সাহিত্য পাঠের প্রয়োজনীয়তা
সাহিত্যের সাধনা সত্য ও সুন্দরের সাধনা। সাহিত্যের মধ্য দিয়ে আমরা জগৎ ও জীবনের চিরায়ত সত্য ও সুন্দরকে অনুধাবন করি। ঋদ্ধ মননশীলতা, অপার সৃজনশীলতা আর সূক্ষ্ম অনুভবময়তার কারণেই শিল্পী-সাহিত্যিকেরা মানবসমাজের সবচেয়ে অগ্রসর অংশ। অনুভূতির সূক্ষ্ম শিকড় চাড়িয়ে শিল্পী-সাহিত্যিকেরা জগতের অপার রহস্যজাল থেকে সত্য ও সুন্দরকে ছেনে বের করে তার অমৃতরস আমাদের সামনে তুলে ধরেন। পাঠক সেই রসসুধা পান করে এক অনাবিল আনন্দে পরিপ্লাবিত হয়; পাশাপাশি যে সত্য-সুন্দরের বার্তা পায় সাহিত্যে, তারই আলােকে সাজায় আপন জীবন-ভুবন।
সাহিত্যপাঠে মানুষ অর্জন করে পরিচ্ছন্ন চিন্তা ও মুক্তবুদ্ধি, যা সকল ক্ষুদ্রতার বন্ধন মুক্ত করে তাঁকে উপনীত করে মহত্ত্বের উপলব্ধিতে। সাহিত্য মানুষের মনে নান্দনিকতার বোধ জাগায়, জগৎ ও জীবনকে দেখার শৈল্পিক দৃষ্টি দান করে। সাহিত্য মানুষকে উন্নত রুচিবোধ ও চিন্তা-চেতনার সন্ধান দেয়। সাহিত্য শুভবোধে উদ্দীপ্ত কল্যাণময় ও সৌন্দর্যময় জীবন বিনির্মাণের রসদ জোগায়। ফলত সাহিত্যপ্রেমী মানুষের প্রতিটি কর্মে ও আচরণে শিল্পের ছোঁয়া থাকে।
মানবতার বাণী সাহিত্যে মন্ত্রের মতো উচ্চারিত হয়; শোষণ, বঞ্চনা, উৎপীড়ন, নিষ্ঠুরতা আর সহিংসতার বিরুদ্ধে সাহিত্যের উচ্চারণ অত্যন্ত বলিষ্ঠ। সত্য, সুন্দর ও কল্যাণের মন্ত্রে উজ্জীবিত করে সাহিত্য বিশ্বময় মানুষকে সম্প্রীতির বন্ধনে বাঁধে। সাহিত্য জাতীয় জাগরণ, স্বাধীনতা সংগ্রাম, স্বাধিকারের দাবি উচ্চারণের মাধ্যমে পরাধীন, অধিকার-বঞ্চিত মানুষের মনে জাতীয় চেতনার উন্মেষ ও বিকাশ ঘটায়।
সাহিত্যে সমাজ, সংস্কৃতি তার ইতিহাস-ঐতিহ্যসমেত সমগ্র চেহারা নিয়ে প্রতিফলিত হয়। সমাজের সকল শ্রেণির মানুষের বৈচিত্র্যময় জীবনের আনন্দ-বেদনা, আশা-আকাঙ্ক্ষা, সংকট-সম্ভাবনার চিত্র বাত্ময় হয়ে ওঠে সাহিত্যে। তাই সাহিত্যপাঠে সমাজকে জানা যায় অনুপুরূপে।
সত্য-সুন্দরের সাধনায় জীবনকে মহিমান্বিত করার ক্ষেত্রে সাহিত্যের ভূমিকা অনন্য। এটি সাহিত্যের উপযোগের দিক; কিন্তু গৌণ দিক মাত্র। দৈনন্দিন জীবনে কর্মে ক্লান্ত, হতাশায় নিমজ্জিত, সমস্যায় ক্লিষ্ট মানবমন চায় একটু স্বস্তির অবসর; প্রত্যাশা করে ক্লান্তিদায়ী ভুবনের প্রতিস্পর্ধী অন্য ভুবন, যে ভুবন স্বপ্নের, আনন্দের, রোমাঞ্চের। আমরা যখন শোকে বিহ্বল, আনন্দে আত্মহারা আর হতাশায় বিধ্বস্ত হই তখন জ্ঞান-বিজ্ঞান-দর্শন আমাদের এ অনুভূতি জগৎকে সাহায্য করতে পারে না। ক্লান্ত-বিধ্বস্ত-অবসাদগ্রস্ত মনে আনে অনাবিল শান্তি। সাহিত্য প্রাণের ভাষায় প্রাণের কথা বলে। তাই সাহিত্য প্রাণে প্রাণে প্রেরণা ছোটায়, স্পন্দন জাগায়। কবি ওমর খৈয়াম তাই বেহেশতের আসবাবপত্রের ফিরিস্তি বানাতে গিয়ে কাব্যগ্রন্থের কথা ভুলেননি : রুটি,মদ হয়তো নিঃশেষ হয়ে যাবে, সাকি ক্লান্ত হয়ে পড়বে, কিন্তু অমর কাব্য তার সাথে থাকবে অনন্ত যৌবনা সঙ্গিনীর মতো।
0 মন্তব্য(গুলি):
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
Comment below if you have any questions