বাংলাদেশের প্রাকৃতিক পরিবেশ
বৈচিত্র্যময় ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে বাংলাদেশ বিশ্বের অন্যতম জীববৈচিত্র্যসমৃদ্ধ একটি দেশ। তবে অন্যান্য উন্নয়নশীল দেশের মতোই বাংলাদেশেও পরিবেশগত উন্নয়ন একটি বড় চ্যালেঞ্জ। যেহেতু অর্থনৈতিক কার্যাবলি এখনও দেশের প্রাকৃতিক সম্পদের উপর বহুলাংশে নির্ভরশীল, সেহেতু গুরুত্বপূর্ণ সেক্টরসমূহের জিডিপি-তে অবদান টেকসই ও উন্নত পরিবেশ (quality of environment) দ্বারা অনেকাংশে প্রভাবিত হয়। অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও টেকসই পরিবেশ পরস্পর অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত হওয়ায়, পরিবেশ সংশ্লিষ্ট বিষয়াদিকে উন্নয়ন কার্যক্রমের সাথে সমন্বিত করার বিষয়টি গুরুত্ব পাচ্ছে।
বাংলাদেশের প্রাকৃতিক পরিবেশের মধ্যে মিশে আছে দরিদ্র্য, জনস্ফীতি এবং জন সচেতনতার অভাব। একই সাথে বিদ্যমান প্রাকৃতিক দুর্যোগ বন্যা, খরা, মঙ্গা, ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস প্রভৃতি।
বাংলাদেশের প্রাকৃতিক পরিবেশের স্বতন্ত্র উপাদানসমূহ নিম্নে আলোচনা করা হলো :
(ক) ভৌগোলিক অবস্থান : বাংলাদেশ ২০°৩৪ থেকে ২৬°৩৮ উত্তর অক্ষাংশ এবং ৮৮°০১ থেকে ৯২°৪১ পূর্ব দ্রাঘিমার মধ্যে অবস্থিত। বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্ব দিকে কিছুটা সীমান্ত মায়ানমারের সাথে সংযুক্ত। এছাড়া তিনদিকে ভারত এবং দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর। ভারতের সাথে সীমানা দৈর্ঘ্য ৪১৫৬ কিলোমিটার, মায়ানমারের সাথে ২৭১ কিলোমিটার এবং বঙ্গোপসাগরের সাথে সমুদ্র উপকূলের দৈর্ঘ্য ৭১১ কিলোমিটার।
(খ) ভূ-প্রকৃতি : বাংলাদেশের ভূপৃষ্ঠের ভূমিরূপ সর্বত্র একরূপ নয়। ভূ-প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য বিবেচনায় বাংলাদেশের ভূ-প্রকৃতি প্রধানত দু'ধরনের (যথা-সমভূমি এবং পাহাড়ি) হলেও এর মধ্যে ভিন্নতা বা বিভিন্নতা রয়েছে। কোনো স্থানের ভূ- প্রকৃতি পার্বত্য, সমভূমি, বনভূমি, বরেন্দ্রভূমি এবং কোথাও মাটির রং লাল বা জলাশয়, হাওর-বিল প্রভৃতি বিদ্যমান । চট্টগ্রাম, পার্বত্য চট্টগ্রাম ও সিলেটের টারশিয়ারি যুগের পাহাড়ি অঞ্চল; রাজশাহী অঞ্চলের বরেন্দ্রভূমি, মধুপুর ও ভাওয়ালের গড় এবং কুমিল্লার লালমাই পাহাড় হলো প্লাইস্টোসিন-কালের চত্বর ভূমি বা সোপান যা প্রায় ২৫,০০০ বছর পূর্বে গঠিত। এছাড়াও রয়েছে খুলনা, রংপুর ও দিনাজপুর এলাকার বনভূমি। মৌলভীবাজার ও হবিগঞ্জের পার্বত্য অঞ্চলে প্রচুর বৃষ্টিপাত হয় এবং চাও উৎপাদন হয়। এছাড়া এখানে রয়েছে প্রাকৃতিক গ্যাস, খনিজ তেল, কয়লা ও চুনাপাথর। বরেন্দ্রভূমি, গড় ও লালমাই এলাকায় উৎপাদন হয় আলু, আনারস, তরমুজ, ভুট্টা ও পান এবং বিস্তীর্ণ উর্বর সমভূমিতে ধান, পাট, ইক্ষু, তামাকসহ বিভিন্ন সবজি ও ফলমূল।
(গ) উপকূল রেখা : বাংলাদেশের দক্ষিণে বঙ্গোপসাগরের সাথে ৭১১ কিলোমিটার দীর্ঘ সমুদ্র উপকূল রেখা রয়েছে। খুলনার রায়মঙ্গল নদীর মোহনা হতে কক্সবাজারের টেকনাফ পর্যন্ত এটি বিস্তৃত। সমুদ্রের উপকূলভাগ ভগ্ন বা অভগ্ন উভয়ই হতে পারে। ভগ্ন উপকূল বিশিষ্ট দেশে সহজেই বন্দর ও পোতাশ্রয় গড়ে ওঠে। বাংলাদেশের উপকূল রেখা বেশি ভগ্ন ও গভীর নয়। একারণে চট্টগ্রাম ও চালনা নামক মাত্র দুটি সামুদ্রিক বন্দর গড়ে উঠেছে। এছাড়া এ অঞ্চলে সন্দ্বীপ, হাতিয়া, মহেশখালী, সেন্টমার্টিন, কুতুবদিয়া প্রভৃতি ছোট বড় অসংখ্য দ্বীপ রয়েছে।
(ঘ) নদ-নদী : মানুষের অর্থনৈতিক জীবনে নদীর প্রভাব খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। পানীয় জলের অভাবপূরণ, কৃষিক্ষেত্রে পানি সেচ, জলপথে সুলভ ব্যবসায়-বাণিজ্যের সুবিধা, মৎস্য আহরণ, পানি বিদ্যুৎ উৎপাদন ইত্যাদির মাধ্যমে নদী মানুষের জীবনকে নানাভাবে প্রভাবিত করে। পদ্মা, মেঘনা, যমুনা হলো বাংলাদেশের প্রধান নদী। এছাড়া শাখানদী, উপনদীসহ ২০০ এর অধিক নদ-নদীর পলি বিধৌত উর্বর ভূমির দেশ বাংলাদেশ।
(ঙ) জলবায়ু ও বৃষ্টিপাত : জলবায়ুর তারতম্যের ফলে বিভিন্ন স্থানের মানুষের বাসস্থান, পেশা, অর্থনৈতিক ক্রিয়াকলাপ ইত্যাদির মধ্যে পার্থক্য হয়ে থাকে। মানুষের দৈহিক গঠন ও কাঠামো, কর্ম দক্ষতা ইত্যাদিও জলবায়ুর উপর নির্ভর করে। বাংলাদেশের জলবায়ু উষ্ণ, আর্দ্র ও সমভাবাপন্ন। গ্রীষ্মকালে মৌসুমি বায়ুর প্রভাবে প্রচুর বৃষ্টিপাত হয়। গড় বৃষ্টিপাত ১২০-৩৪৫.৪ সে.মি, বাতাসের গড় আর্দ্রতা সর্বোচ্চ ৯৯% এবং সর্বনিম্ন ৩৬% ।
(চ) তাপমাত্রা : বাংলাদেশ ক্রান্তীয় মৌসুমি জলবায়ুর দেশ। গ্রীষ্মকালে এখানে গড় তাপমাত্রা ২১°-৩৪° সেলসিয়াস এবং শীতকালে ১১°-২৯° সেলসিয়াস থাকে। গ্রীষ্মকালে সর্বোচ্চ গড় তাপমাত্রা ৩৭° সেলসিয়াস এবং শীতকালে সর্বনিম্ন গড় তাপমাত্রা ৭° সেলসিয়াস লক্ষ্য করা গিয়েছে।
(ছ) মৃত্তিকা : মৃত্তিকার গুণাগুণের উপর কৃষির সাফল্য নির্ভর করে। নদীমাতৃক বাংলাদেশের ভূমির বেশিরভাগ নদী বিধৌত পলি দ্বারা গঠিত। এখানকার মাটিতে প্রাকৃতিকভাবেই নাইট্রিক ও ফসফরিক এসিড থাকায় জমির উর্বরতা বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে উর্বর মৃত্তিকাযুক্ত এ অঞ্চলে কৃষির উন্নতি এবং কৃষি নির্ভরশীল শিল্প বিকশিত হচ্ছে।
(জ) উদ্ভিদ : জলবায়ু, মৃত্তিকার পার্থক্যের কারণে বিভিন্ন অঞ্চলে বিভিন্ন ধরনের উদ্ভিদ জন্মে। এভাবে বনভূমির সৃষ্টি হয়। উদ্ভিদ ও বনাঞ্চল দ্বারা বৃষ্টিপাত, বায়ুর আর্দ্রতা, ভূমি ক্ষয়রোধ, বন্যা নিয়ন্ত্রণ প্রভৃতি গুরুত্বপূর্ণ কার্যাবলি প্রভাবিত হয় । বাংলাদেশের উল্লেখযোগ্য বনাঞ্চল হলো:
(i) চট্টগ্রাম, পার্বত্য চট্টগ্রাম ও সিলেটের পাহাড়ি বনভূমি যা ক্রান্তীয় চিরহরিৎ অরণ্য নামে পরিচিত, মোট আয়তন ১৫৩২৬ বর্গ কিলোমিটার।
(ii) ঢাকা, টাঙ্গাইল, ময়মনসিংহ, দিনাজপুর ও রংপুরে ক্রান্তীয় পতনশীল ও পত্রযুক্ত বৃক্ষের বনভূমি, মোট আয়তন ৮৭৫ বর্গ কিলোমিটার। এবং
(iii) সুন্দরবন, Tidal বা Mangrove বনভূমি, আয়তন ৬৭৮৬ বর্গ কিলোমিটার ।
যেকোনো দেশের শতকরা ২৫% বনভূমি থাকা আবশ্যক হলেও বাংলাদেশে বর্তমানে মাত্র ১১.০০ শতাংশ বনভূমি রয়েছে। বাংলাদেশে মোট বনভূমির আয়তন ১.৬০ মিলিয়ন হেক্টর। এর মধ্যে প্রাকৃতিকভাবে সৃষ্ট ১.৪০ মিলিয়ন হেক্টর এবং অবশিষ্ট প্রায় ০.২০ মিলিয়ন হেক্টর উপকূলীয় অঞ্চলে কৃত্রিমভাবে সৃষ্ট। এছাড়াও দেশের সর্বত্র প্রায় ০.৭৭ মিলিয়ন হেক্টর বসতবাড়ি ও প্রান্তিক পতিত ভূমি বৃক্ষাচ্ছাদনে আবৃত ।
(ঝ) খনিজ সম্পদ : মানুষের অর্থনৈতিক উন্নতিতে খনিজ সম্পদের প্রভাব সবচেয়ে বেশি যা প্রাকৃতিক পরিবেশের উপাদান। পৃথিবীর উন্নত দেশগুলোর শিল্প-সমৃদ্ধির মূলে রয়েছে বিভিন্ন ধরনের খনিজ সম্পদ। বাংলাদেশে প্রাকৃতিক গ্যাস, কয়লা, তেল, কঠিন শীলা, চুনাপাথর, সিলিকা বালু, গন্ধকসহ আরো অনেক মূল্যবান খনিজ-সম্পদ রয়েছে।
(ঞ) প্রাণিজ সম্পদ : প্রাণিজগতও নানাভাবে মানুষের অর্থনৈতিক উন্নতিতে সহায়তা করে থাকে। মাছ, মাংস, ডিম, চামড়া, রেশম প্রভৃতি প্রাণিজগৎ হতে পাওয়া যায়। এছাড়া পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা, পরিবহন ও কৃষিকার্য, চামড়া শিল্প প্রভৃতি প্রাণিজগতের উপর নির্ভরশীল।
(ট) বায়ু প্রবাহ : বায়ু প্রবাহ প্রাকৃতিক পরিবেশকে প্রভাবিত করে। যেমন গ্রীষ্মকালে দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমি বায়ুর প্রভাবে বৃষ্টিপাত ও শীতকালে উত্তর-পূর্ব-মৌসুমি বায়ুর প্রভাবে বৃষ্টিহীন শুষ্ক পরিবেশ বিদ্যমান থাকে ।
বাংলাদেশের প্রাকৃতিক পরিবেশের উপর উত্তরের হিমালয় পর্বত ও দক্ষিণের বঙ্গোপসাগর এর যথেষ্ট প্রভাব বিদ্যমান । এছাড়া বাংলাদেশ ক্রান্তীয় গ্রীষ্মমন্ডলীয় অঞ্চলে (tropical climate) অবস্থিত হওয়ায় সবুজ-শ্যামল রূপ-প্রকৃতির অপরূপ সাজে সজ্জিত এদেশ।
0 মন্তব্য(গুলি):
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
Comment below if you have any questions