় গাড়িতে থাকলে দ্রুত নেমে পড়া এবং বাসার বাইরে থাকলে বাসায় না ঢােকা।
৭। কাচের জানালা, আলমারি, ফ্রিজের কাছাকাছি আশ্রয় না নেওয়া।
৮। ভূমিকম্পের সময় লিফট ব্যবহার না করা।
৯। প্রথম ভূমিকম্পের পর পরাঘাতের আগেই গ্যাস, বিদ্যুৎ- এসবের মেইন সুইচ বন্ধ করে দেওয়া।
১০। দেয়াশলাই জ্বালানো যাবে না।
উপসংহার
ভূমিকম্প প্রাকৃতিক দুর্যোগগুলোর একটি। ভূ-তাত্ত্বিক প্রক্রিয়ার কারণেই এটি ঘটে থাকে। ভূমিকম্প থামানোর ক্ষমতা কারোর নেই; কিন্তু ভূমিকম্প মোকাবেলার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করে এর ধ্বংসের ভয়াবহতা কমানো সম্ভব। তাই এ বিষয়ে সরকারি, বেসরকারি ও ব্যক্তিগত পর্যায়ে জরুরি উদ্যোগ গ্রহণ একান্ত প্রয়োজনীয়।
0 মন্তব্য(গুলি):
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
Comment below if you have any questions