আগ্নেয়গিরি কি / আগ্নেয়গিরি কাকে বলে
আগ্নেয়গিরি কি: ভূ-ত্বকের শিলাস্তর সর্বত্র সমান কঠিন বা গভীর নয়। তাই কোন কোন সময় ভূ-ত্বকের চাপ প্রবল হয়ে শিলা স্তরের কোন দুর্বল অংশ ফেটে ভূ-গর্ভ হতে ভূ-পৃষ্ঠ পর্যন্ত একটি সুড়ঙ্গ পথের সৃষ্টি হয়। সে পথ দিয়ে ভূ-গর্ভস্থ বাষ্প, গলিত ধাতব পদার্থ, উত্তপ্ত প্রস্তর খন্ড, কর্দম, ধুম, ভষ্ম ইত্যাদি প্রবল বেগে ভূ-পৃষ্ঠে উঠে চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে এবং ছিদ্রপথ বা ফাটলের মুখের চারদিকে ক্রমশ: জমাট বেঁধে উচু মোচাকৃতি পর্বতের সৃষ্টি করে। সাধারণত এ ধরণের মোচাকৃতি আগ্নেয় পর্বতকে আগ্নেয়গিরি বলে।
আগ্নেয়গিরির উৎপত্তির কারণ
নিম্নলিখিত কারণগুলির দরুণ আগ্নেয়গিরির উৎপত্তি হয়:
ক) ভূ-ত্বকে দুর্বল স্থান বা ফাটলের অবস্থান : ভূ-ত্বকের সর্বত্র পুরুত্ব সমান নয়। পাতলা ভূ-ত্বক বা ফাটল থেকে ভূঅভ্যন্তরের গলিত ম্যাগমা, ভষ্ম, বাষ্প, ধাতু, ধুম্র ইত্যাদি প্রবল বেগে বের হয়ে আগ্নেয়গিরির উৎপত্তি হয়।
খ) ভূ-পৃষ্ঠের চাপের হাস: পৃথিবীর অভ্যন্তরে যতই যাওয়া যায় ততই উষ্ণতা বৃদ্ধি পায়। সাধারণত: ৩০ মি. গভীরতায় ১৭ সে. তাপ বৃদ্ধি পায়। সুতরাং ভূ-অভ্যন্তরের ৯৬০ কি. মি. গভীরতায় শিলাগুলো এত উত্তপ্ত হয় যে এরা গলিত অবস্থায় থাকবে বলে মনে হয়। কিন্তু ভূ-পৃষ্ঠের চাপের দরুণ শিলা গলিত অবস্থায় না থেকে স্থিতিস্থাপক অবস্থায় থাকে। আবার, ভূগর্ভে ক্রমবর্ধমান সঞ্চিত বাষ্পরাশি সর্বদা বাইরে আসতে চায়। ফলে ভূ-ত্বকের তলদেশে প্রবল উধ্বচাপ পড়ে। এর দরুণ উপরিস্থিত ভূ-ত্বক নিম্নস্থ কঠিন শিলার উপর যে চাপ দেয় তা বহুগুণে কমে যায়। এই হ্রাসমান চাপই অগ্নৎপাতে সাহায্য করে।
গ) ভূ-অভ্যন্তরে পানির প্রবেশ : কখনও কখনও ভূ-ত্বকের ফাটল দিয়ে নদী নালা খাল বিল এমনকি সমূদ্রের পানি ভূগর্ভে প্রবেশ করে সেখানে প্রচন্ড উত্তাপে ঐ পানি বাষ্পিভূত হয় ও আয়তনে বৃদ্ধি পেয়ে ভূ-ত্বক ফাটিয়ে তপ্ত আকারে প্রবলবেগে বহির্গত হয়ে আগ্নেয়গিরি সৃষ্টি করে।
ঘ) ভূ-গর্ভের চাপ বৃদ্ধি ও ভূ-গর্ভস্থ পদার্থ সমূহের আয়তন বৃদ্ধির ফলে ভূ-গর্ভে প্রচন্ড চাপের সৃষ্টি হয়। এর ফলে ভূ-ত্বক ফেটে গিয়ে আগ্নেয়গিরির সৃষ্টি হয়।
ঙ) রাসায়নিক ক্রিয়া ও ভূ-গর্ভে নানা প্রকার রাসায়নিক ক্রিয়ার দরুণ গ্যাস ও তাপের সৃষ্টি হয়। এতে ভূ-অভ্যন্তরের পদার্থ সমূহ উত্তপ্ত হয়ে চাপের সৃষ্টি করে এবং আগ্নেয়গিরির সৃষ্টি হয়।
চ) তেজস্ক্রিয় পদার্থের প্রভাব ও রেডিয়াম, থােরিয়াম, ইউরেনিয়াম প্রভৃতি তেজস্ক্রিয় পদার্থ প্রচুর তাপের সৃষ্টি করে এবং গলে আয়তনে বৃদ্ধি পায়। ফলে অগুপাতের সৃষ্টি হয়।
ছ) ভূ-আন্দোলন ও ভূ-আন্দোলনের ফলে পার্শ্বচাপে ভূ-ত্বকের দুর্বল অংশ ভেদ করে উত্তপ্ত তরল লাভা উপরে উঠে আসে।
জ) ভূ-পৃষ্ঠের তাপ বিকিরণ : ভূ-পৃষ্ঠ সর্বদা তাপ বিকিরণ করে শীতল ও সংকুচিত হয়। এতে ভাঁজের সৃষ্টি হয়, চাপ হ্রাস পায় এবং ভূ-ত্বক ফেটে অগুৎপাত ঘটায়।
আগ্নেয়গিরির উৎপত্তিতে ম্যাগমা আগ্নেয়গিরির উৎপত্তির সঙ্গে ম্যাগমা সরাসরি জড়িত। বিজ্ঞানীরা ধারণা করেন ভূ-ত্বক ও গুরুমন্ডলের মাঝামাঝি যে আঠাল পদার্থ আছে তা নানা কারণে পৃথিবীর উপরিভাগে উঠে আসে। ম্যাগমা চার ধরণের ভূ-তাত্ত্বিক পরিবেশে ভূ-পৃষ্ঠের ওপরে উঠে আসে।
ক) ভূ-গঠন প্লেটসমূহ, যেখানে পরস্পর সংঘাতপূর্ণ অবস্থায় আছে : এক্ষেত্রে ভূ-ত্বকের একটি অংশ আর একটি প্লেটের তলদেশে সঞ্চারিত হতে থাকে। ফলে অবনমিত প্লেটের সম্মুখভাগ তলদেশের প্রচন্ড উত্তাপে গলে যায়। এসমস্ত গলিত শিলা ম্যাগমায় পরিণত হয়। এই ম্যাগমার ঘনত্ব পার্শ্ববর্তী শিলার চেয়ে কম হওয়ায় তা ধীরে ধীরে ওপরে উঠে আসে ও ভূত্বকের ফাটল বরাবর ভূ-পৃষ্ঠে উদগিরিত হয়। এ পরিবেশে ব্যাসল্টিক এবং অ্যাড্রেসাইটিক ম্যাগমার সৃষ্টি হয়।
খ) প্লেটসমূহ যেখানে পরস্পর থেকে বিপরীত দিকে অগ্রসরমান
প্লেটসমূহের বিপরীতমূখী সঞ্চয়নের ফলে ভূ-অভ্যন্তরের চাপ ঐ স্থানে হ্রাস পায়। ফলে ঐ স্থানের গলনাঙ্ক হ্রাস পায় ভূঅভ্যন্তরের প্রচন্ড তাপে। এর ফলে যে ফাটলের সৃষ্টি হয় তা পুরণের জন্য ভূ-অভ্যন্তরের ম্যাগমা উপরে উঠে আসে। এতে করে ব্যাসল্টিক ম্যাগমা তৈরী হয়। এধরণের আগ্নেয় তৎপরতায় তৈরী হয়েছে আইসল্যান্ড দ্বীপ।
গ) পার্শ্বীয় সংঘাত
প্লেটসমূহ অনেক সময় বিপরীত দিকে পাশ্বীয় গতিতে নড়াচড়া করে। এমতাবস্থায় সরে যাওয়া অংশে নাজুক অবস্থার সৃষ্টি করে। এই অংশ থেকে উত্তপ্ত গলিত ম্যাগমা বের হয়ে আসে।
ঘ) প্লেটের ভেতরের উত্তপ্ত অংশ
অনেকক্ষেত্রে প্লেটের অভ্যন্তরে আগ্নেয়গিরির অবস্থানের ফলে উক্ত স্থানগুলো অত্যন্ত উত্তপ্ত থাকে। তখন গুরুমন্ডল থেকে তরল শিলার কুন্ডুলী উপরে উঠে আসে এবং গলিত ম্যাগমা বেরিয়ে আসে। হাওয়াই দ্বীপপুঞ্জ এভাবে সৃষ্টি হয়েছে।
আগ্নেয়গিরির শ্রেণী বিভাগ
ভূবিজ্ঞানী ডানা (১৮৯১) উদ্গিরিণের ভিত্তিতে আগ্নেয়গিরিকে তিন ভাগে ভাগ করেছেন। যথা- (১) উদবেদী (২) নি:স্বারী এবং (৩) মাঝারি । তারপর আরও পরিবর্তন এনে নিম্নলিখিত তিনটি বিষয়ের উপর ভিত্তি করে আগ্নেয়গিরির শ্রেণীবিভাগ করা হয়। যথা
১। নির্গমণ পথ ও জ্বালামুখের উপর ভিত্তি করে।
২। কার্যকারীতার উপর ভিত্তি করে।
৩। উদ্গিরিত লাভার ধরণ ও গঠণের ওপর ভিত্তি করে।
১। নির্গমন পথের উপর ভিত্তি করে শ্রেণী বিভাগ
ক) ফিসার আগ্নেয়গিরি;
খ) সিলিন্ডার আগ্নেয় গিরি।
২। কার্যকারিতার উপর ভিত্তি করে শ্রেণী বিভাগ
ক) সক্রিয়
i) অবিরাম, যেমন- ক্যলিফোর্নিয়ার আগ্নেয়গিরি ।
i) সবিরাম, যেমন- সিসিলি আগ্নেয়গিরি।
খ) সুপ্ত, যেমন- জাপানের ফুজিয়ামা আগ্নেয়গিরি।
গ) মৃত, যেমন- মেক্সিকোর পেরিকোটিন আগ্নেয়গিরি ।
৩। উদগিরিত লাভার ধরণ এবং আগ্নেয়গিরির গঠণের উপর ভিত্তি করে শ্রেণী বিভাগ
ক) শেইল্ড আগ্নেয়গিরি : এ জাতীয় আগ্নেয়গিরির লাভা বহুদূর ব্যাপী বিস্তৃত এবং দেখতে কিছুটা ব্যাঙের ছাতার মত বা গম্বুজাকৃতির। এর ঢাল সাধারণত: গােড়ার দিকে ৫ এবং ওপরের দিকে ১৫° এর বেশী হয়। এরূপ আগ্নেয়গিরি প্রধানত ব্যাসল্ট দিয়ে গঠিত। হাওয়াই দ্বীপের মনালোয়া, কিলাউয়া এর অন্যতম উদাহরণ।
খ) সিনডারকোন আগ্নেয়গিরি : সিন্ডার কোন সাধারণত খাড়া ঢাল বিশিষ্ট (প্রায় ৩০°-৪০°) এবং আকারে ছােট হয় | (৩০০মি. এর বেশী নয়)। প্রায়ই নিকটবর্তী বৃহৎ আগ্নেয়গিরির পাশে গঠিত হয়। মেক্সিকোর পেরিকোটিন এর উদাহরণ।
গ) মিশ্র কোণ আগ্নেয়গিরি : জাপানের ফুজিয়ামা এবং ফিলিপাইনের মাউন্ট মেওন এধরণের আগ্নেয়গিরি। এই শ্রেনীর আগ্নেয়গিরি আকারে বড়, প্রায় সমান পুরুত্ব বিশিষ্ট লাভা শিলা খন্ডের স্কুপে গঠিত। প্রথমে নি:শ্বব্দে চটটচে আঠালো জ্যান্ডেসাইটিক লাভা, পরে কঠিন শিলা টুকরা, ধুলিকণা, উত্তপ্ত গ্যাস এবং শেষে পুনরায় আঠালো লাভা এর ওপর জমা হয়। এ জন্য একে মিশ্র কোন আগ্নেয়গিরি বলে।
0 মন্তব্য(গুলি):
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
Comment below if you have any questions