পদের ব্যক্তার্থ ও জাত্যর্থ
পদের ব্যক্ত্যর্থ ও জাত্যর্থের সংজ্ঞা (Definition of the Denotation and Connotation of Terms) :
কোনো পদকে ব্যবহার করার সময় আমরা প্রথমে চিন্তা করি কোন্ বস্তুর উপর পদটি প্রযোজ্য এবং পরে চিন্তা করি পদটি যেসব বস্তু নির্দেশ করে সেসব বস্তুর মধ্যে কী কী গুণ রয়েছে। পদ মাত্রই কোনো না কোনো বস্তু বা বিষয়কে নির্দেশ করে। সাধারণভাবে একটি পদ যে বস্তু বা বিষয়ের নির্দেশক সেটিই হলো ঐ পদের অর্থ। তবে কোনো পদকে বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে পদটির দ্বারা দুই প্রকারের অর্থ নির্দেশিত হয়। একটি পদ একদিকে একটি বিশেষ ব্যক্তি বা বস্তু বা কোনো বিশেষ পদার্থকে যেমন নির্দেশ করে, অন্যদিকে পদটি দ্বারা প্রকাশিত বা নির্দেশিত বিষয়টির সারধর্মকেও নির্দেশ করে। অর্থাৎ একটি পদকে দুদিক থেকে বিচার করা যায়। এদের একটি হলো পদের সংখ্যার দিক, অন্যটি হলো পদের গুণের দিক। সংখ্যার দিকটিকে বলা হয় পদের ব্যক্ত্যর্থ (Denotation) এবং গুণের দিকটিকে বলা হয় পদের জাত্যৰ্থ (Connotation)। ব্যক্ত্যর্থ পদের পরিমাণ নির্দেশ করে এবং জাত্যর্থ পদের আবশ্যিক বৈশিষ্ট্য নির্দেশ করে। সাবেকী যুক্তিবিদ্যার ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, যুক্তিবিদ জন স্টুয়ার্ট মিল (John Stuart Mill) পদের তাৎপর্য ব্যাখ্যায় ব্যক্ত্যর্থ ও জাত্যৰ্থ পরিভাষা দুটি ব্যবহার করেন। তাঁর A System of Logic গ্রন্থটি প্রকাশিত হওয়ার পর থেকেই এ ধারণা দু'টির সর্বাধিক ব্যবহার লক্ষ্য করা যায় ।
ব্যক্ত্যর্থ (Denotation) :
কোনো পদ একই অর্থে যে বস্তু বা বস্তুসমূহের উপর প্রয়োগ করা সম্ভব, সে বস্তু বা বস্তুসমূহের সমষ্টিকে ঐ পদের ব্যক্ত্যর্থ বলে । আই. এম. কপি (I.M. Copi) ও কার্ল কোহেন (Carl Cohen)এর মতে, একটি সাধারণ পদ, বা শ্রেণিবাচক পদ যা কতিপয় বস্তুকে নির্দেশ করে এবং ঐ বস্তুগুলোর ক্ষেত্রেই পদটি সঠিকভাবে ব্যবহার করা যায় । এই বস্তুগুলোর সমষ্টিই পদটির ব্যক্ত্যর্থ গঠন করে । (A general term, or class term, denotes the several objects to which it may correctly be applied. The collection of these objects constitutes the extension or denotation of the term.)
ফ্রান্সিস হাওয়ার্ড-হাইডার (Frances Howard-Snyder), ড্যানিয়েল হাওয়ার্ড-স্নাইডার (Daniel Howard-Snyder) ও রায়ান ওয়াসেরম্যান (Ryan Wasserman) তাঁদের The Power of Logic গ্রন্থে বলেন যে, একটি পদ যেসব বস্তুর ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয় সেসব বস্তুর সমাহারকে ঐপদের ব্যক্ত্যর্থ বলে।” (The extension of a term consists of the set of things which the term applies.)
ব্যক্ত্যর্থ দ্বারা সাধারণভাবে পদের পরিমাণ নির্দেশ করা হয়। যেমন-মানুষ পদের ব্যর্থ হলো সকল মানুষ’ । কোনো | কোনো যুক্তিবিদ ব্যক্ত্যর্থ শব্দের প্রতিশব্দ হিসেবে বিস্তৃতি (extension), প্রশস্ততা (Breadth), পরিধি (domain), পরিসীমা | (scope), অধিকৃত ক্ষেত্র (sphere) ইত্যাদি শব্দ ব্যবহার করেছেন।
পদের ব্যক্ত্যর্থ নির্ণয়ের পদ্ধতি (Method of Determining the Denotation of Term) :
একটি পদের ব্যক্ত্যর্থ। একই সময়ে সকলের কাছে সমান থাকে। কিন্তু সময় পরিবর্তনের সাথে সাথে একটি পদের ব্যক্ত্যর্থ পরিবর্তিত হয়ে যায় । যেমন, ‘জীবিত বিড়াল’ পদটির ব্যক্ত্যর্থ প্রতি মুহুর্তে পরিবর্তিত হয়ে যায়। কারণ, কিছু বিড়াল মারা যায় এবং কিছু বিড়াল জন্মগ্রহণ করে। কিন্তু শুধু ‘বিড়াল’ বললে এ পদটির ব্যক্ত্যর্থ হবে একই অর্থে অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যতের সকল বিড়াল।
আবার, কিছু কিছু পদের ব্যক্ত্যর্থ সময় পরিবর্তনের সাথে সাথে পরিবর্তিত হয়ে যায়। যেমন, ‘জীবিত ডাইনোসর ও ‘বাংলার স্বাধীন নবাব’ পদগুলো এক সময় অস্তিত্বশীল সত্তাকে নির্দেশ করতো; কিন্তু বর্তমানে এগুলোর কোন অস্তিত্ব নেই।
তাই এসব পদের ক্ষেত্রে ‘শূণ্য ব্যক্ত্যর্থ’ (empty extension) ব্যবহার করা হয়। এ রকম শূণ্য ব্যক্ত্যর্থ বিশিষ্ট আরো কয়েকটি পদের উদাহরণ হলো, এলিয়েন, ইউনিকর্ণ, মৎসকন্যা, পঙ্খীরাজ ঘোড়া, সোনার পাথর বাটি ইত্যাদি।
মূলত ব্যক্ত্যর্থ হলো একটি পদ সমজাতীয় ও অভিন্ন বৈশিষ্ট্যযুক্ত যেসব বিষয় ও বস্তুর ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা যায় সেসব বিষয় বা বস্তুর মোট সংখ্যা। তাইতো বলা হয়, জাত্যর্থ একটি পদের ব্যক্ত্যর্থ নির্ধারণ করে(Intension determines extension)।
জাত্যর্থ (Connotation) :
কোন পদ দ্বারা নির্দেশিত বিশেষ বস্তু বা বস্তুসমষ্টির অন্তর্গত সাধারণ ও অনিবার্য গুণ বা গুণসমষ্টিকে ঐ পদের জাত্যর্থ বলে। আই. এম. কপি (I.M. Copi) ওকার্ল কোহেন (Carl Cohen) বলেন যে, একটি পদ দ্বারা নির্দেশিত সকল বস্তুর মধ্যে বিদ্যমান সাধারণ গুণকে বলা হয় ঐ পদের জাত্যর্থ । (The set of attributes shared by all and only those objects to which the term refers is called the "intention" or connotation of that term.)
ফ্রান্সিস হাওয়ার্ড-স্নাইডার (Frances Howard-Snyder), ড্যানিয়েল হাওয়ার্ড-স্নাইডার (Daniel Howard-Snyder) ও রায়ান ওয়াসেরম্যান (Ryan Wasserman) বলেন, একটি পদের ব্যক্ত্যর্থের আওতাভুক্ত হতে হলে ঐ পদ নির্দেশিত বিষয় বা বস্তুর যেসব বৈশিষ্ট্য বা গুণ অপরিহার্যভাবে থাকা প্রয়োজন সেসব বৈশিষ্ট্য বা গুণই হলো পদটির জাত্যর্থ। (The intension of a term consists of the properties a thing must have to be included in the term's extension.)
জাত্যর্থ হলো একটি পদের সাধারণ গুণ বা বৈশিষ্ট্যগত দিক। তবে পদের বিভিন্ন ধরণের গুণ থাকতে পারে । কিন্তু জাত্যর্থ বলতে সেসব গুণ বুঝায় যা সাধারণভাবে একই শ্রেণির সকল সদস্যদের মধ্যে বিদ্যমান এবং যা অর্থের দিক থেকেও গুরুত্বপূর্ণ। অর্থাৎ জাত্যর্থ হলো পদের এমন বৈশিষ্ট্য যে বৈশিষ্ট্য ছাড়া ঐ পদ নির্দেশিত বস্তুর অস্তিত্ব কল্পনা করা যায় না।
যেমন-‘মানুষ' পদটির জাত্যর্থ হলো জীববৃত্তি ও বুদ্ধিবৃত্তি। কারণ সকল মানুষের বিভিন্ন গুণাবলি তুলনা করলে দেখা যায় | যে, সকলের মধ্যে শুধু জীববৃত্তি ও বুদ্ধিবৃত্তি সাধারণ ও আবশ্যিকভাবে বিদ্যমান।
পদের জাত্যৰ্থ নির্ণয়ের পদ্ধতি (Method of Determining the Connotation of Term) :
একটি অস্তিত্বশীল শ্রেণিবাচক পদের অসংখ্য গুণ বা বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান। যেমন-মানুষ পদের বৈশিষ্ট্য হলো জীববৃত্তি, বুদ্ধিবৃত্তি, মরণশীলতা, চিন্তাশীলতা, চতুরতা ইত্যাদি। এসব বৈশিষ্ট্যের মধ্যে কোন্টি জাত্যর্থ এবং কোটি জাত্যর্থ নয়-তা নির্ধারণের উপায় কী? জাত্যৰ্থ নির্ণয়ের জন্য এ সম্পর্কিত তিনটি অর্থ সম্পর্কে আমাদের ধারণা নেওয়া প্রয়োজন।
ব্যক্তিসাপেক্ষ জাত্যৰ্থ (Subjective Connotation) :
কোন পদ সম্পর্কে বিভিন্ন ব্যক্তি নানাবিধ ধারণা পোষণ করতে পারেন। কারণ একটি বিষয় বা বস্তু সম্পর্কে সকলের জ্ঞান সমান নয়। যেমন-‘রাজনীতিবিদ পদ দ্বারা কোনো ব্যক্তি ‘দেশপ্রেমিক ব্যক্তিবর্গ, কেউ ‘ঝামেলা সৃষ্টিকারী ব্যক্তিবর্গ, কেউ সমাজ সংস্কারক, আবার অন্য কোন ব্যক্তি ‘আদর্শবান ব্যক্তিবর্গ’ কে বুঝিয়ে থাকেন। এখানে বিভিন্ন ব্যক্তি তাঁর নিজ নিজ রুচিবোধ, শিক্ষা, অভিজ্ঞতা, দৃষ্টিভঙ্গি ইত্যাদির উপর নির্ভর করে ‘রাজনীতিবিদ পদটির বিভিন্ন বৈশিষ্ট্যকে উল্লেখ করেছেন। এ বৈশিষ্ট্য গুলো আলাদা আলাদা ব্যক্তির নিকট ভিন্ন ভিন্ন রকম। এ রকম ব্যক্তি মতের সাপেক্ষে কোন পদের জাত্যর্থ প্রকাশ করা হলে তাকে ব্যক্তি সাপেক্ষ জাত্যর্থ বলে । যুক্তিবিদ্যায় ব্যক্তি সাপেক্ষ জাত্যর্থ যথার্থ জাত্যর্থ নয়। কারণ এ জাত্যৰ্থ সুনির্দিষ্ট নয়।
বস্তুসাপেক্ষ জাত্যৰ্থ (Objective Connotation) :
কোন বিষয় বা বস্তুর যে কিছু গুরুত্বপূর্ণ ও অপরিহার্য বৈশিষ্ট্য থাকে, তেমনি গুরুত্বহীন বা গৌণ বৈশিষ্ট্যও থাকে। এ সকল বৈশিষ্ট্যই বস্তু সাপেক্ষ জাত্যর্থ । যেমন-'মানুষ' পদের জীববৃত্তি ও বুদ্ধিবৃত্তি ছাড়াও আরো অনেক গুণ রয়েছে। কোন বিষয় বা বস্তুর বস্তুসাপেক্ষ জাত্যর্থ এত ব্যাপক যে তা নির্ণয় করা অনেক ক্ষেত্রেই সম্ভব হয় না। তাছাড়া বস্তুসাপেক্ষ জাত্যৰ্থ পরিবর্তনশীল বলে পদের অর্থও সুনির্দিষ্ট থাকে না। তাই বস্তুসাপেক্ষ জাত্যর্থের মতবাদ গ্রহণযোগ্য নয়।
ব্যবহারিক বা প্রথাগত জাত্যৰ্থ (Practical or Conventional Connotation) :
কোনো পদের যে জাত্যর্থ বিশেষজ্ঞদের দ্বারা নির্ধারিত হয় তাকে প্রথাগত জাত্যর্থ বলে। অর্থাৎ কোনো পদের ক্ষেত্রে যে বৈশিষ্ট্য বর্তমান থাকার ফলে ঐ পদ নির্দেশিত বিষয় বা বস্তুসমূহকে একটি বিশেষ শ্রেণিভুক্ত করা যায় এবং যে বৈশিষ্ট্য অনুপস্থিত থাকলে ঐ পদ নির্দেশিত বিষয় বা বস্তুগুলোকে আর ঐ বিষয় বা বস্তু বলে স্বীকার করা যায় না; সে বৈশিষ্ট্যই হলো ঐ পদের জাত্যর্থ।
বিশেষজ্ঞদের দ্বারা নির্ধারিত এ ধরণের জাত্যর্থকে প্রথাগত জাত্যর্থ বলে স্বীকার করা হয়। একে যৌক্তিক জাত্যর্থও (Logical Connotation) বলা হয় । তাহলে দেখা যায় যে, কোন পদের জাত্যর্থ হলো ঐ পদ নির্দেশিত বস্তুসমূহের মৌলিক বৈশিষ্ট্য যা ছাড়া ঐ পদের অস্তিত্বই কল্পনা করা যায় না। মৌলিক বৈশিষ্ট্য নির্ধারণের ক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞদের ভূমিকাই মুখ্য। তাই বিশেষজ্ঞগণ দ্বারা নির্ধারিত যৌক্তিক জাত্যর্থই যুক্তিবিদ্যায় স্বীকৃত জাত্যর্থ।
0 মন্তব্য(গুলি):
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
Comment below if you have any questions